২০১৪ সালে প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসে কর্মসংস্থানের উপর জোর দেওয়া হবে৷ বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির সংস্থান করবে নাকি তাঁর সরকার৷ চার বছর অতিক্রান্ত৷ ২ কোটি তো দূরের কথা, বাস্তবে ২ লক্ষ কাজের সংস্থানও করতে পারেনি মোদি সরকার৷ এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়ে কোনও কথা নেই৷ উপরন্তু ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট ঘোষণার আগেই অর্থমন্ত্রক এক নির্দেশিকায় ঘোষণা করে, পাঁচ বছর ধরে খালি পড়ে থাকা সরকারি সমস্ত পদ তুলে দেওয়া হবে৷ প্রধানমন্ত্রীর নিদান, যুবকরা বেকার না থেকে পকোড়া ভাজুক৷
আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে পরিসংখ্যানের কচকচি চলছে৷ ২০১৮ সালে আর্থিক বৃদ্ধি কত হবে– ছয় না সাত শতাংশ, তা নিয়ে চলছে কূটতর্ক৷ তাতে কর্মসংস্থানের বেহাল দশা কতটুকু বদলাচ্ছে? গত আট বছরে কর্মসংস্থানের হারে সর্বনিম্ন এ বছর৷ ২০১৩–১৪ থেকে ২০১৫–১৬– এই তিন আর্থিক বছরে দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি, বরং কমে গিয়েছে ৫৩ লাখ৷ ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) ২০১৮–র বার্ষিক রিপোর্টে বলছে, বছর শেষে ভারতে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে৷
নির্মাণশিল্প, তথ্য–প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলিতে কিছুটা কর্মসংস্থান তৈরি হত এতদিন, এখন সেগুলি কর্মী ছাঁটাইয়ে ব্যস্ত৷ অনেকের রোজগার কেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর নোটবন্দি৷ জিএসটি–র কোপে পড়ে বহু ক্ষুদ্র–মাঝারি শিল্পের সমস্যা বেড়েছে৷ মোদি সরকারের আর্থিক উপদেষ্টা স্বয়ং বলেছেন, নোটবন্দি–জিএসটি–র মতো অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ করার দরকার নেই৷ তবুও চমকপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এসব করেছেন৷ বছরের পর বছর বাজেট হয়েছে, পরিকল্পনার পাহাড়প্রমাণ সৌধ গড়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু কর্মসংকোচনের হার ক্রমশই বাড়ছে৷ চাকরির জন্য দেশজোড়া বেকার যুবকের হাহাকার আর্তনাদে পরিণত হয়েছে৷ স্বচ্ছ ভারত, গো রক্ষা, নোটবন্দি, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া, সবকা সাথ সবকা বিকাশ– এত রকমের চটকদারি স্লোগান তুলেও কর্মসংস্থানের দুঃসহ চিত্র ঢাকা যাচ্ছে না৷
কয়েক বছর আগে উত্তরপ্রদেশে ৩৬৬টি পিওনের পদে আবেদন করেছিলেন ২৩ লক্ষ যুবক৷ এর মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচডি, ২ লক্ষের বেশি ইঞ্জিনিয়ার, কয়েক লক্ষ স্নাতকোত্তর৷ সম্প্রতি এ রাজ্যে সরকারি অফিসের গ্রুপ–ডি পদে ৬ হাজার খালি পদের জন্য আবেদন করেছিলেন ২৪ লাখ বেকার৷ মালদা মেডিকেল কলেজে মর্গে শববাহক (ডোম) পদের জন্য আবেদন করেছেন ৩০০ জনের বেশি৷ অনেকেই এম ফিল, পিএইচডি ডিগ্রিধারী৷ কেউ কেউ দু’বার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছেন৷ ৩০০ জনের প্রতি তিন জনে একজন গ্র্যাজুয়েট৷ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট থানায় সিভিক ভলান্টিয়ারের ২৪৪টি পদের জন্য ১২ ঘন্টার মধ্যে আবেদন পড়েছে প্রায় ৭ হাজার৷ এ চিত্র দেশের প্রত্যেকটি রাজ্যের৷
অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর বহুল প্রচারিত আইটি মডেল মুখ থুবড়ে পড়েছে বহুকাল৷ একসময় হলদিয়ায় কর্মসংস্থানের ধুয়ো তুলেছিল সিপিএম সরকার৷ সে ফানুস কবেই ফেটে গেছে৷ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ‘তেলেভাজা শিল্পে’ অভিনব কর্মসংস্থানের কথাও সবাই জানে৷ নরেন্দ্র মোদি–মিত শাহের বহু বিজ্ঞাপিত গুজরাট মডেলের ধাপ্পা ফাঁস হয়ে গেছে৷ অসংগঠিত ক্ষেত্র ছাড়া কার্যত কাজের বাজার নেই বললেই চলে৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও পরিবার প্রতিপালন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে৷ কর্মসংস্থানের এই সংকট দেখে মোদি ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, নীতি আয়োগের পূর্বতন ভাইস চেয়ারম্যান অরবিন্দ পানাগড়িয়া পর্যন্ত বলছেন, ‘আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট ইজ এ সিরিয়াস প্রবলেম৷’ অর্থাৎ পূর্ণ সময়ের কাজ, উপযুক্ত মাইনে ভিত্তিক কাজ নেই৷ যেটুকু হচ্ছে তাও ঠিকা কাজ৷ উদারিকরণের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে ‘জবলেস গ্রোথ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করছেন– অর্থাৎ দেশের নাকি আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু তাতে কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না৷ তাহলে এই গ্রোথ দেশের সাধারণ মানুষের কী কাজে লাগছে?
দেশের এই ভয়াবহ চিত্র প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়৷ এই চিত্রকে আড়াল করতেই প্রধানমন্ত্রী বেকার যুবকদের সহজ পথ বাতলে দিয়েছেন৷ কর্মসংস্থানের সংকটে যারা আঙুল তুলছেন সরকারের দিকে, তাদের বলেছেন, ‘আপনার অফিসের সামনে যে পকোড়ার দোকান খুলেছে, সে কি রোজগার করছে না’? যেন কর্মসংস্থান ব্যাপারটা ছেলেখেলা এই পকোড়া ভাজার জন্যই কি মোদিজির পিছনে বেকার যুবকরা ২০১৪ সালে সমর্থন জুগিয়েছিলেন?
প্রধানমন্ত্রী ধূর্ততার সাথে বলেছেন, কর্মসংস্থান হয়েছে তার উদাহরণ নাকি ৭০ লক্ষ ইপিএফ (এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড) অ্যাকাউন্ট খোলা সত্যিটা কী? আসলে পি এফ মালিকদের তহবিলে দেয় টাকার ৮.৩৩ শতাংশ দায় বহন করছে সরকার৷ বস্ত্র–চর্ম–জুতো শিল্পের প্যাকেজেও সরকার নতুন কর্মীদের পি এফে অতিরিক্ত ৩.৬৭ শতাংশ দায় নিচ্ছে৷ বাস্তবে মালিকদের দেয় টাকার দায় সরকার ঘাড়ে নেওয়াতেই অ্যাকাউন্টের পরিমাণ বেড়েছে৷ বাস্তবে এর সাথে নতুন কর্মসংস্থানের কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন এআইইউটিইউসি–র সাধারণ সম্পাদক তথা ইপিএফ অছি পরিষদের সদস্য শঙ্কর সাহা৷ শিল্পপতিদের জন্য সরকার দানছত্র খুলেই রেখেছে, শুধু বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান থেকে তারা হাত তুলে নিয়েছে
পকোড়া ভাজার প্রেসক্রিপশন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলে দিয়েছেন কাজের নতুন কোনও সুযোগ নেই৷ বাজেটেও তার প্রতিফলন ঘটেছে৷ অথচ কর্মসংস্থানের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার বুলি আওড়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদরা৷ কারণ, কয়েকটি রাজ্যে সামনে ভোট৷ তাই বেকারদের ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করতে এসব বুলি আওড়ানো দরকার৷ এই বেকারত্বের সমস্যা পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলেও ছিল, এখন আরও বাড়ছে৷
সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা রুটিনমাফিক বলে চলেছেন, কর্মসংস্থানের সংকট মুক্ত হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ সংবাদমাধ্যমের প্রচার, ‘মুক্ত বাজার ব্যবস্থায়’ বেসরকারি পুঁজি মুনাফার তাগিদে ক্রমাগত বিনিয়োগ করবে৷ তাহলেই কর্মসংস্থান হু হু করে বেড়ে যাবে, মানুষের আয়ের বৃদ্ধি হবে৷ সত্যিই কি তাই? বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগের দ্বার খুলে গেলে কি চাকরির বাজারে মন্দা কাটবে? এই বিনিয়োগের কতটুকু উৎপাদন শিল্পে হচ্ছে? বেশিরভাগটাই বিনিয়োগ হচ্ছে শেয়ারবাজারে আর ফাটকায়৷
দুনিয়াজোড়া পুঁজিবাদী বাজারের ভয়ঙ্কর সংকটে ভারতও নিমজ্জিত৷ দেশে কোটি কোটি মানুষ আছে, কিন্তু তাদের কেনার ক্ষমতা নেই৷ তাই চাহিদা নেই, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না৷ চালু শিল্প–কারখানাগুলিতে ভয়ঙ্কর কর্মসংকোচন চলছে৷ বেকার সমস্যার রোগ সারাতে পরিষেবা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের টোটকা দিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা হয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে৷ ২০১৭ সালে শুধু ইনফোসিস, উইপ্রো, কগনিজেন্টের মতো প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ছাঁটাই হয়েছে ৫৬ হাজার ইঞ্জিনিয়ার৷ এঁরা প্রত্যেকে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্ত করে এবং প্রচুর ব্যয়ে পড়াশোনা করে চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ লক আউট চলছে যত্রতত্র৷ বৃহৎ পুঁজির মালিকদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে মাঝারি–ক্ষুদ্র পুঁজি৷ এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও কমছে৷
কর্মসংস্থান হতে গেলে দরকার অবাধ শিল্পায়ন৷ শিল্পায়ন মানে অপ্রতিহত গতিতে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠা৷ কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা কি আদৌ সম্ভব? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে তা আদৌ সম্ভব নয়৷ সরকার জনমুখী দৃষ্টি নিয়ে চললে এর মধ্যেও দু’চারটি ক্ষেত্রে শ্রমনিবিড় শিল্প গড়ে উঠতে পারত সরকারি উদ্যোগে৷ রেল–স্বাস্থ্য–শিক্ষা–ব্যাঙ্ক ইত্যাদি পরিষেবা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়িয়ে কিছু কর্মসংস্থান করতে পারত৷ কিন্তু সমস্ত সরকারই আসলে দেশের প্রকৃত মালিক ধনকুবের গোষ্ঠীর সেবাদাস মাত্র৷ তাই এ কাজ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ বাজেটে আড়াইশো কোটি টাকার বেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে করছাড়ের ঘোষণা, সেটাই প্রমাণ করে৷
ফলে কোটি কোটি বেকারকে কখনও পকোড়া ভাজা কখনও বা সরকারি দলের তোলাবাজ হিসাবে রোজগারের পথ বাতলে দেওয়াই তাদের সম্বল৷ বেকারদের অসহায় অবস্থার প্রতি এ চরম তামাশা৷ এর উত্তর এ দেশের যৌবন একদিন দেবেই৷