করোনা অতিমারির সুযোগ নিয়ে ওষুধের দাম ভয়ঙ্কর হারে বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলি। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে কমানো হয়েছে ২৮৩ রকমের ওষুধ। ২০-৩০ শতাংশ, কোনও ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ হারে জীবনদায়ী ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছে, এমনকি নিয়মিত খেতে হয় যে সমস্ত ওষুধ, সেগুলির দামও লাফিয়ে বাড়ছে। করোনায় বন্ধ হয়েছে লক্ষ লক্ষ ছোট-মাঝারি সংস্থা, কাজ চলে গেছে বহু মানুষের। তার উপর ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ আরও বিপাকে পড়েছেন।
সুষম খাদ্যের সুযোগ না পেলেও নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় বহু মানুষকে। ক্যান্সার, সুগার, প্রেসার, হার্ট, লিভার, নিউমোনিয়া, কোলেস্টরল, ইউরিন, প্রস্টেট, হাঁপানি, থাইরয়েড, অ্যালার্জি সহ নানা অসুখেই ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। এ ছাড়াও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকি গ্যাস-অ্যাসিডিটির জন্য যে ওষুধ মানুষকে খেতে হয় অহরহ, সেগুলির দামও বেড়ে চলেছে চড়া হারে। এমনকি করোনা কালে প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি-র মতো ওষুধেরও দাম বাড়ানো হয়েছে যথেচ্ছ, কোথাও কোথাও সেগুলি উধাও হয়ে যাচ্ছে বাজার থেকে। করোনার নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ না থাকলেও ডাক্তারদের পরামর্শ মতো কিছু ওষুধ সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছেন। জনসাধারণের অতিমারি আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে সে সমস্ত ওষুধের দাম এক ধাক্কায় বাড়ানো হয়েছে অনেকখানি। ওষুধের দোকানে গিয়ে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসছেন। পথ্যের জোগাড় দূরের কথা, বহু মানুষই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে ‘ভাগ্যের’ হাতে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
তাতে আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা। সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেটুকু ওষুধ পাওয়া যেত, তার মধ্যে ২৮৩ রকমের ওষুধ কমিয়ে দিয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। এতদিন পর্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ৬৪৪টি ওষুধ সরবরাহ করা হত, তা কমিয়ে ৩৬১ করা হয়েছে। তালিকা থেকে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একাধিক ওষুধ এবং একই ওষুধের বিভিন্ন মাত্রা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এসইউসিআই(সি)-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ১৬ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে দলের উদ্যোগে জেলায় জেলায় ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী-রোগীর পরিজন এবং সাধারণ মানুষকে নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! সরকার ও বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির দুষ্টচক্রের হাতে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।
ওষুধের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলিকে বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে বিজেপি সরকার, যার শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ফার্মা কোম্পানিগুলি ওষুধের দাম বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স) বেড়েছে । ৫-১২, কোথাও ১৮ শতাংশ, এমনকি ২৮-ও বেড়েছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে। তাই তাদের নাকি লাভ হচ্ছে না। বাস্তবটা হল, কোনও কোনও ওষুধে সরকার চড়া জিএসটি চাপালেও ওষুধ কোম্পানিগুলির অতি মুনাফাই এই বিরাট মূল্যবৃদ্ধির কারণ। ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি অতি চলতি কিছু ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে। তার মাশুল গুনতে হচ্ছে হতদরিদ্র মানুষকেও। এই সুযোগে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলি দু’হাতে লুটছে জনসাধারণের টাকা। তাদের মুনাফার পাহাড় বাড়ছে। প্রশ্ন হল, ওষুধের মতো জীবনদায়ী জিনিসে, এমনকি করোনা অতিমারির সময়ে এমন বেলাগাম দাম বাড়াতে পারে কী করে বিজেপি সরকার? এ থেকেই স্পষ্ট, জনসাধারণ নয়, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রতিই তাদের দায়বদ্ধতা। তাই সরকারি সংস্থাগুলিকে বঞ্চিত করে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সরকার ওষুধ তৈরির বরাত দিচ্ছে।
দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি ওষুধ সংস্থা আইডিপিএল রয়েছে হৃষিকেশ, হায়দরাবাদে এবং গুরগাঁও-এ। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এই সংস্থা একসময় অন্যান্য কোম্পানির ‘রোল-মডেল’ ছিল। পুনেতে রয়েছে ১৯৫৫-তে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুস্তান অ্যান্টিবায়োটিকস লিমিটেড (হ্যাল)। রয়েছে ১৯৪১-এ গঠিত বেঙ্গল কেমিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড (বিসিপিএল)। এগুলি সবই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থা, যেগুলির অধীনে রয়েছে নানা সাবসিডিয়ারি সংস্থা। বেসরকারি সংস্থা বেঙ্গল ইমিউনিটি লিমিটেড রুগ্ন হয়ে পড়ায় ১৯৮৪-তে কেন্দ্রীয় সরকার অধিগ্রহণ করে। এ ছাড়াও বহু বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি রুগ্ন হয়ে পড়ায় সরকার অধিগ্রহণ করেছে। সেগুলিতে ওষুধ উৎপাদন হলে খরচ কম পড়ত, মূল্যও কম হত। সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকত ওষুধের দাম। কিন্তু কর্পোরেটপ্রেমী সরকার সান ফার্মা, রেড্ডি ল্যাবরেটরি, সিপলা, টরেন্ট, অরবিন্দ, অ্যাবট, লুপিন ইত্যাদি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির লাভের সুযোগ করে দিচ্ছে। ঠিক একইরকম ভাবে সরকারি টিকা প্রস্তুতকারী ১৪টি সংস্থাকে বঞ্চিত করে মাত্র দু’টি বেসরকারি সংস্থাকে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের বরাত দিয়ে তাদের বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে। এদের সাহায্য করতে কি কংগ্রেস, কি বিজেপি সরকার তাদের ওষুধ- নীতি নির্ধারণ করছে। ওষুধের দামের উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
কর্পোরেট ওষুধ কোম্পানিগুলির মুনাফা বাড়াতে সরকারের এত তৎপরতা কেন? এই সব একচেটিয়া কোম্পানিগুলির সাথে সরকার তথা শাসক দলগুলির যে যোগসাজশ, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং লেনদেন–তারই ফল এটি। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রে পুঁজিমালিকদের নেকনজরে থাকতে পারলে তবেই সরকারে বসার সুযোগ পায় ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলি। না হলে নয়। তাই একে অপরের স্বার্থ দেখে এরা।