বেঙ্গল জুটমিলস ওয়াকার্স ইউনিয়নের ডাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি চটকল মালিকদের দপ্তর আইজেএমএ (ইন্ডিয়ান জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশন)-এর দপ্তরের সামনে তিন শতাধিক চটকল শ্রমিকদের অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। রাজ্যের বন্ধ চটকলগুলির শ্রমিকরা বিক্ষোভে অংশ নেন। রাজ্যে মোট ৪৯টির মধ্যে ১৫টি চটকল বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। অন্যান্য অনেক জুটমিলেই কাজের দিন এবং কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দিয়ে বহু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। মালিকরা এর জন্য মূলত কাঁচা পাটের অভাবকেই দায়ী করেছেন। যদিও বেশ কিছু মিলে কর্মী ছাঁটাই, স্থায়ী শ্রমিক সরিয়ে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক নিয়োগ, আউটসোর্সিং করা ইত্যাদি শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মিলস্তরে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে এগুলি হাসিল করতে চাইছে। রাজ্যের প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক পরিবার এর ফলে ভয়ঙ্কর দুর্দশা এবং প্রবল আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে। হুগলির গোন্দলপাড়া এবং ইন্ডিয়া জুট মিল দীর্ঘ আড়াই বছর যাবত বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি খুলেছিল। সেগুলি আবার বন্ধ করে দিয়েছে মালিকরা। গোন্দলপাড়া জুটমিলের প্রায় ৬০০ শ্রমিক এবং শ্রমিক পরিবারের সদস্য কার্যত অনাহারে এবং রোগভোগের পর করোনাজনিত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন।
সম্প্রতি এই দুই জুট মিলে বিদ্যুৎ সংযোগও কেটে দিয়ে শ্রমিক পরিবারগুলিকে জল ও লাইট থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভাটপাড়ার রিলায়েন্স জুট মিল, রিষড়ার ওয়েলিংটন জুটমিল, শ্যামনগরের ওয়েভারলি জুট মিল, হাওড়ার প্রেমচাঁদ জুটমিলও দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়ছে। ২০২১ সালে কাঁচা পাটের ভাল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও খোলা বাজারে এবং পাট বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে কাঁচাপাটের একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। পাটের যথেচ্ছ মজুতদারি এবং কালোবাজারি হচ্ছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বস্ত্রমন্ত্রক কৃষকদের জন্য কাঁচাপাটের সহায় মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করেছে। প্রতি টন পাটের মূল্য বা এমএসপি ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাট উৎপাদক চাষিদের এমএসপি দেওয়া, কাঁচা পাটের উৎপাদনে যত্ন নেওয়ার জন্যই। আগে জুট কমিশনারের অফিস থেকে কাঁচা পাট ন্যায্য মূল্যে কেনা হত এবং মিলগুলিকে বস্তা এবং চট উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করা হত। কেন না পাট হল কৃষিভিত্তিক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। এ হল প্রকৃতি বান্ধব এবং স্বাস্থ্যকর তন্তু। এর কোনও বিকল্প নেই। এর জন্য পাটের বস্তার অত্যাবশ্যকীয় ব্যবহারের আইন জেপিএম অ্যাক্ট ১৯৮৭, শ্রমিক আন্দোলনের ফলেই চালু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার অস্বাস্থ্যকর সিন্থেটিক বস্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বর্তমান শুধু খাদ্যশস্য এবং চিনি (আংশিক) প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যান্য সরকারগুলি চটের বস্তা ব্যবহার করে। বর্তমানে ক্রমশ সিন্থেটিক কর্পোরেট লবির মুনাফার স্বার্থেই কেন্দ্রীয় সরকার পাটের বস্তার বাধ্যতামূলক ব্যবহারের আইনকে শিথিল করে দিচ্ছে। বর্তমানে বস্ত্র মন্ত্রকের জেসিআই কাঁচা পাটের এমএসপি জারি করেছে বটে কিন্তু জেসিআই এক ছটাকও পাট কেনে না। পাট হল পুঁজিবাদী খোলা বাজারের পণ্য। ফলে এখানে অবাধে চলছে মজুতদারি এবং কালোবাজারি। পাটের বাজারের উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে চটকল একচেটিয়া মালিকদের মদতপুষ্ট জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ফড়েরাই কাঁচাপাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সরকার ঘোষিত এমএসপি-র কোনও মূল্য নেই। বেঙ্গল জুটমিলস ওয়াকার্স ইউনিয়ন থেকে দাবি তোলা হয়েছে পাটের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করতে হবে। সরকার চাষিদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে পাট কিনবে এবং মিলগুলিকে সরবরাহ করবে। পাটের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য অবিলম্বে চালু করা দরকার। কারণ এখনও সরকার চটকলগুলিতে উৎপাদিত ৭৫ শতাংশ চটের বস্তা খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করার জন্য কিনে নেয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল জুট মিলস ওয়াকার্স ইউনিয়নের সভাপতি এবং বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক কমরেড অমল সেন, এআইইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস, কমরেড শান্তি ঘোষ, কমরেড মিলন রক্ষিত, কমরেড সায়েদা খাতুন, কমরেড গৌরীশঙ্কর, কমরেড রামজী সিং, কমরেড চন্দ্রশেখর প্রমুখ। কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল রাজ্যপাল এবং শ্রমমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়ে মিলগুলি খোলার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ২২ ফেব্রুয়ারি জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের কাছে চটশিল্পের অন্যান্য ২০টি সংগঠনের সাথে যুক্তভাবে বেঙ্গল জুট মিলস ওয়াকার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কমরেড অমল সেন প্রতিনিধিত্ব করেন।