প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর অর্থমন্ত্রী বাজেটে বিতরণ করেছেন ‘অমৃতকালের’ বাণী–দেশের নাগরিকদের জন্য তাঁদের নিদান ২৫ বছর পরের সুদিনের আশায় বুক বাঁধুন। ঠিকসেই সময় এ দেশের নাগরিকরা অভাব আর ঋণের জ্বালায় সপরিবারে বিষ পান করে জীবন জ্বালা জুড়োচ্ছেন। সুইসাইড নোটে তাঁরা দায়ী করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীকে আর তাঁর সরকারের নীতিকে। চাষি থেকে শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে হকার, খেটে খাওয়া সর্বস্তরের মানুষের জীবনের চিত্রটা আজ এতই মলিন যে, নিরুপায় হয়ে প্রতি ঘন্টায় অন্তত একজন ভারতীয় নাগরিক নিজের জীবনকে নিজেই শেষ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
যদিও তাতে এ দেশের শাসকদের কবেই বা কিছু এসে গেছে! মানুষকে বাঁচার অধিকার আদায় করতে হলে নিতে হবে যে পথ, তা নতুন করে তুলে ধরেছে সদ্য বিজয়ী কৃষক আন্দোলন। ৭০০ শহিদের জীবনদান উদ্ধত শাসককে বাধ্য করেছে মাথা নত করতে। গণআন্দোলনই যে দাবি আদায়ের পথ–তা বার বার তুলে ধরেছে এস ইউ সি আই (সি)। তাই এই দল যখন ডাক দিয়েছে–২২ মার্চ কলকাতা এবং শিলিগুড়ির রাজপথে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিলের, ডাক দিয়েছে–২৮-২৯ মার্চ দেশজুড়ে ট্রেড ইউনিয়গুলির ডাকে সাধারণ ধর্মঘট সফল করার, রাজ্য জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় চলছে প্রচার, গড়ে উঠছে প্রস্তুতি।
বেকারত্বের হার করোনার আগেই ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে। নিয়মিত মাইনের চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছেন আড়াই কোটি কর্মচারী। অসংগঠিত ক্ষেত্রে তা যে আরও বহুকোটি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিএমআইই সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৬৩ শতাংশেরই কোনও রোজগার নেই। নতুন শ্রমকোড এনে কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিকের স্থায়ী কাজের অধিকার, নির্দিষ্ট বেতনের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বাজেট অধিবেশনে সংসদে দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছেন, কর্মসংস্থানের দায় আর সরকারের নয়। তিনি যুবকদের ‘কৌশল’ শিখে নিজেদেরই কাজ সৃষ্টি করার অমৃতবাণী শুনিয়েছেন।
পূর্বতন কংগ্রেস শাসনের কায়দাতেই জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা রেল-ব্যাঙ্ক-বিমা, বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ সহ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে নামমাত্র মূল্যে বেচে দেওয়া হচ্ছে আদানি, আম্বানি, টাটাদের মতো দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে। যাদের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিতে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হচ্ছে, তাদের হাতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে উপহার হিসেবে তুলে দিচ্ছে কেন্দে্রর বিজেপি সরকার। সাধারণ আমানতকারীদের নিরাপত্তা বিপন্ন। বিজেপি-আরএসএস, কংগ্রেস কিংবা অন্যান্য শাসক দল সকলেই বোঝাতে চায় তথাকথিত আর্থিক সংস্কার, বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ মানেই নাকি উন্নয়ন। এই উন্নয়ন কার? জনগণের না একচেটিয়া মালিকদের? উত্তরটা স্পষ্ট হয়ে যায় দেশের সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্দশা আর একচেটিয়া মালিকদের আকাশছোঁয়া সম্পদবৃদ্ধি দেখলেই।
যখন সরকারি অবহেলা, অব্যবস্থা আর অপদার্থতার কারণে করোনা মহামারি কেড়েছে সাড়ে ৫ লক্ষ ভারতীয় নাগরিকের় প্রাণ। বিনা চিকিৎসায় মৃত শত শত মানুষের লাশ ভেসেছে গঙ্গায়। ঠিক সেই সময় সরকারের মালিক তোষণকারী নীতিতে ১৪২ জন ধনকুবেরের সিন্দুকে সম্পদ উপচে পড়েছে, আর ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ভারতবাসী নতুন করে তলিয়ে গেছে দারিদ্র সীমার নীচে। মাত্র ৯৮ জন ধনকুবের় যত সম্পদ লুটেছে, তা সাড়ে ৫৫ কোটি ভারতবাসীর মোট সম্পদের সমান।
সাধারণ মানুষের প্রাপ্তি হল সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। তেল, গ্যাস, কোরোসিন, বিদ্যুতের দাম বাড়তে বাড়তে সাধারণের নাগালের বাইরে। তেল-গ্যাসে ভর্তুকি বন্ধ। এদিকে কৃষিক্ষেত্রকে দেশি বিদেশি একচেটিয়া মালিকদের হাতে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার অভিসন্ধি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার এনেছিল তিনটি নতুন কৃষি আইন। কৃষকদের দৃঢ় প্রতিরোধে সরকার তা বাতিল করতে বাধ্য হলেও, ঘুরপথে তারা এই মতলব হাসিলের চেষ্টাই চালাচ্ছে।
অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সচেতন হতে পারে, শাসকের কৌশলকে ধরতে পারে এবং রুখে দাঁড়াতে পারে যে হাতিয়ার নিয়ে, তার নাম শিক্ষা। তাই সব সরকারই শিক্ষা ক্ষেত্রে আঘাত হানে। সরকারের ইচ্ছা দেশে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক, ধর্মরিপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শিক্ষার বালাই যেন না থাকে। শিক্ষার নামে তারা চায় কাজ চালানোর মতো একদল অর্ধশিক্ষিত কর্মীবাহিনী এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ কিছু টেকনোক্র্যাট ও ম্যানেজমেন্টে দক্ষ আমলা তৈরি করতে। এই লক্ষ্য থেকেই বিজেপি সরকার এনেছে জাতীয় শিক্ষনীতি-২০২০। যা চালু হলে শিক্ষা পুরোপুরি হবে বেচাকেনার সামগ্রী। এর সাথে শিক্ষায় ঢোকানো হচ্ছে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা। এগুলোই নাকি ভারতীয় ঐতিহ্য! কল্পিত কাহিনী, রূপককে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান’ বলে। চিকিৎসাশাস্তে্রর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে আঘাত করে সেখানেও তোলা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের জিগির। কেন্দ্র, রাজ্য সব সরকারই ডিজিটাল শিক্ষাকেই প্রধান করার ধুয়ো তুলে গরিব ঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা থেকে ছেঁটে ফেলছে। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে তারা চাইছে শিক্ষক-ছাত্র আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃত শিক্ষার সুযোগকেই মেরে দিয়ে শিক্ষাকে যান্ত্রিক তথ্যে পরিণত করতে।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি অফিসে কিংবা স্কুলে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহ সরকারের সব দপ্তরে লক্ষাধিক স্থায়ী পদ খালি। অথচ বেশিরভাগ কাজ চলছে কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী দিয়ে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হাইকোর্টে এসএসসি চেয়ারম্যানকে ভৎর্সনা শুনতে হয়, বহু শিক্ষকের নিয়োগও আদালত বাতিল করে দেয়। পূর্বসূরি কংগ্রেস, সিপিএমকে অনুসরণ করে তৃণমূল সরকার দুর্নীতি, তোলাবাজি, স্বজনপোষণ, দলবাজি, প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করার কাজ নগ্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। মদ্যপদের অত্যাচার পাড়ায় পাড়ায় লাগামছাড়া, মদ্যপ গাড়ি চালকদের জন্য রোজ পথচারীর প্রাণ যাচ্ছে। অথচ মদের প্রসারে রাজ্য সরকার কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা একেবারে ‘দুয়ারে মদ’ নিয়ে হাজির! এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন রাজ্যের ছাত্র-যুব-মহিলারা।
তৃণমূল সরকার সিপিএমের কায়দাতেই বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামিতে পুনর্বাসন ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের আগেই চোখ রাঙিয়ে জমি দখলে উদ্যত। কয়লার দাম সহ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নানা পর্যায়ে খরচ কমায় বিদ্যুতের দাম এখনই কমে অর্ধেক হওয়া উচিত। কিন্তু বিদ্যুৎ কোম্পানির বিপুল লাভের স্বার্থে সরকার সে দাবিতে কান দিচ্ছে না।
রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে ২৮৩টি ওষুধ ছাঁটাই হয়েছে। সরকার স্বাস্থ্যসাথীর নামে একদিকে চিকিৎসাকে বিমা নির্ভর করে দিয়ে নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। অন্যদিকে পিপিপি মডেলে সরকারি হাসপাতালেই বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে। করোনাকে অজুহাত করে স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ রেখে রাজ্য সরকার ডিজিটাল শিক্ষার কোম্পানিগুলিকে বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন তারা সরকারি স্কুলগুলিকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। যে পরিকল্পনা ফাঁস হতেই প্রতিবাদে রাস্তয় নেমেছে এসইউসিআই(সি)।
আশাকর্মী, পৌরস্বাস্থ্যকর্মী, আইসিডিএসকর্মী, মোটরভ্যান চালক, শিক্ষক, ছাত্র, যুব, মহিলা, চাকুরিজীবী এবং শ্রমিক, কৃষক সহ সর্বস্তরের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের যন্ত্রণা আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে তাঁরা সকলেই চাইছেন প্রতিবাদ হোক। এই আকাঙক্ষাকে রূপ দিয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলছে এসইউসিআই(সি)।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে কখনও সে আন্দোলন রাস্তার অবরোধে, বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে ফেটে পড়ে। কখনও তা পাড়ায়, কর্মক্ষেত্রে বিশেষ দাবি নিয়ে গণকমিটিগুলিকে সংগঠিত করতে করতে শক্তি অর্জন করে মানুষের আন্দোলন হিসাবে। যার খবর কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম সহজে দেয় না। কিন্তু আন্দোলন চলতেই থাকে। ভোটের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে কিছু হইচই করে প্রচার পাওয়া নয়, সঠিক রাজনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত দীর্ঘস্থায়ী সুসংগঠিত এ আন্দোলনের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত শোষণের শৃঙ্খল উচ্ছেদের পথে জনগণকে সংগঠিত করা।
২২ মার্চ লাগাতার গণআন্দোলনের একটা পর্যায় সূচিত করতে চলেছে। গ্রাম, শহর, গঞ্জ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র আন্দোলনের কমিটি গড়ে তোলার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন মানুষ।