ফ্রান্সের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে সাড়া পড়েছে দুনিয়া জুড়ে। ইউরোপের দেশে দেশে এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যখন দক্ষিণপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটছে, সেই সময়ে এবারের নির্বাচনে ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে সবচেয়ে বেশি– ১৮২টি আসন পেয়েছে বামপন্থী দলগুলির জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি)।
ফ্রান্সে এই নির্বাচন হয় দু’দফায়। ৩০ জুন প্রথম দফার নির্বাচনে মূল প্রতিযোগিতা ছিল প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর মধ্য দক্ষিণপন্থী এনসেম্বল জোট, অতি দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) এবং জঁ লুক মেলেঁশোঁর নেতৃত্বাধীন বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি)-র মধ্যে। এই দফায় প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে চলে যায় ন্যাশনাল র্যালি। এই অবস্থায় দেশে অতি-দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হতে ম্যাক্রঁর দল ও বামপন্থী এনএফপি দ্বিতীয় দফা ভোটের আগে একজোট হয়। দুই জোটের যে যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সেখানে নিজেদের প্রার্থী তুলে নিয়ে একে অপরকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই অনুযায়ী ৭ জুলাই দ্বিতীয় দফার ভোটে দেখা যায় ন্যাশনাল ব়্যালি নেমে গেছে তৃতীয় স্থানে। আর ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে বামপন্থী জোট এনএফপি।
ভারতের মতো ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও গরিবি-বেকারি-মূল্যবৃদ্ধি-স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ কমে যাওয়া সহ অসংখ্য সমস্যায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের কথা ধরলে দেখা যায়, মজুরি বৃদ্ধি, অবসরের বয়স কমানো, জিনিসপত্রের দাম কমানো, চিকিৎসা, শিক্ষা সহ একের পর এক দাবিতে সেখানকার মেহনতি মানুষ গত কয়েক বছর ধরে বার বার আন্দোলনে ফেটে পড়েছে। বিক্ষোভের অভিঘাতে বার বার উত্তাল হয়েছে ফ্রান্স। একই পরিস্থিতি জার্মানি, ব্রিটেন সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশেরই।
শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারগুলির জনস্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সমস্যা জর্জরিত সাধারণ মানুষের ক্ষোভের সুযোগ নিয়েছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাটিই যে প্রতি মুহূর্তে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির জন্ম দিয়ে চলেছে, সেটা আড়াল করতে ভারতের মতো ইউরোপের দেশে দেশেও দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি জনগণের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নিজেদের ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এ দেশের মতোই ইউরোপের দেশগুলিতেও দক্ষিণপন্থীরা জনজীবনের প্রধান সমস্যাগুলির কারণ হিসাবে দাগিয়ে দিতে চেয়েছে কোনও না কোনও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। ভারতে দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে মুসলিম ধর্মের সংখ্যালঘু মানুষকে। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের নাগরিক ওই সংখ্যালঘুদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবল অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএস-বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থী শক্তি। একই ভাবে ফ্রান্সে ল্য পেনের নেতৃত্বাধীন অতি-দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ব়্যালি সেখানকার সাধারণ মানুষের যাবতীয় দুর্দশার জন্য দায়ী করতে চেয়েছে অভিবাসী মানুষদের। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাজের সন্ধানে ফ্রান্সে গিয়ে এই অভিবাসীরা নিজেদের সস্তা শ্রম দিয়ে সে দেশের সম্পদ গড়ে তুলছেন। পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসাবে ইউরোপের দেশে দেশে বর্ণবিদ্বেষের মতো কুৎসিত মানসিকতার বাড়বৃদ্ধিতে মদত দিচ্ছে দক্ষিণপন্থীরা। জনসাধারণের বিক্ষোভ যাতে সংগঠিত আন্দোলনের আকারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই টলিয়ে না দেয়, তাই পুঁজিপতি শ্রেণি এই দক্ষিণপন্থী শক্তিকে অর্থ দিয়ে, প্রচার দিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে। জনসাধারণের একটা অংশ এতে বিভ্রান্তও হচ্ছেন। ফলে শুধু ভারতেই নয়, ফ্রান্স সহ ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, জার্মানির মতো দেশগুলিতেও ইদানীং দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু পেট বড় বালাই। তাই বেকারি-গরিবি-মূল্যবৃদ্ধি-বৈষম্যের আঘাতে জর্জরিত ফ্রান্সের মেহনতি মানুষকে বার বার নামতে হয়েছে আন্দোলনের রাস্তায়। তাঁদের একটা বড় অংশ বুঝতে পেরেছেন, ঠেকে শিখেছেন যে, ন্যাশনাল ব়্যালির বিভেদমূলক, কর্পোরেটমুখী রাজনীতি তাঁদের সমস্যা সমাধানের কোনও রাস্তাই দেখাতে পারছে না। তাই তাঁরা সমবেত হয়েছেন বামপন্থীদের পতাকার নিচে। এবারের নির্বাচনে বাম-জোট এনএফপি জনসাধারণের স্বার্থবাহী নানা দাবি তুলেছিল। স্লোগান উঠেছিল– মাসিক ‘ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে হবে, অবসরের বয়স কমিয়ে ৬০ বছর করতে হবে, সরকারকে আগামী ৫ বছরে ১০ লক্ষ কম-ভাড়ার নতুন আবাসন তৈরি করতে হবে, খাদ্যদ্রব্য, গ্যাস ও জ্বালানির দাম বাড়ানো চলবে না ইত্যাদি। বামপন্থীরা দাবি করেছিলেন, অতি-ধনী ও অতিরিক্ত মুনাফার উপর কর চাপিয়ে সরকারকে সেই টাকা জনকল্যাণে খরচ করতে হবে। ফলে সমর্থন বেড়েছে এনএফপি-র। এবারের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে পিছু হঠতে হয়েছে অতি-দক্ষিণপন্থীদের। ঠিক যেমন ভারতেও সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে হয়েছে বিজেপি-কে।
ফ্রান্সের এই বামপন্থী জোট এনএফপি গড়ে উঠেছে কমিউনিস্ট, সোসালিস্ট, পরিবেশবাদী ইত্যাদি বেশ কয়েকটি দলের ঐক্যের ভিত্তিতে। যেহেতু কোনও দলই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, তাই বামপন্থীদেরও ক্ষমতায় বসতে হলে বুর্জোয়াদের তল্পিবাহক ম্যাক্রঁর দলের সঙ্গে জোট করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বামপন্থীদের তোলা দাবিগুলি কার্যকর করতে গেলে বাধা দেবে ম্যাক্রঁর দল। সে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণিও চাইবে না সেগুলি মানতে। তাই আগামী দিন কেমন যাবে তা নির্ভর করছে বামপন্থী নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা এবং জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতার উপর। ফলে ফ্রান্সে বামপন্থীদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস কতখানি তাঁরা দেখাতে পারবেন, তার উপর নির্ভর করছে তাদের নিজেদের এবং ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ।