Breaking News

ফ্রান্সে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তিকে রুখে দেওয়ার আহ্বান ফুটবলার এমবাপের

‘‘ফুটবলার হতে পারি, তবে আমরা সবার আগে দেশের নাগরিক। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলে থাকেন ফুটবলের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা ফ্রান্সের পরিস্থিতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারি না।’’–সম্প্রতি দেশের যুবসমাজকে সরাসরি চরম দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই কথা বললেন বিশ্বখ্যাত ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপে। খেলার মাধ্যমে প্রভূত খ্যাতি ও অর্থের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শুধু সেই ক্ষুদ্র জগতে বন্দি হয়ে না থেকে সমাজ-রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে উচ্চ মূল্যবোধের পরিচয় দিলেন তিনি।

৩০ জুন ও ৭ জুলাই ফ্রান্সে দু’রাউন্ডের নির্বাচন হতে চলেছে। এই নির্বাচনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ন্যাশনাল ব়্যালির নেত্রী মারিন লে পেন। ন্যাশনাল ব়্যালি একটি অতি দক্ষিণপন্থী দল। তার শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে বিগত ১০ বছরে। উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে দেশের ঐক্য ও সংহতিকে বিনষ্ট করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই দক্ষিণপন্থী শক্তির সাম্প্রতিক কার্যকলাপে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন জাতি ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপর্যয়কর ফলাফলের পর মাকরঁ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। তাঁর সময়ে দেশের আর্থিক দুরবস্থা, অভিবাসন নীতি, ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানো প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে নাগরিকদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। জনপ্রিয়তা হারান মাকরঁ। এই সুযোগ নিয়ে ফ্রান্সে মাথা তুলতে শুরু করে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাচনে তারা বিপুল সাফল্য পায়। কিন্তু নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী এই শক্তির উত্থানে দেশের চিন্তাশীল, মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ যে বিচলিত তা বিভেদকামী, ফ্যাসিবাদী নীতির পৃষ্ঠপোষক অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের অসংখ্য মানুষকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনায় সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে।

বিপজ্জনক এই শক্তির উত্থান কী ভাবে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে তা এমবাপের মন্তব্যেই পরিষ্কার। গ্রুপ ডি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগের দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ফরাসি অধিনায়ক তার অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে বললেন, ‘আমি কিলিয়ান এমবাপে যে কোনও চরম মতের বিরোধী। যা মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, সেই ভাবনারও বিরোধী। আমি ফ্রান্সের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি, এর জন্য গর্ববোধ করি। তাই আমি এমন কোনও দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না, যারা আমার বা আমাদের মনুষ্যত্বের গুরুত্ব দেবে না।’ এর কয়েকদিন আগে ফ্রান্সের আর এক ফরওয়ার্ড মারকাস থুরাম বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিদিন লড়তে হবে, যাতে ন্যাশনাল ব়্যালি ক্ষমতায় না আসে।’ থুরাম-এর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে এমবাপে আরও বলেন, ‘অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ম্যাচ গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু খেলার চেয়েও দেশের ভবিষ্যৎ বেশি জরুরি।’ স্বাভাবিক সময়ে সরাসরি রাজনীতির কথা না বললেও সংকটকালে একজন খেলোয়াড়েরও যে নীরব থাকা উচিত নয়, তাও তিনি মনে করিয়ে দেন।

ফ্রান্সের সংকটজনক মুহূর্তে, যখন উগ্রপন্থী শক্তি দরজায় কড়া নাড়ছে, যখন মানবতা ও মূল্যবোধ বিপন্ন তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যে আহ্বান ফরাসি ফুটবল দলের অধিনায়ক দেশের যুবসমাজের কাছে রাখলেন তা সকলের কাছে অবশ্যই দৃষ্টান্তস্বরূপ। কোনও মানুষই রাজনীতির উর্ধ্বে নন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি প্রতিনিয়ত মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। এই সত্যকে অস্বীকার করে নিরপেক্ষতার নামে এক শ্রেণির মানুষ সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, তখন এমবাপের বক্তব্য অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

কিছুদিন আগে ভারতে মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে আন্দোলনের সামিল হতে দেখা গিয়েছিল বেশ কয়েকজন প্রথম সারির কুস্তিগিরকে। এই আন্দোলনে সমর্থনে সরব হয়েছিলেন আরও কয়েকজন ক্রীড়াবিদ। ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী সহ বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশিষ্ট নাগরিক এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এলেও সকলেই সেই ভূমিকা নিতে পারেননি। অথবা আজ যখন আমরা দেখছি পূর্বতন কংগ্রেসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমানে বিজেপি ক্ষমতায় থেকে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদের বাতাবরণ সৃষ্টি করে চলেছে, শিক্ষা- সংস্কৃতি-মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদি চিন্তার প্রসার ঘটাচ্ছে এবং একজন সমাজ সচেতন বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারছি না, তখন অবশ্যই এমবাপের বক্তব্য আমাদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ।