বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন সে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা দেশের জনগণ, বিশেষত হিন্দুসমাজের উদ্দেশে ২৭ নভেম্বর নিচের বিবৃতিটি প্রকাশ করেছেন। প্রকাশের পরে আরও বহু মানুষ এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
আমরা, নিম্ন স্বাক্ষরকারী, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন নাগরিকরা, চট্টগ্রাম আদালতের নিকটে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শোকাহত ও ক্ষুদ্ধ। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বিচার করুন। এই দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনও ভাবেই যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট না হয় সেই ব্যাপারে আমাদের সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই শোককে জাতীয় ঐক্য ও গণশক্তিতে পরিণত করতে হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে তাদের আশ্রয় দেওয়া ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তি, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামি লিগের সহায়তায় এই দেশের সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী উগ্রতার জমিন তৈরি করছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তারা সেটাকে কাজে লাগিয়ে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামি লিগের সাথে মিলে, অবিরাম মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চাইছে।
চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে বিবৃতি পাঠানো হল, সেটা স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি ভারতীয় নাগরিক নন। তাঁকে জামিন কেন দেওয়া হল না– এই প্রশ্ন পরোক্ষভাবেও অন্য কোনও রাষ্ট্র করতে পারে না। ভারতের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের যে পরিস্থিতি, তাতে অন্য দেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার কোনও নৈতিক অধিকারই বিজেপি সরকারের নেই।
বাস্তবে এইসকল কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে অস্থিরতা ও দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি করা, আওয়ামি লিগের পুনর্বাসন ঘটানো এবং ভারতে বিজেপির ক্ষয়িষুiর অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করা। সাম্প্রতিক সময়ে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেখানে বিজেপির প্রচারের অন্যতম প্রধান ইস্যু ছিল বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন। এর মাধ্যমে বিজেপি ভারতের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থান নড়বড়ে। সেখানেও তারা জায়গা পেতে এটাকেই ইস্যু করছে, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সমাবেশও করেছে।
বিভিন্ন সময়ে এই দেশে হিন্দুদের উপর হামলা নতুন ঘটনা নয়, বিশেষ করে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় বারবার হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এইসব হামলার বেশিরভাগই রাজনৈতিক। বিগত আওয়ামি লিগের আমলেও দেশব্যাপী হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, জমি দখল, মন্দির ভাঙচুর, এমনকি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও সারা দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এ বার গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দির পাহারায় এগিয়ে আসে এবং নতুন করে সম্প্রীতির নজির স্থাপন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল নাগরিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে অঙ্গীকার করে– এর প্রতিফলন এবারের দুর্গাপূজায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানের মধ্যে লক্ষ করা গেছে। যদিও আমরা এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি– যেখানে যে কোনও ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ই তাদের ধর্মকর্ম ও উৎসব নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে পালন করতে পারবে, কোনও রকম পাহারা ও রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজন ছাড়াই।
স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন দাবিতে কোনও সংগঠন যদি আন্দোলনে নামে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু এ-ও সত্য যে, ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট শক্তি শুরু থেকেই নানা কায়দায় দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে হিন্দুদের কিছু ধর্মীয় সংগঠনের ৮ দফা দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলন ভারতের বিজেপি ও আওয়ামি লিগের মদদপুষ্ট বলে জনমনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে– তা দূর করার দায়িত্ব তাদেরই নেওয়া উচিত ছিল। কেন-না যে কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সবসময় সমাজের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে কাছে টানার চেষ্টা করে। কোনও আন্দোলন যদি গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, কিংবা ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে তখন তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
হিন্দুদের শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনের অধিকার আছে কিন্তু হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পন্থা চরম হঠকারিতা– যা কেবল অন্ধকারের শক্তিকেই পুষ্টি যোগাবে।
মনে রাখতে হবে, কিছু ধর্মীয় সংগঠন মানেই এই দেশের সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায় নয়।এই দেশের হিন্দুরা বরাবরই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে। স্বাধীনতাযুদ্ধ সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকজনের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আর যে কোনও দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা সেই দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সে ধরনের একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে এই দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে।
এই সংকটময় সময়ে বাংলাদেশের হিন্দু জনসমাজের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের সচেতন প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের আহ্বান, নিজ নিজ জায়গা থেকে সকল ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী প্রচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিবেকবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করুন।
বাংলাদেশের জনগণের এক অভূতপূর্ব ঐক্য, দৃঢ়তা, ও আত্মত্যাগের পথ ধরে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের সংগ্রাম ও শাহাদাতে অংশীদার বাংলাদেশের হিন্দু জনতাও। হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, রুদ্র সেনদের আত্মত্যাগের পথ ধরে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেই বিজয়কে আমরা হারিয়ে যেতে দেব না। বিবৃতিতে অনলাইনে স্বাক্ষরদাতা নাগরিকবৃন্দঃ
দেবাশীষ চক্রবর্তী – শিল্পী, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট
দীপক সুমন – অভিনেতা ও নির্দেশক
খোকন দাস – লেখক ও সাংবাদিক
প্রীতম দাশ – সদস্য, জাতীয় নাগরিক কমিটি
মেঘমল্লার বসু – শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী
ধ্রুবজ্যোতি হোর – শিক্ষাকর্মী
সীমা দত্ত – সভাপতি, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র
স্নেহাদ্রি চক্রবর্তী – আইনজীবী
জয়দীপ ভট্টাচার্য – চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় সদস্য
ডক্টর্স প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলস হেলথ
অনীক রায় – সাংবাদিক
বীথি ঘোষ – শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য – সাংস্কৃতিক সংগঠক
সজীব চক্রবর্তী – শিক্ষার্থী
দীপঙ্কর বর্মন দীপু – শিক্ষার্থী
দুর্জয় রায় – শিক্ষার্থী
নয়ন সরকার জয় – শিক্ষার্থী
সজীব কিশোর চক্রবর্তী – শিক্ষার্থী