বন্যাদুর্গতদের ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়েছে যোগী সরকার বললেন দলেরই সাংসদ

যে কোনও সৎ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ মাত্রই বলে থাকেন, আর্ত, অসহায় মানুষকে সেবা করার অর্থ ভগবানের সেবা করা। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াবে মানুষ, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মের জিগির তুলে যারা রাজনীতি করে থাকেন, সেই বিজেপি নেতারা মানুষের অসহায়তাকে আদৌ অনুভব করেন কিনা, উত্তরপ্রদেশে বন্যাবিধ্বস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে সে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বিজেপিরই এক সাংসদ।

উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নাকি তাঁর রাজ্যের হাল ফিরিয়ে দিয়েছেন! তাঁর শাসনকালে উত্তরপ্রদেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে বলে দাবি তাঁর ও তাঁর দলের। উন্নয়নের কাজে কোনওরকম সরকারি গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে না বলে মাঝে মাঝেই হুঙ্কার দেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ ভয়ঙ্কর বন্যায় রাজ্যের বিরাট অংশের মানুষ যখন বিধ্বস্ত, তখন কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়াবার কথা মনে হয়নি তাঁর।

গত আগস্ট মাসের শেষ থেকে ভয়াবহ বন্যায় উত্তরপ্রদেশের ২২টি জেলার ১৬৬৭টি গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত। বহু এলাকা এখনও জলমগ্ন। সরকারি হিসাবেই ১৩ লক্ষ ৫১ হাজারের বেশি মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বেশ কয়েক জন মারা গিয়েছেন। একটানা বৃষ্টিপাত এবং বহু নদীর জলস্তর বেড়ে যাওয়ার পরিণতিতে এই বিপত্তি। গঙ্গা, যমুনা, রাপ্তি, সরযূ, রামগঙ্গা, শারদা, ঘাগরা, বুদ্ধ রাপ্তি, কুনহারা, কুওয়ানো প্রভৃতি নদীগুলি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। বন্যার প্রকোপে কয়েক লক্ষ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। খাদ্য, পানীয় জল এবং আশ্রয়ের অভাবে মানুষ অসহায় অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজ্যের বিজেপি সরকার এই ভয়াবহ বন্যার মোকাবিলা করেছে কিছু স্পিডবোট আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের কয়েক জন কর্মী দিয়ে। বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় জলযান, ফ্লাড সেন্টার, খাবার-ওষুধ-পানীয় জল সহ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের বন্যাদুর্গত মানুষদের কাছে দ্রুত পৌঁছনো দরকার ছিল, তা চূড়ান্ত অবহেলিত হয়েছে। নেতা-মন্ত্রীদের ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সরাসরি তদারকি করা জরুরি ছিল। কিন্তু তাঁরা ঠাণ্ডা ঘরে বসে কিছু শুকনো বিবৃতি দিয়ে অথবা উদ্ধারকারী দলকে নির্দেশ দিয়েই কর্তব্য পালন করেছেন। অথচ ভোটের সময় এই নেতা-মন্ত্রীদেরই প্রতিশ্রুতির উপচে পড়া ডালি নিয়ে দু’বেলা দেখতে বাধ্য হন সাধারণ মানুষ। সেই সময় হাজার হাজার কোটি টাকা ছড়াতেও তাদের কোনও অসুবিধা হয় না। স্বভাবতই, প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বন্যাবিধ্বস্ত মানুষ।

মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হেলিকপ্টারে চড়ে বন্যাপ্লাবিত কিছু এলাকা পরিদর্শন করেই দায়িত্ব সেরেছেন। তিনি এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য পার্শ্ববর্তী মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান সরকারকে দায়ী করেছেন ড্যাম থেকে জল ছাড়ার জন্য। যখন একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপে মেতে রয়েছেন নেতারা, সাধারণ মানুষ প্রকৃতির রোষের মুখে পড়ে রয়েছে অসহায় অবস্থায়। অবস্থা এমনই অসহনীয় যে, বিজেপিরই সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং যোগী সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন– রাজ্য সরকার বন্যাবিধ্বস্ত মানুষদের ‘ঈশ্বরের ভরসায়’ ছেড়ে দিয়েছে। নিজের কেন্দ্র কাইসারগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করে তিনি বলেন, ‘বন্যা মোকাবিলা ও ত্রাণের ক্ষেত্রে এমন অব্যবস্থা আগে দেখিনি।’ সরযূ নদীর উপরে সেতু ভেঙে পড়ার জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি দায়ী করেছেন।

বন্যা মোকাবিলায় বিজেপি সরকারের এত অবহেলা কেন? সরকারের, প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দপ্তরের অভাব রয়েছে, লোকবল নেই, নাকি অর্থের অভাব? সব কিছুই রয়েছে। তা সত্ত্বেও সরকারের এই দুর্বৃত্তসুলভ আচরণ, ক্ষমার অযোগ্য অবহেলার কারণ দলটির নীতিহীন রাজনীতি। মানুষের প্রতি দরদবোধের বদলে তাদের অভিধানে রয়েছে মানুষে-মানুষে ঘৃণা ছড়ানোর পাঠ, একের বিরুদ্ধে অপরের মধ্যে বিভেদের বীজ পুঁতে দেওয়ার পাঠ। তাই সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্য নেই তাদের কাছে। মানুষ যে তাদের কাছে শুধুই ভোটার তা সাম্প্রতিক বন্যায় আবার প্রমাণিত হল।

অথচ এমন বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলায় শাসক দলেরই সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল। পুলিশ-প্যারা মিলিটারি নামিয়ে, বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরকে দিয়ে অসহায় অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করা– জনদরদের ছিটেফোঁটাও সরকারি কর্তাদের না থাকায় তা হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রকৃতির হাতে ছেড়ে না দিয়ে অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এবং নদীর জলস্তর বিপদসীমার উপরে যাওয়ার সাথে সাথেই মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে আরও অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত, সম্পত্তি রক্ষা পেত। সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসাবে নদীর ধারে বেআইনি নির্মাণ, নদীর বুকে অবৈধভাবে খনন, নদীর প্রবাহপথকে ব্যবসায়িক স্বার্থে অন্যত্র সরানো বন্ধ করতে পারত এবং বৃক্ষরোপণ ও নদীবাঁধ পোক্ত করতে পারত সরকার। এগুলির কোনওটাই কার্যকর করেনি যোগী সরকার। প্রশ্ন উঠছে, একমাত্র মন্দির-মসজিদ বিবাদ জিইয়ে রাখতেই কি পারদর্শী রাজ্যের বিজেপি সরকার?