বাংলাদেশঃ  রচিত হল বীরত্বের অবিস্মরণীয় জয়গাথা

স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করল বাংলাদেশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাঁরা অকাতরে রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন আন্দোলনের ময়দানে। সারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের দুহাত বাড়িয়ে সাহায্য করেছেন, সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই আন্দোলন জনগণের অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভের লাভা উদগীরণের পথ খুলে দিয়েছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়ে এ জন্যই তা পৌঁছে গিয়েছিল– ‘স্বৈরাচার গদি ছাড়ো’ দাবিতে। এই আন্দোলনে মানুষের আকাঙক্ষা আর প্রকৃত পাওয়ার মিল কতটা ঘটবে, সে হিসাব আগামী দিনে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ তথা সাধারণ মানুষের এই রক্তঢালা ইতিহাসের অধ্যায়কে মুছে দেওয়ার, তাকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা যারা করবে তাদের ক্ষমা করবে না দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ।

বুক চিতিয়ে পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। জীবন দিয়ে আন্দোলনের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন একাধিক স্কলারশিপ পাওয়া ইংরাজি বিভাগের এই মেধাবী ছাত্র। আন্দোলনের ময়দানে যাওয়ার আগে ১৯৬৯ সালের পাক-বিরোধী গণআন্দোলনের এক মৃত্যুঞ্জয়ী শহিদ শিক্ষক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট করেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন–‘‘স্যার, এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার। আপনার সমসাময়িক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই মারা গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। … এই প্রজন্মের যাঁরা আছেন, যতদিন বেঁচে আছেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসাবে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। … আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।’’

বাংলাদেশে চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সামিল এক ছাত্রী বলেছেন– ‘‘আজ যদি শহিদ হই তবে আমার নিথর দেহটা রাজপথে ফেলে রাখবেন। ছাত্রসমাজ যখন বিজয় মিছিল নিয়ে রুমে ফিরবে তখন আমাকেও বিজয়ী ঘোষণা করে দাফন করবেন। একজন পরাজিতের লাশ কখনও তার মা-বাবা গ্রহণ করবেন না।’’ আজ বিজয়ের সামনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে চোখের জলে যেন সামনের রাস্তাটা ঝাপসা না হয়, শোষিত মানুষকে যে যেতে হবে আরও অনেক দূর! এই সংগ্রামী চেতনা নতুন সমাজের পথ দেখানোর আলোক শিখায় পরিণত হলেই তো তাঁর বেদিতে দেওয়া ফুল সার্থক হবে!

চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের ছাত্র ফয়সল আহমেদ শান্ত, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ওয়াসিম আকরুম, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের মীর মুগ্ধ, মাদারিপুর সরকারি কলেজের ছাত্র দীপ্ত দে, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুদ্র সেন, মানারাত ইন্টারন্যাশানাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র শাকিল পারভেজ সহ আরও অনেক মেধাবী ছাত্র বাংলাদেশের এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পতাকা হাতে শহিদ হয়েছেন। ‘৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদ রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার-শফিউরের মতো এঁরাও যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবেন। আবারও প্রমাণ হল– শহিদের উত্তরাধিকার আজও বহতা নদীর মতো ভাসিয়ে চলেছে, জাগিয়ে তুলছে দেশকে।

ছাত্রদের পাশাপাশি এই লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন ছাত্রীরাও। তাঁরাও পথে নেমেছেন হাজারে হাজারে। পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলন আটকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে দিলে তাঁরা সেই গেট ভেঙে ফেলেছেন। বাংলাদেশেরপ্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের বোরখা, হিজাবের আবরণে ঢেকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েরা দলে দলে সেই বাধা উপেক্ষা করে মধ্য রাতেও মিছিল করেছেন। তারা স্লোগান দিয়েছে– আপস, না সংগ্রাম?– সমস্বরে হাজার কণ্ঠের সাড়া–‘সংগ্রাম, সংগ্রাম’! দালালি, না রাজপথ?– রাজপথ, রাজপথ!

অভিভাবকরাও কি কম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন! তাঁরা কেউ পিছন থেকে, কেউ সামনে থেকে আন্দোলন সমর্থন করেছেন। অনেকে রান্না করা খাবার, পানীয় জল নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে। এক ছাত্রী লিখেছেন, ‘‘আম্মুকে ধমক দিয়ে আব্বু বলল, রাস্তায় যারা নেমেছে তারাও কারও না কারও সন্তান, কলিজার টুকরা, সবাই ঘরে বসে থাকলে স্টুডেন্ট পাওয়ার টিকবে কী ভাবে? এরপরেই আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘বাবা এগারোটা বেজে গেছে, বের হয়ে পড়ো এ বার। বাসায় ফেরার পর কপালের পতাকাটা খোলার সময় আব্বু হাসিমুখে বলল, আগেই খুইলো না, তোমার আম্মুরে একটু দেখাই’!’

এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সব স্তরের জনগণ, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ। রিকশা-চালকেরা রিকশা নিয়ে মিছিল করেছেন। আহতদের বিনা পারিশ্রমিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। ফল-বিক্রেতারা ফল তুলে দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে। ছোট দোকানদারও পানীয় জলের বোতল নিয়ে এসেছেন। ছোট্ট শিশুরাও জলের বোতলে জল ভরে নিয়ে এসেছে ভাইয়া-আপুদের জন্যে। গণআন্দোলনের উত্তাপ মানুষকে এভাবেই পাল্টে দেয়। শিক্ষক, শিক্ষিকা, অধ্যাপক, জাতীয় স্তরের শিল্পীদলসকলেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় নেমেছেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

এই আন্দোলনে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রথম দফার আন্দোলনেই সরকারি বা বেসরকারি সূত্র মৃত্যুর সংখ্যা কেউ বলেছে ২১০, কেউ ৩০০। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আহতের সংখ্যা কুড়ি হাজারের ওপরে। দ্বিতীয় দফার আন্দোলনে প্রথম দিনেই মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়েছে। পুলিশের গুলিতে চার জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এই মৃত্যু ছাপিয়ে যে বীরত্বের জয়গাথা লেখা হয়েছে তা অবিস্মরণীয়। এত প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-যুবকেরা তাদের মূল দাবি কিছুটা হলেও আদায় করতে পেরেছে। যদিও রাষ্ট্রশক্তি চাইবে সংগ্রামী চেতনাকে ঘুম পাড়াতে। আন্দোলনের মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে শাসক শ্রেণির পক্ষের শক্তিকেই ক্ষমতায় বসাতে। এই আন্দোলন শিক্ষা দিয়ে গেল হাজারো প্রতিবন্ধকতা, পুলিশি বর্বরতা, সাম্প্রদায়িক বিভেদের কুটিল ষড়যন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদেরপ্রভাব কোনও কিছুই ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রুখে দিতে পারে না। শেষপর্যন্ত তার জয় হবেই।

আন্দোলন জন্ম দিয়েছে অনেক সংগ্রামী সঙ্গীতের। জন্ম নিয়েছে অনেক কবিতা। সেই সঙ্গীত বা কবিতা আগামী দিনের গণআন্দোলনে মানুষকে উজ্জীবিত করবে। এমনই একটি গান– ‘আয় তারুণ্য আয়“আয় অগ্নিগিরির লাভার মতো উদগীরিত হই“দুঃখ-শোকের মাঝে চির উজ্জীবিত রই“দু’কূল ভাঙা ঝড়ের মতো নৃত্য তুলে পায়“আয় তারুণ্য আয়।’

পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস আওয়ামি লিগের সংসদীয় বিরোধী দল, পুঁজিপতি শ্রেণির অপর বিশ্বস্ত সেবক বিএনপি বা তাদের ছাত্রদল বাংলাদেশের এই উত্তাল গণআন্দোলনকে পুঁজি করতে চেয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবাদী জামাত ও তার ছাত্র শিবিরও এই আন্দোলনে ঢুকতে চেয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকেছে মূলত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্বের হাতেই। বাংলাদেশের হাসিনা সরকার বোঝাতে চেয়েছিল যেন ছাত্ররা নয়, বিএনপি-জামাতই এই আন্দোলনটা করেছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে দেখিয়ে সরকার আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসবাদী বলেছে। সব দেশের শাসকরাই এমন কাজ করে। যেমন দিল্লি সীমান্তে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনকে বদনাম করতে বিজেপি সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি বলে দাগিয়ে দিয়েছিল। নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে মাওবাদীদের কাজ বলে দেখাতে চেয়েছিলেন তৎকালীন সিপিএম সরকারের নেতারা।

‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ মূলত ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের নেতাদের আন্দোলনে প্রবেশ করতে দেয়নি। শহিদদের পরিচয় দেখলেই বোঝা যাবে তাদের নব্বই শতাংশই বিএনপি কিংবা জামাতের মৌলবাদী রাজনীতির তীব্র বিরোধী। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার এই আন্দোলনকে ‘রাজাকারদের আন্দোলন’ বলে যেমন দাগিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করেছে। পুঁজিপতি শ্রেণি পরিচালিত রাষ্ট্রও আন্দোলনের রাশ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাত থেকে ছিনিয়ে সংসদীয় রাজনৈতিক বিরোধীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার মন্তব্যের বিরোধিতা করে এই আন্দোলন থেকে স্লোগান উঠেছিল– ‘তুমি কে, আমি কে?– রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে?– স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ অর্থাৎ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারই ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকার’ বলে বদনাম করতে চেয়েছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আহত ছাত্র বলেছে, ‘আমরা কুখ্যাত রাজাকার নই, আমরা রাজাকার কেন হব’? তাই রাজপথ স্লোগানে মুখর– ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।

বাংলাদেশের পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস আওয়ামি লিগ সরকারের আমলে ভয়াবহ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের যে কোনও প্রতিবাদের ওপর নৃশংস আক্রমণ মানুষের ধৈর্যকে শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। এবারের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাই সর্বস্তরের মানুষের বাঁচার দাবি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এ জন্যই× আন্দোলন এত তীব্র হয়েছে। আওয়ামি লিগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আবেগকে নিজেদের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সেদিন মানুষ গান গেয়েছিল– ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা তাদের এই ঋণ কোনও দিন শোধ হবে না।’ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন রূপায়িত হয়নি। যেভাবে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের একের পর এক হত্যা করা হয়েছে, যে ভাবে হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হয়েছে– সেটা আয়ুব খানের স্বৈরশাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই আন্দোলন গোটা দুনিয়ার সামনে হাসিনা সরকারের তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট রূপ উদঘাটিত করে দিয়েছে।

এত বড় একটি আন্দোলন, এত প্রাণের কোরবানি– কিন্তু তা অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে যে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটি’ তার বয়স এক মাসের সামান্য বেশি। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়করা হয় শহিদের় মৃত্যুবরণ করেছেন, নয়তো গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হতেও দেখা গেছে, সে দেশের সংস্কারবাদী বামপন্থীরা এই জনজোয়ারে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ কেউ আবার হাসিনা সরকারের পক্ষেই কার্যত ভূমিকা নিয়েছেন। যার সুযোগ নিয়েছে দক্ষিণপন্থী শক্তি। অন্য দিকে বিপ্লবী বামপন্থার যে ধারা সে দেশে আছে, তাঁরা আন্দোলনে সর্বতোভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছেন। আন্দোলনের মধ্যে যতটা সম্ভব বামপন্থী লাইনকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।

আন্দোলনকারীদের রক্তিম অভিবাদন, শহিদদের সংগ্রামী লাল সেলাম। যদিও, মনে রাখতে হবে, একটি আন্দোলন যদি সংগঠিত না হয়, যদি নেতৃত্ববিহীন হয়, স্বতঃস্ফূর্ত হয়, যদি সেই আন্দোলনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণের ঐকমত্য না গড়ে ওঠে, সর্বোপরি একটি সঠিক রাজনৈতিক আদর্শ ও শক্তি দ্বারা সেই আন্দোলন পরিচালিত না হয়, তবে যত প্রাণ বলিদানই হোক কখনওই সেই আন্দোলন মানুষের শোষণমুক্তির লক্ষে্য পৌঁছতে পারে না। তখন রং পাল্টেশোষকরাই ফিরে আসে, শত কোরবানিও বিফলে যায়। আজ আন্দোলনের জয়ের মুখে সেনাপ্রধান বৈঠক করছেন বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। যারা আওয়ামি লিগের মতোই দেশি-বিদেশি শোষক পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি। এই বৈঠকে নেতৃত্বকারী ছাত্র সমাজ ও শোষিত জনগণের প্রতিনিধিত্ব কোথায়!

এ যুগের মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ আন্দোলনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘সংগ্রাম আপনাদের করতেই হবে। এমন কথা নয় যে আপনারা লড়বেন না, পেট বড় বালাই। আজ যদি ভাবেনও যে, লড়াই করে কিছু হবে না– দু’দিন বাদেই আবার লড়াইয়ের ময়দানে নামতে আপনাদের হবেই। … হাজার হাজার লোক মাঠে-ময়দানে আসবেন, লড়াই শুরু করবেন, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হবে না। অবস্থা পরিবর্তন করতে গেলে দরকার সেই তিনটি জিনিস– সঠিক মূল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব এবং সঠিক বিপ্লবী পার্টি। এ যদি না থাকে, রাস্তা যদি ভুল হয়, তা হলে সততা, কোরবানি, সংগ্রাম– কোনও কিছুর দ্বারাই আপনারা সামনের দিকে এগোতে পারবেন না’’ (শ্রমিকের কাছে সর্বহারা রুচি-সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবেঃ শিবদাস ঘোষ)। সকল দেশের গণআন্দোলনের সামনে এ এক মূল্যবান পথনির্দেশ।

আন্দোলনকারী ছাত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে — বাসদ (মার্ক্সবাদী)

‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী)-র সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা ৫ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আজ এই বিজয়ের ক্ষণে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই আন্দোলনে শহিদ হওয়া শত শত বীরদের। এ দেশের ছাত্রসমাজ ও জনগণের হৃদয়ে তাঁরা বছর বছর ধরে বেঁচে থাকবেন।

ছাত্ররা এই আন্দোলন শুরু করেছিল, এক পর্যায়ে তাতে যুক্ত হয় সর্বস্তরের জনগণ। ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। জুলুম-নির্যাতন আর একের পর এক প্রাণত্যাগের মধ্য দিয়েশেখ হাসিনার পতন ঘটে।

এই সময়ে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে মনে করি, আন্দোলনকারী ছাত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সাথে আলোচনা ছাড়া কোনও রকম সরকার গঠন হতে পারে না। বিগত সময়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তির সাথে সমঝোতা করে সরকার গঠনের নজির আমরা দেখেছি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এই কাজ করলে আত্মদানকারী শহিদদের অবমূল্যায়ন করা হবে, আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে।

এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে, আহতদের রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা করবে, সকল গুম হওয়া মৃতদেহ তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেবে, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করবে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেবে।

এ সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে, এ কাজ আন্দোলনকারীরা করছেন না, করছে সুযোগসন্ধানীরা। আন্দোলনকারীরা শহিদ আবু সাঈদের মতো অসংখ্য শহিদের নৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করার জন্য আন্দোলনে নেমেছে। তারা এই ধরণের যে কোনও কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করবে। সংখ্যালঘুদের ও সাধারণ মানুষের বাসাবাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রক্ষা করার দায়িত্ব তাদেরই। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও তাদের এই আহ্বান জানিয়েছেন। এই সময়ে সদা সতর্ক থেকে সাধারণ জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা তাদের আহ্বান জানাই।