ব্যাঙ্ক খাতে সম্প্রতি সংঘটিত একের পর এক দুর্নীতির জের ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে৷ বিশ্লেষকের আশঙ্কা, নিয়ন্ত্রণহীন এই লুটপাট যদি থামানো না যায়, তা হলে দেশের আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতি দুই–তিন বছরের মধ্যেই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে৷ আসলে যে কোনও অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিতে হয় শ্রমজীবী মানুষ এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে৷ যাদের কারণে এই সংকট, তারা ততটা ভুগবে না৷ কারণ, জনগণের টাকায় ওইসব লুটেরাদের ‘বেইল আউট’ করা হয়৷ এই লুটপাটের নেতৃত্ব দিচ্ছে তথাকথিত ব্যবসায়ীদের একটা অংশ৷ এদের ‘তথাকথিত’ বলার কারণ হচ্ছে – বলতে গেলে এদের তেমন কোনও পণ্য উৎপাদন নেই৷ শুধু ব্যাঙ্ক ঋণ পাওয়ার জন্যই এরা কিছু পণ্যের উৎপাদন দেখায়৷ আগে এই লুটপাটকারীরা ব্যাঙ্ক ঋণ আত্মসাৎ করত, আর এখন দখলে নিচ্ছে পুরো ব্যাঙ্কই৷ লুটপাটের নতুন এই ধরন শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে৷
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে লুটপাট একটি সাধারণ বিষয়৷ ইউরোপের পুঁজিতন্ত্র বিকশিত হয়েছে সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা উপনিবেশগুলি লুট করে৷ আবার ভারত সহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখলের মাধ্যমেই পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে৷ বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান সংকট হচ্ছে দেশ থেকে পুঁজি পাচার৷
কীভাবে এই পুঁজি পাচার হচ্ছে? ব্যবসা–বাণিজ্য তো বৈধভাবেই হচ্ছে, তা হলে মুদ্রাপাচার হচ্ছে কীভাবে?
কারখানায় শ্রমিক, জমিতে কৃষক আর বিভিন্ন সেবাখাতে মধ্যবিত্ত যে শ্রম দেয়, তার মাধ্যমেই পুঁজি তৈরি হয়৷ এই পুঁজির স্থানিক রূপ হচ্ছে টাকা আর আন্তর্জাতিক প্রতীক হচ্ছে মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশ থেকে এখন প্রধানত দুই প্রক্রিয়ায় পুঁজি বা টাকা পাচার হচ্ছে৷ এই ধরনগুলি হচ্ছে – আমদানির সময় পণ্যের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্য দেখানো আর রফতানির সময় কম মূল্য নির্ধারণ করা৷ সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্ট’ দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচারের বিষয়ে সতর্ক করে আসছে৷ টাকা পাচার করার জন্য দেশের পুঁজিপতিদের একটা অংশ এই উভয় প্রক্রিয়াই অনুসরণ করছে৷ আর এ কাজে ব্যবহার করছে তাদের দখল করা ব্যাঙ্কগুলি৷ বাংলাদেশও তাদের এই অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি পাচার বন্ধ করতে পারছে না৷ কারণ, ব্যাঙ্কিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উচ্চপদে বসানো হয়েছে ওইসব লুটেরা–পাচারকারীদের্ প্রতিনিধি৷ এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহার৷
এরপরও টাকা পাচারের ছোট কিছু ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এবি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে গত দুই বছরে সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরশাহীতে পাচার হয়েছে ৫০৫ কোটি টাকা৷ অন্য ব্যাঙ্কেও এই ধরনের পাচার এখন দেদার চলছে৷ কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পরিদর্শক দল স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি পায়নি৷ এবি ব্যাঙ্কের মালিকগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ক্ষমতার বাইরে থাকা বি এন পি–র বলে এই ধরনের কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়৷
সিঙ্গাপুরের সংবাদপত্র দ্য বিজনেস টাইমস ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ সেখানে ৮১০ কোটি টাকা দিয়ে বড় সংস্থা কিনেছে৷ ওই সময় সাংবাদিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন৷ প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে কোনও ব্যবসায়ী দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ও সরকারের অনুমোদন নিতে হয়৷ কিন্তু এস আলম গ্রুপের এই ধরনের কোনও অনুমোদন ছিল না৷ টাকা পাচারের পাশাপাশি এই গ্রুপটি গত এক বছরে ইসলামি ব্যাঙ্ক, সোস্যাল ইসলামি ব্যাঙ্ক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাঙ্ক দখল করে নিয়েছে৷ এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, আল–আরাফাহ ব্যাঙ্ক, এন আর বি গ্লোবাল ব্যাঙ্ক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাঙ্ক এখন এই গ্রুপের মালিকানাধীন৷
এস আলম গ্রুপের পাশাপাশি বেক্সিমকো, এজি অ্যাগ্রো লিমিটেড, ইলিয়াস ব্রাদার্স সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল অঙ্কের ব্যাঙ্ক ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ আর এই ধরনের লুটপাটের খেসারত দিতে গিয়ে ফার্মার্স ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ার পথে বসেছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একই রকম লুটপাট হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে৷ এসব ব্যাঙ্ককে বাঁচানোর জন্য সরকার ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেইল আউট দিয়েছে৷ আগামী অর্থ বছরেও দেওয়া হবে ২ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যথায়, এসব সরকারি ব্যাঙ্ক অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে যেত৷ বর্তমানে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে ভয়াবহ রকমের টাকার সংকট চলছে (তারল্য সংকট)৷ এই টাকা গেল কোথায়? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, মুদ্রাপাচারের জের ধরেই এই সংকটের উদ্ভব৷ গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬১.৬৩ বিলিয়ন ডলারের মুদ্রা পাচার হয়েছে৷ ২০১৪ পরবর্তী বছরগুলিতে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ কত সে বিষয়ে সংস্থাটি এখনও কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি৷ তবে এই হার যে বেড়েছে তা ব্যাঙ্কগুলির খেলাপি ঋণের ব্যাপকতারই ইঙ্গিত দেয়৷ ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা৷
এ ভাবে কতদিন চলবে? এর পরিণতি কী হবে?
মুদ্রা পাচার আর খেলাপি ঋণের এই সংকটের যদি এখনই লাগাম টানা না যায়, তা হলে গোটা আর্থিক খাত ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়ে যাবে৷ প্রথমত, ব্যাঙ্কগুলি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও আমানতকারীদের টাকা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে৷ একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহও করতে পারবে না৷ প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে না পেরে শিল্প–কারখানাগুলি বাধ্য হবে তাদের উৎপাদন কমাতে বা বন্ধ করতে৷ সেবা খাতও এই সংকট থেকে মুক্তি পাবে না৷ পরিণামে লাখ লাখ শ্রমিক ও পেশাজীবী বেকার হবে৷ ২০০৮ সালে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ এই রকম সংকটে পড়েছিল৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক ও সরকার কি টাকা ছাপিয়ে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে? সাধারণভাবে মনে হয়, পারে৷ কিন্তু অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী তা সম্ভব নয়৷ কারণ, সুনির্দিষ্ট সম্পদের ভিত্তিতে টাকা ছাপাতে হয়৷ অন্যথায়, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে৷ একই রকম সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল জিম্বাবোয়ে৷ দেশটি মিলিয়ন ডলারের নোট ছাপিয়েও সংকটের মোকাবিলা করতে পারেনি৷ আপাতত শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার (রেমিট্যান্স) মাধ্যমে অর্জিত ডলারের মাধ্যমে অর্থনীতির এই সংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে৷ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়৷ কারণ, মুদ্রাপাচার যে গতিতে হচ্ছে, সে হারে রেমিট্যান্স আসছে না৷ বাংলাদেশের চলতি হিসাবের গতিপ্রকৃতি দেখলে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়৷ চলমান অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭.০৬–৭.০৭ বিলিয়ন ডলার৷ এটা ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঘাটতি৷ ‘চলতি হিসাব’ হচ্ছে একটি দেশ থেকে বৈধপথে ব্যবসা–বাণিজ্যের মাধ্যমে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এল এবং গেল তার ফলাফলের সূচক৷ এই ধরনের রেকর্ড ঘাটতি আগে কখনওই বাংলাদেশ মোকাবিলা করেনি৷
অর্থনীতির এই পুরো পরিস্থিতিকে কেউ বলছেন টাইম বোমা, কেউ বলছেন ভূমিকম্পের পূর্বাভাস৷ নাম যাই দেওয়া হোক, সংকট চূড়ান্ত রূপ নিলে তার ফলাফল কী হতে পারে সেটা প্রতিটি সচেতন মানুষকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে৷ (বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র মুখপত্র ‘সাম্যবাদ’ থেকে পুনর্মুদ্রিত)
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)