কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করেছেন ২৩ জুলাই। বিজেপি সরকার সগর্বে ঘোষণা করেছে এ বছরের স্বাস্থ্য বাজেটে গতবারের তুলনায় ১২.৫৬ শতাংশ বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে এবং তা জিডিপির ২.৫ শতাংশ। অর্থাৎ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির ২০১৭-র ঘোষণা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা তারা পূরণ করে ফেলেছে।
এ বছরের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ কত? বলা হচ্ছে, ৯০ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৩৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে গবেষণার জন্য। তা হলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হল ৮৭,৫৬৫ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ১২.৯ শতাংশ এবং জিডিপি-র ১.৯ শতাংশ। তা হলে স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির ২.৫ শতাংশ হয়, কোন অঙ্কের নিয়মে? বাস্তবে যা ০.২৭ শতাংশ এবং তা গতবারের (০.৩৫ শতাংশ) চেয়েও অনেক কম।
প্রাথমিকভাবে এ বছর বরাদ্দ কত ধরা হয়েছিল? ১,০৯,৫৬৮ কোটি টাকা। বাস্তবে খরচ হবে কত? উত্তর কারও জানা নেই। কারণ প্রতি বছরেই স্বাস্থ্যখাতে প্রাথমিক বরাদ্দ কমতে কমতে একটা বিরাট অঙ্কের টাকাই উধাও হয়ে যায়। যেমন গত বছর প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ থেকে প্রকৃত বরাদ্দ করা হয়েছিল ১,০৪, ৬৭৮ কোটি টাকা। তা ক্রমশ কমতে কমতে প্রকৃত বাজেট এসে দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যেও চুরি দুর্নীতি অপচয়ের একটি বিরাট অঙ্ক রয়েছে। তার কোনও হিসাব থাকে না। আর গতবারের স্বাস্থ্য বাজেটের এই টাকার অঙ্কটাকেই ধরে মোদি সরকার তারস্বরে চিৎকার করে বলছে, স্বাস্থ্য খাতে এ বছর ১২.৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অর্থাৎ দাবির মধ্যে চালাকি রয়েছে। গত বছরেও তারা এ রকমই বৃদ্ধির কথা বলেছিল। কিন্তু ওই বলাই সার। প্রকৃত খরচ প্রতিবারই একই রকম ভাবে কমানো হয়। যেমন গতবার কমানো হয়েছিল ২৭,২২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২৬ শতাংশ। গতবার প্রাথমিক বাজেটকে ধরে দেখানো হয়েছিল তারা জিডিপির ২.১ শতাংশ বরাদ্দ করেছে। পরে সমীক্ষায় উঠে আসে গত বছরের স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃতপক্ষে যা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা আসলে জিডিপির ০.৩৫ শতাংশ মাত্র। এ বারে তারা আবার এক ধাপ এগিয়ে বলছে জিডিপির ২.৫ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ করেছে। আবার বলা হচ্ছে, এ বছর জিডিপি বেড়েছে ৬.৮ শতাংশ। তা হলে এই বর্ধিত টাকার একটা অংশও কি স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা যেত না?
এ বার দেখা যাক বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্বাস্থ্যখাতে কেমন বরাদ্দ? যেমন আমেরিকা ১৬.৬ শতাংশ, ব্রিটেন খরচ করে ১১.৩ শতাংশ, উত্তর কোরিয়া ৯.৭ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৪.৫৯ শতাংশ, এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো দেশ খরচ করে ৪.০৭ শতাংশ। তবে কি ভারতবর্ষের সরকার এ দেশের মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করে না, নাকি স্বাস্থ্য নিয়ে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুণ্ঠনের ক্ষেত্র আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে তারা? ভেবে দেখা দরকার।
সরকারের নীতি আয়োগের রিপোর্ট বলছে এ দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা করাতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েন ১০ কোটির বেশি মানুষ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষের পকেট থেকে খরচ হয় ৪৭.১ শতাংশ টাকা। যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। যদিও এর মধ্যে বহু খরচই ধরা নেই। যেমন চিকিৎসা পেতে দালাল চক্রকে কত টাকা দিতে হয়। আয়ুষ্মান ভারত, স্বাস্থ্যসাথীর মতো বিমা প্রকল্পে চিকিৎসা পেতে নার্সিংহোমগুলোকে প্যাকেজের বাইরে, বিনা রসিদে বিপুল পরিমাণ টাকা মানুষকে দিতে হয়। এ রকমই অনেক অদৃশ্য ভুতুড়ে খরচ হয়, যার কোনও হিসাবই থাকে না। ফলে সবটা ধরলে মানুষের পকেটের খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ ছাড়াবে। যে ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ৪৭ শতাংশ পরিবার ক্যাটাস্ট্রফিক শকে চলে যায় অর্থাৎ তারা চিকিৎসার খরচ মেটানোর পরে আর সংসার চালাতে পারে না। সেখানে এই সামান্য বরাদ্দে চিকিৎসা চলে? আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই বাজারে ভারতের মতো জনকল্যাণমূলক এই রাষ্ট্রে স্বাস্থে্যর জন্য ব্যয়বরাদ্দ কি বাড়ানো যেত না? বাজেটের এই টাকা তো আসে জনগণের দেওয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ট্যাক্সের টাকা থেকেই। এখানে সরকার এত কৃপণ কেন? দেখা যাক সরকার এ বছরের সামগ্রিক বাজেটের কত শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করেছে, মাত্র–১.৮১ শতাংশ। কমতে কমতে বছর শেষে তা ১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
যতটুকু বরাদ্দ হয়েছে, তার মধ্যেও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) নীতিতে চলা কর্মসূচিগুলোতেই বেশি বাড়ানো হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেশিরভাগ অংশ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ নীতিতে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে। সুতরাং যে প্রকল্প বা স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলি সরকার প্রত্যক্ষভাবে নিজে চালায়, সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো হল না। আবার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানা প্রশাসনিক জটিলতা, পরিকাঠামোর অভাব এবং সদিচ্ছার অভাব এবং কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বন্দে্বর ফলে প্রতি বছরই এইসব খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা বিরাট অংশই অব্যবহৃত থাকে।
যেমন গত বছর জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৬৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ১৫০০ কোটি টাকা। যে টাকার মধ্যে জেলা স্তরের মেডিকেল, নার্সিং-প্যারামেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে উন্নত করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে উন্নত হতে পারল না, কারণ বরাদ্দকৃত যৎসামান্য টাকারও বেশিরভাগটা খরচই করা গেল না। ফলে আজ বর্ধিত পরিষেবা দিতে এমনকি বতর্মান পরিষেবাও চালাতে প্রশিক্ষিত ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। দ্বিতীয়ত, কোভিডের অতিমারির ভয়ঙ্কর দিকটির কথা মাথায় রেখে যেখানে সংক্রামক ব্যাধির জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল এবং গত বছরের বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা ছিল জরুরি, তার একাংশও খরচ হয়নি। আবার সেই অজুহাতে এ বছরের বাজেটও বাড়ানো যায়নি। এ ভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের বাজেট আরও কমিয়ে করা হল ৪৫০০ কোটি টাকা।
ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে দেশের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর দরকার ছিল। জনসংখ্যার নিরিখে দেশে এখনও ২৪ শতাংশ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ২৯ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দে্রর যে ঘাটতি রয়েছে সেগুলি গড়ে তোলা জরুরি ছিল। কিন্তু গত বছরের বরাদ্দকৃত যৎসামান্য বাজেটের একটা বিরাট অংশ খরচ না হওয়ার অজুহাতে এ বছর এর জন্য বরাদ্দ আরও কমিয়ে দেওয়া হল। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কী বলে? জনসেবার দৃষ্টিভঙ্গি না কি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে লাটে তোলার ব্যবস্থা?
এই বাজেটে যক্ষ্মা রোগের ওষুধ সম্পর্কেও কোনও কথা বলা হয়নি। টাকার অভাবে কেন্দ্রীয় সরকার গত মার্চ মাস থেকেই টিবির ওষুুধ বন্ধ করে দিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে ওষুধ অনিয়মিত সরবরাহ বা সরবরাহ একেবারেই বন্ধ থাকার দরুন ইতিমধ্যেই মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর সংখ্যা ভীষণ ভাবে বাড়ছে। মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যেই টিবি-মুক্ত ভারতের ঘোষণা করে দিয়েই ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। তাই এই বাজেটে টিবির ওষুধ নিয়ে কোনও কথা নেই। কতটা অমানবিক, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অপদার্থ সরকার হলে মানুষকে এ ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায়!
কেন্দ্রীয় তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১৭ অনুযায়ী সরকার জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী তথা কর্পোরেট সেক্টরের এবং বিমা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এই স্বাস্থ্য বাজেট তৈরি করেছে। সেখানে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের অবাধ অনুপ্রবেশকে আহ্বান জানানো হয়েছে। তার গালভরা নাম দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট সোসাল রেসপনসিবিলিটি। অর্থাৎ কর্পোরেট সেক্টরের যে সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে তা অন্য কোথাও প্রয়োগ না করলেও এ বার থেকে তারা সেই দায়বদ্ধতা সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দেখাবে। অর্থাৎ এই সুযোগে তারা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ নীতিতে বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার সুযোগ পেল। আর এই টাকা বিনিয়োগের পরিণাম কী হবে তা সকলেই জানেন। পিপিপি নীতিতে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা যে মুনাফা তুলছে, এ তার সর্বোচ্চ সীমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি হাসপাতালগুলোকে এই পদ্ধতিতে কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া এ বার সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ইতিমধ্যেই যেভাবে সরকার রেল, বিমানবন্দর ইত্যাদি কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে এরও পরিণতি তাই ঘটবে।
সরকার ফলাও করে প্রচার করছে, ৩টি ক্যান্সারের ওষুধের থেকে তারা কাস্টমস ডিউটি তুলে নিয়েছে। কিন্তু এটা বলছে না, ইতিমধ্যে কাস্টমস ডিউটি চালু করার ফলে সমস্ত ওষুধেরই বাজারমূল্য কী ভাবে আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে। একদিকে ওষুধের সরকারি সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া অন্য দিকে কাস্টমস ডিউটি সহ, জিএসটি এবং নানা ধরনের ট্যাক্স বসানোর ফলে ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে। ফলে বহু মানুষ বিনা ওষুধে, বিনা চিকিৎসায় মরতে বাধ্য হচ্ছে। ওষুধের দাম কমানোর কোনও পদক্ষেপ বা কোনও প্রস্তাব এই বাজেটে নেই। যেখানে মানুষের মোট চিকিৎসা খরচের ৮০ শতাংশের উপরেই হয় ওষুধ বাবদ। এই হল মোদির ৩টি ক্যান্সারের ওষুধের উপর থেকে কাস্টমস ডিউটি ছাড় দেওয়ার নেপথ্য কাহিনি।
স্বাস্থ্য বাজেট আসলে কিছু সংখ্যাতত্ত্বের কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। ইতিমধ্যেই টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে তাকে হিসেবে ধরলে এ বারের বাজেট কমানোর ক্ষেত্রে অতীতের সমস্ত নজিরকেই ছাড়িয়ে গেছে। এখন মানুষকে বাঁচাতে হলে লাগাতার দীর্ঘস্থায়ী জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া পথ নেই।