বনধের চাপেই পেট্রল–ডিজেল নিয়ে টনক নড়ল সরকারের

১০ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের পরদিনই এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার পেট্রল ও ডিজেলের উপর লিটার প্রতি ১ টাকা কর ছাড় ঘোষণা করতে বাধ্য হল৷ বনধের চাপে ভ্যাট কমিয়েছে কেরালা, রাজস্থান ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারও৷ বনধ ডেকে কী লাভ, যাঁরা বলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লাভটা দেখতে পাচ্ছেন৷ বনধের সাফল্য শুধু এটুকুতেই নয়, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চূড়ান্ত জনবিরোধী নীতি, দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক হিংসা–উন্মত্ততা–বিদ্বেষ ইত্যাদিকে সুকৌশলে বিস্তার ঘটিয়ে জনগণের ঐক্য–সংহতি ধ্বংস করা, বিজেপির জনবিরোধী কাজের সমালোচনা করলেই তাঁদের কন্ঠরোধ করা এইসব ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একটা সার্বিক প্রতিবাদ ধ্বনিত হল, সাফল্য এখানেও৷ এই বনধ বুঝিয়ে দিল ভারতের বুকে এক তরফা প্রতিবাদহীন গুন্ডামির দিন শেষ৷ এও দেখালো শাসক দলের পক্ষে রাষ্ট্রশক্তি থাকলেও বিরুদ্ধ জনশক্তির ক্ষমতা তার থেকে অনেক বেশি৷

কংগ্রেস ডেকেছিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা– ৬ ঘন্টার বনধ৷ যে কংগ্রেস শাসনে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, যে কংগ্রেস শাসনে পেট্রোপণ্যের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির নজির রয়েছে, রয়েছে পেট্রল–ডিজেলের শুল্ক, সেস বৃদ্ধির বহু দৃষ্টান্ত, সেই কংগ্রেস যে আন্দোলনের প্রশ্নে ‘সিরিয়াস’ কিংবা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য৷ তারা ৬ ঘন্টার এই খণ্ডিত বনধ ডেকেছে মূলত মানুষের ক্ষোভকে ভোটের বাক্সে টেনে আনতে৷ তাদের এই বিরোধিতার কোনও নৈতিক ভিত্তি ছিল না৷

 

পুলিশ দুই এস ইউ সি আই (সি)

কর্মীকে আটকে রাখল থানায়

১০ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের দিন কোচবিহারের তুফানগঞ্জে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে পিকেটিং করার সময় এস ইউ সি আই (সি)–র দুই কর্মী কমরেডস কমল বর্মন এবং শিবু রায়কে গ্রেপ্তার করে তৃণমূল সরকারের পুলিশ৷ সাধারণত, বনধের দিন সন্ধ্যায় ধর্মঘটকারীদের ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু তুফানগঞ্জ পুলিশ তাঁদের মুক্তি না দিয়ে লকআপে সাধারণ বন্দিদের সাথে আটকে রেখে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জানায় এদের জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে আদালত থেকে৷ কেন পুলিশের এই ভূমিকা? সাধারণ বন্দিদের থেকে যে রাজনৈতিক বন্দিরা পৃথক তা কি তুফানগঞ্জ পুলিশের অজানা? পুলিশ কাকে খুশি করতে এ কাজ করেছে? এস ইউ সি আই (সি) আঞ্চলিক সম্পাদক কমরেড সাত্বনা দত্ত জানান, পরের দিন আদালত থেকে জামিনের ব্যবস্থা করে ওদের মুক্ত করা হয়৷ তিনি পুলিশের এই ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেন৷

 

এস ইউ সি আই (সি) সহ বামপন্থী দলগুলি ওইদিন পৃথকভাবে ১২ ঘন্টা হরতালের ডাক দেয়৷ বনধের সমর্থনে ব্যাপক প্রচারে নামেন এস ইউ সি আই (সি) নেতা–কর্মীরা৷ ৩১ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিদিনই পেট্রল–ডিজেলের দামবৃদ্ধি, পরিণামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আরও মূল্যবৃদ্ধি, বাসমালিকদের পক্ষ থেকে আবারও ভাড়াবৃদ্ধির দাবি ইত্যাদি মানুষকে এতটাই আশঙ্কিত করেছে যে, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছেন, বনধ হওয়া দরকার৷ বনধের বিরোধিতা করে তৃণমূল সরকার প্রবল রাজনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ে৷ সামনেই লোকসভা ভোট৷ তাতে সমস্যা তৈরি হতে পারে এই আশঙ্কায় মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি পেট্রল–ডিজেলে লিটার প্রতি ১ টাকা দাম কমানোর কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হন৷

কোনও একটা দল বা নানা দলের জোট যদি নিছক ভোটের স্বার্থে, নিজেদের এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে হঠাৎ করে বনধ ডাকার খেলা করে, তা হলে মানুষের সমর্থন বিশেষ করে আবেগময় সমর্থন তাদের পিছনে থাকে না৷ কিন্তু বনধ যদি ডাকা হয় জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যার সমাধানের দাবিতে, যদি পর্যাপ্ত সময় নিয়ে জনগণকে বনধের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয়, যদি জনগণ বোঝে সরকার দাবি পূরণের জন্য আবেদন নিবেদন ইত্যাদি কোনও কিছুরই মূল্য দেয়নি, তখন জনগণ বদ্ধপরিকর হয় বনধ সফল করার জন্য৷ ১৯৯৮ সালে এস ইউ সি আই (সি) প্রাথমিকে ইংরেজি পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে যে বাংলা বনধ ডেকেছিল তার অসাধারণ সাফল্যের কথা সাধারণ মানুষ আজও স্মরণ করেন৷ ১৯ বছরের লাগাতার আন্দোলন ও সর্বশেষ এই বনধের চাপে সিপিএম সরকার প্রাথমিকে ইংরেজি পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল৷

আবার ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এস ইউ সি আই (সি) প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর দাবিতে বাংলা বনধ ডেকেছিল৷ এই বনধ এত জন সমর্থন লাভ করে যে, বনধের দু’দিন আগেই তৃণমূল সরকার এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে বনধের দাবি মানার কথা ঘোষণা করে৷ ধারাবাহিক আন্দোলন, বনধের চাপ এবং পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার কুফল লক্ষ করে অবশেষে লোকসভাতেও পাশ–ফেল চালুর পক্ষে বিল পাশ হয়৷

যাঁরা বনধকে ‘সর্বনাশা’ বলেন, তাঁরা হাজার হাজার শিল্প বন্ধ হওয়াকে, মালিকের লক আউটকে ‘কর্মনাশা’ বলেন না৷ কোটি কেটি বেকার কাজ না পেয়ে নিজের শ্রমশক্তিকে অলস করে রাখতে বাধ্য হচ্ছে৷ এই শ্রমশক্তি শিল্পে নিয়োজিত হলে কত উৎপাদন বাড়তে পারত৷ পুঁজিবাদী সরকারগুলির এই জনবিরোধী ভূমিকাকে তাঁরা কর্মনাশা বলেন না৷ আসলে বনধকে ‘কর্মনাশা’ নামে দেগে দিতে চায় মালিক শ্রেণি তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে৷ এর দ্বারা তারা তাদের শোষণ–লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকেই মারতে চায়৷ কিন্তু সরকারগুলির জনজীবনে ক্রমাগত সংকটের বোঝা চাপানোর বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলন করবেই, তার থেকে মুক্তি পেতে ফেটেও পড়বে সর্বাত্মক বনধে৷ মালিক শ্রেণির ক্ষমতা নেই তাকে আটকানোর৷

(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)