মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে বলিভিয়ার দক্ষিণপন্থী ধনকুবের গোষ্ঠী সেনা ও পুলিশবাহিনীর সাহায্য নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বলিভিয়ায় চতুর্থবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকে পদত্যাগে বাধ্য করল৷ ১০ নভেম্বর মোরালেস মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন৷ প্রতিবাদে উত্তপ্ত বলিভিয়ার মানুষ প্রেসিডেন্টের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে৷ তাদের উপর ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে পুলিশ ও সেনা৷ এই আক্রমণে আহত হয়েছেন অনেকে৷ মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজন বিক্ষোভকারীর৷
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় জনসংখ্যার দুই–তৃতীয়াংশ জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত৷ দরিদ্র এই মানুষগুলি দেশের অল্পসংখ্যক ধনী, দক্ষিণপন্থী শ্বেতাঙ্গদের প্রবল শোষণ–নিপীড়ন ও ঘৃণার শিকার৷ মোরালেসই বলিভিয়ায় জনজাতি গোষ্ঠী থেকে আসা প্রথম প্রেসিডেন্ট৷ ২০০৬–এর জানুয়ারিতে প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে সরকার গড়ে তাঁর বামপন্থী দল ‘মুভমেন্ট ফর সোসালিজম’ (এমএএস), যার নামের অর্থ– সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা৷ পর পর তিনবার প্রেসিডন্টে হন মোরালেস৷ গত ২০ অক্টোবরের নির্বাচনে দেশের মানুষ চতুর্থবারের জন্য তাঁকেই আবারও প্রেসিডেন্ট হিসাবে বেছে নেয়৷ সঙ্গে সঙ্গে কোনও প্রমাণ ছাড়াই ভোটে কারচুপি হয়েছে বলে প্রচারে নেমে পড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পেটোয়া ‘অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস’ (ওএএস)৷ পাশে দাঁড়ায় পুঁজিপতিদের মদতপুষ্ট বলিভিয়ার পুলিশ ও সেনাবাহিনী৷ দক্ষিণপন্থীরা মোরালেসের সমর্থক নেতাদের উপর হামলা শুরু করে, দেশ জুড়ে তাদের বাড়িঘর ও অফিসগুলিতে আগুন লাগায়৷ নেতৃত্ব দেন বলিভিয়ার অতি–দক্ষিণপন্থী নেতা ফার্নান্দো ক্যামাচো এবং ধনকুবের গোষ্ঠীর স্বার্থবাহী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেসা৷ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী পরিচালিত সংবাদমাধ্যমও এই মিথ্যাপ্রচার দুনিয়া জুড়ে ছড়াতে শুরু করে৷ দেশে শান্তি ফেরানোর আশায় মোরালেস পুনর্নিবাচনের কথা ঘোষণা করেন৷ কিন্তু তাতে নিরস্ত হয়নি ধনকুবেরদের স্বার্থবাহী বলিভিয়ার দক্ষিণপন্থীরা৷ পুলিশ–মিলিটারির সাহায্য নিয়ে তারা দেশ জুড়ে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে৷ অবশেষে পদত্যাগে বাধ্য হন মোরালেস৷ দেশ ছেড়ে মেক্সিকোয় চলে যেতে হয় তাঁকে৷
কেন মোরালেস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের চক্ষুশূল? প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গত ১৩ বছরে মোরালেস বেশ কিছু কল্যাণমূলক কর্মসূচি নেওয়ার মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের খানিকটা উন্নতি ঘটিয়েছেন৷ বলিভিয়া খনিজ সম্পদ লিথিয়ামে সমৃদ্ধ৷ ব্যাটারি ও ইলেকট্রিকচালিত গাড়িতে লিথিয়াম ব্যবহার করা হয়৷ ক্ষমতায় বসার পর মোরালেস লিথিয়ামকে কেন্দ্র করে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা লোটা অংশত রুখে দেন৷ প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন৷ দক্ষিণ আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশ যেমন ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, কিউবা ও নিকারাগুয়ার সঙ্গে একযোগে ল্যাটিন আমেরিকান সংগঠন গড়ে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাপটের বিরুদ্ধে মাথা তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন মোরালেস৷ গত কয়েক বছরে বলিভিয়ায় শিক্ষিতের হার একশো শতাংশে পৌঁছেছে, সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে এবং দেশের সংসদে মহিলা প্রতিনিধিত্ব বিপুল পরিমাণে বেড়েছে৷
প্রেসিডেন্ট মোরালেসের এইসব জনকল্যাণমূলক নীতিতে পিছিয়ে পড়া জনজাতির মানুষ সহ দেশের খেটে–খাওয়া সাধারণ মানুষের উত্থান, পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া কারবারিদের মুনাফায় টান পড়ার কারণে বলিভিয়ার বড় পুঁজিপতির দল ও বাইরের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উভয়েরই চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন মোরালেস৷ নির্বাচনের আগেই বলিভিয়ার দক্ষিণপন্থী শ্বেতাঙ্গ ধনকুবের গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে মোরালেসকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে না৷ পাশে দাঁড়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও যখন মোরালেসকে হারানো গেল না, তখন ২০ তারিখে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে পরেই দেশের পূর্ব দিকে নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকাগুলি থেকে বেরিয়ে এসে তাণ্ডব শুরু করে দক্ষিণপন্থী ঝটিকা বাহিনী৷ অভ্যুত্থানের নেতা ফার্নান্দো ক্যামাচোর নেতৃত্বে রাজধানী লা পাজের দিকে এগোতে থাকে তারা৷ রাস্তায় সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক মারধর চলে, ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রেসিডেন্টের বোনের বাড়িও এদের তাণ্ডবের শিকার হয়৷
কয়েকদিন চূড়ান্ত নৈরাজ্যের পর ১২ নভেম্বর দক্ষিণপন্থী সাংসদ জেনাইন অ্যানেজ বাইবেল হাতে নিয়ে নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন৷ এই সাংসদ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি ঘৃণার জন্য বহু আগে থেকেই নিন্দিত৷ সম্প্রতি স্বঘোষিত এই প্রেসিডেন্টের ২০১৩ সালে করা কিছু ‘টুইট’ ফাঁস হয়ে গেছে, সেইসব লেখার ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছে দেশের দরিদ্র জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণার কথা৷
এই অন্যায় মানতে রাজি নন বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ৷ প্রতিবাদে বলিভিয়ার রাস্তায় রাস্তায় প্রতিদিন এখন জনজোয়ার৷ চলছে পুলিশ ও মিলিটারির নির্মম হামলা৷ টিয়ার গ্যাস, লাঠি, গুলির সামনে বুক চিতিয়ে লড়ছেন বলিভিয়ার মানুষ৷ এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকজনের, আহত শতাধিক৷ বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ৷ দেশের শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠনগুলিও মোরালেসের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে পথে নেমেছে৷
শুধু বলিভিয়া নয়, গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষ এই জঘন্য অভ্যুত্থানের নিন্দায় সরব হয়েছে৷ অভ্যুত্থানের নিন্দা করে প্রেসিডেন্ট মোরালেসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ–কানেল, ব্রাজিলের জেল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া নেতা লুলা ডি সিলভা, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, কলম্বিয়ার রাজনৈতিক নেতা গুস্তাভো পেত্রো সহ অন্যান্য বহু দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা৷
বলিভিয়ার ঘটনা দেখিয়ে দিল, যতদিন লুটেরা সাম্রাজ্যবাদ টিকে থাকবে ততদিন পুঁজিপতিদের মুনাফা লুটের স্বার্থে এভাবেই দেশে দেশে তারা গণতন্ত্রকে পদদলিত করবে৷ এই ঘৃণ্য অভ্যুত্থানের তীব্র প্রতিবাদ করার পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে তাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় সোচ্চার হতে হবে৷