(২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ‘সংবাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক রোদ্দুর বিশ্বাসের নিবন্ধের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল)
এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট হয়েও ৩৪ বছরের বাম জমানায় বারবার বহু ইস্যুতে বাম সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে৷ তাদের নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে৷ আন্দোলনে আন্দোলনে বহুবার কলকাতার রাজপথ অবরুদ্ধ করে দিয়েছে এই দল৷ তাদের দাবিগুলির মধ্যে প্রধান দুটি দাবি রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে পরপর দু’বার দুটো পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে সরকার তথা শাসকদলকে৷ শিক্ষা নিয়ে তাদের যে দাবি দুটি দুই ভিন্ন ভিন্ন দলের সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ দারুণ দাপুটে বাম সরকার তথা সিপিএম, তারা প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে ইংরেজি তুলে দিয়ে যে ভুল করেছিল তা এসইউসিআই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল৷ এই ইস্যুতে তারা ১৯৯৮ সালে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল আমজনতার বিপুল সমর্থন নিয়ে যাতে সরকার ইংরেজি ফিরিয়ে আনে৷ প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনার নানা আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রসূ এবং আকর্ষণীয় আন্দোলন ছিল এক কোটি সই সংগ্রহ করা৷ পশ্চিমবঙ্গে জেলায় জেলায় ব্লকে ব্লকে তাদের কর্মীরা এই সই সংগ্রহে নেমে পড়েছিল এবং তাতে এমন বিপুল সাড়া পড়েছিল যে দারুণ প্রতাপী বাম সরকার শেষমেশ প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল৷
ইংরেজি বাম সরকার কেন তুলে দিয়েছিল এবং এসইউসিআই কেন সেই ইংরেজি ফিরিয়ে আনার পক্ষে তা নিয়ে তাদের বক্তব্যের সারাংশ ছিল– সরকারের আসল উদ্দেশ্য আমজনতার ছেলেমেয়েরা ইংরেজি না পড়ে, না শিখে এমন শিক্ষিত হয়ে পড়ে থাকবে যা কোনও কাজে লাগবে না৷ সেই ফাঁকে মন্ত্রী–আমলাদের সন্তানরা কনভেন্টে পড়াশোনা করে দেশ–বিদেশে বড় বড় চাকরি করবে৷ সাধারণ মানুষের নতুন প্রজন্মকে ইংরেজি না শিখতে দিয়ে তাদের ডুম করে দিতে চায় সরকার৷ জনগণ এসইউসিআইয়ের ওই বক্তব্য দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল৷ ধুরন্ধর বাম সরকার বিলক্ষণ তা অনুধাবন করতে পেরে শেষে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে এনেছিল৷ এমন দাবি এবং জয় কিন্তু ওই দলটিরই প্রাপ্য৷ অনেক বড় বড় বিরোধী দল সে সময় থাকলেও ইংরেজি ফেরানো নিয়ে এমন বড় আন্দোলন আর কোনও দল করতে পারেনি৷ প্রদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সেই সময় বড় বিরোধী দল৷ তারা এই ইংরেজি নিয়ে তেমন কোনও আন্দোলনে পা বাড়ায়নি৷ কিন্তু এসইউসিআই ইংরেজি নিয়ে মানুষের পালস–টা সঠিক বুঝতে পেরেছিল এবং সেই মোতাবেক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে সাফল্যও পেয়েছিল৷ ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল৷ তাদের দাবি ছিল, শিক্ষাব্যবস্থায় যদি পাশ–ফেল না থাকে তবে সেই শিক্ষার কোনও মূল্য থাকে না৷ তৎকালীন বাম সরকার ২০০৭ সালে আবার প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হল৷ এসইউসিআই ইংরেজি ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে বিরাট সাফল্য পেল৷ পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন জারি থাকল৷ পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার দাবিতে তারা আবার আন্দোলনে ঝাঁপ দিল৷ ইতিমধ্যে ২০১১ সালে রাজ্যে পট পরিবর্তন বা সরকারের পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় আন্দোলনটা থিতিয়ে যায়৷
… এসইউসিআই আর চুপ থাকতে পারেনি৷ তারা এই সরকারের ছয় বছর হতে না হতেই পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার সপক্ষে আন্দোলন শুরু করে৷
প্রবল পরাক্রমী বাম সরকার যেমন ইংরেজি চালুর করার আন্দোলনের কাছ নতজানু হয়ে পুনরায় প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল, তেমনি বর্তমান তৃণমূল তথা মা–মাটি–মানুষের সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে পাশ–ফেল চালু করার কথা ঘোষণা করেছে৷
এসইউসিআই দলের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু তৃণমূল সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলেছেন, সরকার কেন সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করছে না কোন ক্লাস থেকে পাশ–ফেল প্রথা চালু করতে চায়৷ উল্লেখ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রাথমিক বা ক্লাস ওয়ান থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পাশ–ফেল নেই, সেই পাশ–ফেল যাতে আবার ফিরে আসে সেই ইস্যু নিয়ে গত ১৭ জুলাই এসইউসিআই–এর পক্ষ থেকে ১২ ঘন্টার বাংলা বনধের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ এসইউসিআইয়ের দাবি ক্লাস ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত আবার পাশ–ফেল চালু হোক৷ একটা ছোট দল, অথচ তার ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গ্রহণের ক্ষমতা, আন্দোলনের তীব্রতা, জনগণের সমর্থন আদায়ের কৌশল এবং আন্দোলনে টিকে থাকার দৃঢ়তা এবং শেষমেশ দুই পরাক্রমশালী শাসকদল যথাক্রমে সিপিএম এবং তৃণমূলকে দাবি মানতে বাধ্য করানোর মধ্যে কোথায় যেন একটু ঐতিহাসিক জয়ের গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়৷ কোথায় যেন জনগণের নাড়ির সঙ্গে তাদের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়৷