একসময় বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। ইদানিংকালে এই শব্দবন্ধটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে আর শোনা না গেলেও লালকেল্লার প্রাচীরে হোক, কিংবা সংসদে তাঁর অতিবিরল বত্তৃতাতেই হোক– অন্য দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁকে খুব সরব হতে দেখা যায়। কিন্তু তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া মালিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে, তাঁর একাধিক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যাঙ্কের টাকা মেরে বিদেশে পালালে তখন প্রধানমন্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া দেশবাসী কখনও দেখেনি। অতি সম্প্রতি আদানি গোষ্ঠী এবং বেদান্ত গোষ্ঠীকে জড়িয়ে আবার নতুন করে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের প্রশ্ন– নরেন্দ্র মোদিজি কি জেগে আছেন? গত লোকসভা ভোটের পর হিমালয়ের গুহায় তাঁর যে ধ্যানমগ্ন ছবি সংবাদমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিল, সেখান থেকে কি তিনি উঠেছেন? না হলে শেয়ার জালিয়াতিতে দেশের সাধারণ লগ্নিকারীদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখেও তাঁর মুখে টুঁ শব্দটি নেই কেন? অবশ্য দেশবাসী এও জানে নিজের ঢাক পেটানোর কাজে প্রধানমন্ত্রী সর্বক্ষণ ব্যস্ত, তিনি টুইটারে (বর্তমানে এক্স হ্যান্ডেল) সর্বক্ষণ কিছু বলে চলেন, সুযোগ পেলেই দেড় দু’ঘন্টার বক্তৃতা দিয়ে দেন, অন্য দেশের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতেও তাঁর ক্লান্তি নেই। শুধু বিপাকে পড়লে মৌনী সাজেন তিনি!
এর আগে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানিদের বিরুদ্ধে শেয়ার দর নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে বিরোধীরা দাবি করেছিলেন যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গড়ে তদন্ত হোক। কিন্তু মোদি সরকার তা মানেনি। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এবার আবার অভিযোগ উঠল আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। যে অভিযোগের অনেকটাই মিলে যাচ্ছে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের প্রধান সুরের সাথে।
অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ওসিসিআরপি (অরগানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট) তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বেআইনি অর্থ পাচার, শেয়ার দর বাড়ানোর জন্য জালিয়াতি ও বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ সামনে এনেছে। তারা বলেছে, আদানি গোষ্ঠী তাদের শেয়ার দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখতে মরিশাসের দুটি ‘অস্বচ্ছ’ অর্থলগ্নি সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের গোষ্ঠীর অর্থই বাইরে পাচার করে আবার তা ঘুরপথে ভারতে ফিরিয়ে এনে তাকেই বিপুল নতুন লগ্নি হিসাবে দেখিয়েছে। অভিযোগ, এর জন্য ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি পাচার করা হয়েছে কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য বলে কুখ্যাত মরিশাসে। সেই অর্থই আবার ফিরে এসেছে আদানিদের শেয়ারে। আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানির ঘনিষ্ঠ তাইওয়ানের চ্যাং চুং লিং এবং আরব আমিরশাহির নাসের আলি শাবন আহলির মাধ্যমে বছরের পর বছর এই লেনদেন চলছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকেই মরিশাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এবং আরব আমিরশাহিতে আদানি গোষ্ঠীর অন্যতম ডিরেক্টর এই দুই ব্যক্তি নানা ভুয়ো সংস্থা খোলে। তাদের চারটি সংস্থা অন্য একটি লগ্নি তহবিলের মাধ্যমে ভারতের শেয়ার বাজারে আদানিদের হয়ে টাকা ঢালে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই আদানিদের শেয়ারের দাম ফুলেফেঁপে ওঠে।
অভিযোগ এই প্রথম উঠল না, ২০১৪ তেই আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম’-এর তদন্তের ভিত্তিতে প্রকাশিত ‘প্যান্ডোরা পেপারস’-এ অভিযোগ করা হয়েছিল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের শেল কোম্পানি (ভুয়ো কোম্পানি)-র মাধ্যমে ভারতীয় ধনকুবের পুঁজিপতিরা বেআইনি লেনদেন চালিয়ে দেশে নিজেদের শেয়ার দর বাড়ানোর অনৈতিক পথ নিয়েছে। আদানি গোষ্ঠীরও নাম ছিল তাতে। নানা দেশের সরকারি দলিল ফাঁস হওয়ার জন্য খ্যাত ‘পানামা পেপার্স’ তদন্তেও এই অভিযোগ ছিল। ২০১৪তে ভারতের ডাইরেক্টর অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের পক্ষ থেকে শেয়ার মার্কেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবিকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেবি কিছুদিন পর জানিয়ে দেয় সব ঠিক আছে। প্রসঙ্গত, সেবির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহা বর্তমানে আদানিগোষ্ঠীর অধিগৃহীত এনডি টিভির স্বাধীন ডিরেক্টর।
ওসিসিআরপি রিপোর্টে সামনে এসেছে আরও একটি অভিযোগ। ভারতীয় বহুজাতিক সংস্থা বেদান্ত গোষ্ঠীর স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই নিঃশব্দে এমনভাবে পরিবেশ আইন পরিবর্তন করে দিয়েছে যাতে অনৈতিকভাবে খনি থেকে বাড়তি খনিজ তোলা বা তেলের কূপ খননের জন্য জমি নিতে এলাকার মানুষের সাথে আলোচনার শর্ত শিথিল হয়ে যায়। এর ফলে রাজস্থানে স্থানীয় মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও বেদান্ত গোষ্ঠী পরিচালিত কেয়ার্ন সংস্থা ৬টি নতুন তেলের কূপ খননের অনুমতি পেয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে এর জন্য বারবার বেদান্ত গোষ্ঠী বিজেপি মন্ত্রীদের কাছে দরবার করেছে। গোপনে আইন পাল্টে দিলেও অন্যান্য সংস্থার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অথচ বেদান্তের সব আবেদন গ্রাহ্য হয়েছে। অন্য দিকে বেদান্ত গোষ্ঠী বিজেপির তহবিলে স্বনামে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে, আর নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে নামহীন অনুদান ধরলে তা বিপুল।
এমন ঘটনা অবশ্য বর্তমান ভারতে খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিজেপির সাথে, বিশেষভাবে নরেন্দ্র মোদির সাথে আদানি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সখ্যতার কথা বারবারই মানুষ দেখেছে। অস্ট্রেলিয়ায় খনি কেনার জন্য আদানি গোষ্ঠীর টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে নরেন্দ্র মোদির সফরের মাঝে স্টেট ব্যাঙ্কের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে সে দেশে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ঋণের নথিতে সই করতে বাধ্য করা, দেশে কয়লার কোনও অভাব না থাকা সত্ত্বেও দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে আদানিদের পরিচালিত বিদেশি খনি থেকে কয়লা নিতে বাধ্য করা, নরেন্দ্র মোদির বিদেশ সফরে সর্বদাই আদানি গোষ্ঠীর মাথাদের উপস্থিতি এবং তারপরেই সে দেশে আদানিদের ব্যবসার বড় চুক্তি এখন নিতান্তই যেন স্বাভাবিক ঘটনা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গ্রিস সফরেও একই ঘটনা ঘটেছে। এর আগে রাফাল যুদ্ধবিমান চুক্তি নিয়ে ফ্রান্স সরকারের বরাত সরকারি কোম্পানি হ্যালের বদলে আম্বানিদের পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। যদিও বিজেপির বদান্যতায় অবসরের পরেই সাংসদ পদ লাভ করা এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির রায়ে বিজেপি সরকার এই কেলেঙ্কারি থেকে ছাড় পেয়ে গেছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়েও তদন্তে সেবি যে ‘কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ এ কথা প্রমাণেরই উদ্যোগ নিয়েছে তা তাদের আচরণেই অনেকটা নিশ্চিত। ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত এক্সপার্ট কমিটিও ভাসা ভাসা রিপোর্ট দিয়েছে। ফলে আম্বানি-আদানিদের মতো ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে এ দেশে সঠিক কোনও তদন্ত হবে এটা ভাবাই দুষ্কর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি এ সব জানেন না? তা ছাড়া, বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের তথা তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ছাড়া এই লাগামহীন দুর্নীতি চলতে পারে কি? স্বঘোষিত ‘ফকিরের’ ঝুলিতে আরও কী আছে তা তিনিই বলতে পারবেন।
বিজেপি আমলে দেশে মুষ্টিমেয় ধনকুবের গোষ্ঠীর লাগামহীন বৃদ্ধি ঘটেছে। অন্য দিকে সাধারণ মানুষের দারিদ্র ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত সেবাদাস হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তাদের আশীর্বাদধন্য হয়েই বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে বসেছে। সেই কারণে জনগণকে শোষণে ছিবড়ে করে দিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা বাড়ানোর দায়িত্বই তারা নিষ্ঠাভরে পালন করে চলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজেপি দলটার চরম দুর্নীতিগ্রস্ত চরিত্র। রাজ্যে রাজ্যে মাফিয়া, নৃশংস খুনি, পুলিশ-আমলাদের দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রই তাদের ভরসা। অতীতে আরএসএস-বিজেপির নেতারা হিন্দু ধর্মকে ভিত্তি করে অন্তত কিছু নীতির কথা মুখে হলেও বলতেন। এখন যেভাবে হোক গদি দখলের উদগ্র লালসায় তারা আর এসবের ধার ধারছে না। এই কাজে কর্পোরেট মালিকদের টাকা আর প্রচারের আশীর্বাদ পেতে হলে চক্ষুলজ্জার বালাই রাখলে চলেও না। বিজেপি সেটাই করছে। এ জন্যই বিজেপির তহবিলে শত শত কোটি টাকা ঢালে কর্পোরেট কোম্পানির মালিক ধনকুবেররা। ভারতে যে কোনও বুর্জোয়া দলের তুলনায় বিজেপির তহবিলে অকাতরে টাকা ঢালে পুঁজিমালিকরা। অবশ্য আজ যারাই সরকারি মসনদে বসছে তাদের সাথেই পুঁজিপতিদের এই লেনদেনের সম্পর্ক থাকতে বাধ্য। তার জন্য দুর্নীতি, মালিকদের অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দিতে আইনের শাসনের কোনও তোয়াক্কা না রাখাই আজ সরকারি দলের একমাত্র কর্তব্য। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম আজকের দিনের পুঁজিবাদী শাসনের এই চরিত্রকে আড়াল করতে বিজেপি-আম্বানি-আদানি স্যাঙাৎতন্ত্র বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কথা বলে। যেন সৎ কোনও মন্ত্রী এলেই আর এমনটা ঘটতে পারবে না। বাস্তবটা একেবারেই তা নয়, আজকের দিনে পুঁজিবাদের চরিত্রটাই এমন যে, মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিমালিকের তাঁবেদারি না করে সরকার তথা রাষ্ট্র চলতেই পারে না। পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থেও অতীতে যেমন কিছুটা স্বচ্ছতা, সততা সরকারগুলো বজায় রাখত, আজ পুঁজিবাদের বাজারসংকট এমনই যে সৎভাবে অন্যকে এতটুকু প্রতিযোগিতার জমি ছাড়ার কথা একচেটিয়া মালিকরা ভাবতেই পারে না। সরকার যেহেতু তাদেরই দোসর তাই পুরো ব্যবস্থাটাই স্যাঙাৎতন্ত্রে পরিণত হয়। তাই বুর্জোয়া মসনদে ভেকধারী ফকিরই বসুন আর কৃচ্ছসাধনের সার্টিফিকেটধারী অন্য কেউ বসুন, এই দুর্নীতির চক্রই পুঁজিবাদী শাসনের ভবিতব্য।