মুনাফার স্বার্থে বিদ্বেষমূলক ও ভুয়ো তথ্য ঠেকানোর দিকে নজর দিচ্ছে না ফেসবুক়। আজকের দুনিয়ায় এই সমাজমাধ্যমের ব্যবহারের পরিধি বিশাল। অথচ এই মাধ্যমটি আমাদের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং গণতন্ত্রের পক্ষে ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে আনছে। আমরা এমন একটি তথ্য-নির্ভর পরিবেশে আছি যা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং বিভেদমূলক বিষয়বস্তু দিয়ে ভর্তি। এটি ব্যক্তির নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে এবং অন্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস কমাতে থাকে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত হিংসারও জন্ম দিচ্ছে ফেসবুক। কথাগুলো যে কেউ বলেছেন না–দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সমাজ মাধ্যম ফেসবুক, যার মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৮০কোটি, তার সম্বন্ধে এই মারাত্মক অভিযোগ তুলেছেন তাদেরই প্রাক্তন কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন। ২০১৯-এ এই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারকে তাদের সিভিল ইন্টিগ্রিটি টিমের একজন কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করে ফেসবুক। এই দলটি তৈরি করা হয়েছিল বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ রোখা ও নির্বাচন চলাকালীন ভুয়ো তথ্যের প্রচার ঠেকানো জন্য। কিন্তু ২০২০ তে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর ফেসবুক এটিকে বন্ধ করে দেয়। ফ্রান্সেসের মতে, এটি গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। যত দিন যেতে থাকে ফ্রান্সেস বুঝতে পারেন যে, ফেসবুক ফেক-নিউজ, গুজব, হিংস্রতার মতো বিষয়গুলিকে আটকানোর বিষয়টা আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না।
এর ফলে বিশ্বের নানা জায়গায় ফেসবুক মারফত প্রচারিত মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক খবরকে ভিত্তি করে জাতপাত-ধর্ম- বর্ণ-ভাষাগত বিষয় নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটছে এবং মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। তাই এ বছর মে মাসে তিনি ফেসবুকের কাজ ছেড়ে দেন। কিন্তু কাজ ছাড়ার আগে কম্পিউটার থেকে ফেসবুকের হাজার হাজার গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হাউগেন ডাউনলোড করে নেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, বিশ্ববাসীর কাছে সমস্ত বিষয়টা উপস্থিত করবেন। কিন্তু ডকুমেন্টের সংখ্যা এত বিশাল যে দু- একজন সাংবাদিকের পক্ষে এটা পড়া ও লেখা সম্ভব নয়। তাই ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, সি এন এন-এর মতো আমেরিকার ১৭টি সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই তা জনগণের সামনে আসে।
এই পুরো প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় ‘দ্য ফেসবুক পেপারস’। ফ্রান্সেস শুধু সংবাদমাধ্যমের কাছে গেছেন তা নয়, আমেরিকার সিকিউরিটি এ’চেঞ্জ কমিশনের কাছে আটটিঅভিযোগ নথিভুক্ত করেছেন ফেসবুকের বিরুদ্ধে। গত ৫ অক্টোবর আমেরিকার সিনেট কমিটির কাছে নিজের সাক্ষ্য নথিভুক্ত করেছেন। হাউগেন বলেছেন যে, তার উদ্দেশ্য ফেসবুকের সুনাম নষ্ট করা নয়, বরং এ থেকে যে বিপদ উপস্থিত হচ্ছে তা থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের রক্ষা করা।
ভুয়ো খবর ও বিদ্বেষমূলক পোস্টকে উৎসাহ দিচ্ছে ফেসবুক
ফেসবুক খুললে আপনি কী দেখবেন, স্ক্রিন স্ক্রোল করতে করতে কী কী ছবি, পোস্ট আমার-আপনার সামনে আসবে, এগুলো কে ঠিক করে? ঠিক করে গাণিতিক কিছু নির্দেশনা, কম্পিউটারের পরিভাষায় যাকে বলা হয় অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমই ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া এবং গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের কী কী দেখতে উৎসাহিত করছে তা বোঝার জন্য গবেষকরা ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে এক ভারতীয়র নামে ডামি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন। তাঁরা এই অ্যাকাউন্টে কোনও লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করেননি। গবেষকরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেন, মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুক তার নিজস্ব অ্যালগরিদমের সাহায্যে ওই অ্যাকাউন্টে ভুয়ো সংবাদ, শিরোচ্ছেদের ছবি, বিদ্বেষ-উত্তেজনা-হিংস্রতা ভরা ছবি বা খবর তুলে ধরছে। আরও দেখা গেল, যে এই সব পোস্টগুলো সবই পাকিস্তান ও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। গবেষকরা আরও দেখলেন, যদি ফেসবুক তার অ্যালগরিদমের সাহায্যে একজন ব্যবহারকারী কী চায় তা বুঝতে না পারে তাহলে, সে নিজেই তাকে অশ্লীল ভিডিও ও পর্ণোগ্রাফিও পাঠাচ্ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানায় যে, বিষয়টি তাদের নজরে আসতেই তারা অ্যালগরিদম পরিবর্তন করেছে।
ফেসবুকের দাবি সঠিক নয়
নথি দেখাচ্ছে ফেসবুক মুখে যা বলে, বাস্তব তা নয়। প্রথমত, স্বচ্ছতার জন্য ফেসবুক যত অর্থ ব্যয় করে তার সিংহভাগই আমেরিকার জন্য (৮৭ শতাংশ), বাকি বিশ্বের জন্য খুবই নগণ্য। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের পোস্টকে চিহ্নিত করার মতো প্রযুক্তিরও অভাব আছে ফেসবুকে। ভারতে মোট কুড়িটি ভাষায় ফেসবুক চললেও মাত্র পাঁচটি ভাষায় এই ধরনের প্রযুক্তি আছে। ২০২০-র এপ্রিল মাসের আগে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ভুয়ো খবর ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট চিহ্নিত করার মতো অ্যালগরিদম ফেসবুকের ছিল না। ফেসবুক দাবি করে যে, প্রযুক্তি না থাকলেও এই কাজে সে ভারতে পনেরো হাজার কর্মী নিয়োগ করেছে। কিন্তু ফেসবুক পেপারস দেখাচ্ছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষ নয়। ‘অ্যাডভারসিয়াল হার্মফুল নেটওয়ার্কস ইন্ডিয়া কেস স্টাডি’ নামের একটি ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে ফেসবুক যত পোস্ট রিমুভ করেছে, তার থেকে বহুগুণ বেশি বিদ্বেষ ও বিভেদমূলক পোস্ট, ভুয়ো খবর, উত্তেজক ভিডিও জেনে বুঝে রেখে দিয়েছে। আরএসএস ও তার বিভিন্ন শাখা সংগঠন, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যদি এই ধরনের পোস্ট করে তা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো সরায়নি ফেসবুক। এই সমস্ত ব্যক্তিদের বিপজ্জনক বলে নিষিদ্ধও করেনি।
২০১৯-এ ‘আভাজ’ নামেএকটি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার প্রতিনিধি আলফিয়া জোয়ার ফেসবুকের ভারতীয় কর্মীদের সঙ্গে একটা ভিডিও মিটিংয়ে ১৮০টি এমন পোস্টের উদাহরণ দেন যেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। জোয়ার দেখান, অসমে এক বিজেপি নেতা ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ তুলে মুসলিম বিরোধী পোস্ট ছড়িয়েছেন। মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, বিজেপি নেতা টি রাজা ফেসবুকে মুসলিম বিরোধী এক ভয়ানক উত্তেজক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখেন, মুসলিমদের প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকিও দেন। ফেসবুক কর্মীরা তাকে বিপজ্জনক বলে বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বাধা দেন ভারতে ফেসবুকের সর্বোচ্চ পাবলিক পলিসি এক্সিকিউটিভ অফিসার আঁখি দাস। তিনি বলেন, বিজেপির কোনও নেতাকে শাস্তি দিলে বা নিষিদ্ধ করলে ভারতে ফেসবুকের ব্যবসা মার খাবে। বিষয়টি সামনে আসায় তীব্র প্রতিবাদের জেরে দু’মাসের মধ্যে আঁখি দাসকে পদত্যাগ করতে হয়। ফেসবুকের প্রাক্তন নিরাপত্তা আধিকারিক অ্যালে’ স্টামোস বছর দুয়েক আগে টুইটারে লেখেন, ‘ফেসবুকের মুখ্য সমস্যা হল আমাদের নীতিনির্ধারকদের সরকারকে খুশি করতে হয়, আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নিয়মও মানতে হয়। স্টামোস বলেছিলেন, স্থানীয়ভাবে ফেসবুকে যাদের নীতিনির্ধারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়, তারা বেশিরভাগ শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হন। ২০২০-র ডিসেম্বরে আরও একটা লেখায় দেখা যায়, বজরং দল ভারতে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মারাত্মক বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়াচ্ছে। এদের নিষিদ্ধ করারও দাবি ওঠে। কিন্তু ফেসবুক সেই সাহস দেখাতে পারেনি। এরকম ঘটনা শুধু ভারতে নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ঘটছে।
মেরুকরণে মদত দিচ্ছে সোসাল মিডিয়া
২০০৩-০৪ সালে ফ্রেন্ডস্টিয়ার, মাইস্পেস ও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম যখন শুরু হয় তখন এর উদ্দেশ্য ছিল খুব সাধারণ। বলা হয়েছিল নানা ভাবনা ও মতবাদের পরিচিত-অপরিচিত মানুষকে এক মঞ্চে নিয়ে আসা, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে মতবিনিময় করা এবং তার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে তোলা, পরস্পরকে যুক্ত করাই এর উদ্দেশ্য। অবস্থা বদলাতে শুরু করলো ২০০৯ থেকে, যখন ফেসবুক ‘লাইক বাটন’ আর টুইটার ‘রিটুইট ফিচার’ নিয়ে এলো। শুরু হল লাইক পাওয়া আর ফলোয়ার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। কমেন্টস অনেক ক্ষেত্রেই আগের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ থাকল না, হয়ে উঠল যে কোনও উপায়ে ‘আমি ঠিক, আর তুমি ভুল’ প্রতিপন্ন করার মাধ্যম। ফেসবুক বদলে দিল তার ‘নিউজ ফিড অ্যালগরিদম’।
ঠিক কী হল এই বদলের ফলে? আগে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট ও ভিডিও সবটাই সময়ানুসারে আসত অর্থাৎ নতুন পোস্ট সবার আগে দেখা যেত। ফলে একটা বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্যও দেখতে পাওয়া যেত। নতুন অ্যালগরিদম চালু হবার পর ফেসবুক আপনাকে সেটাই শুনতে ও দেখতে দেয় যা আপনি চান। ব্যবহারকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে যন্ত্র ঠিক করে নেয় মূলত কী ধরনের পোস্ট তিনি দেখবেন। অ্যালগরিদম যাকে সমমনস্ক মনে করছে সেই ‘বন্ধু’র নাম, তাকে অ্যাড করার সাজেশন, পছন্দসই গ্রুপ এবং কিছু কিছু নির্বাচিত পোস্ট বারবার আসতে থাকে। অর্থাৎ অ্যালগরিদম শুধু আপনি যা চান তা-ই দেখায় না, এমনভাবে পোস্ট দেখাতে থাকে যা আপনার চাওয়াটাকেই প্রভাবিত করতে পারে। ফলে ক্রমাগত একই ধরনের পোস্ট দেখতে দেখতে এবং লাইক শেয়ার করতে করতে অত্যন্ত দ্রুততায় বাস্তব দুনিয়ার সমান্তরাল একটা ভার্চুয়াল দুনিয়া গড়ে ওঠে। যেখানে কোনও বিষয় খবর নিয়ে যাচাই করা বা তলিয়ে ভাবার চেয়ে ফরোয়ার্ড করা বা শেয়ার করার তাগিদ অনেক ক্ষেত্রেই অসত্য খবর ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে এবং একই সাথে যে কোনও মত বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধ মত শোনর বা বোঝার পরিসর কমে আসে।
ফেসবুক সহ যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দরকার প্রচুর বিজ্ঞাপন, তার জন্য দরকার অনেক বেশি ট্রাফিক অর্থাৎ বার্তা চলাচল। অর্থাৎ এক কথায় ব্যবহারকারীরর সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের অনেক বেশি সময় ফেসবুকে ব্যস্ত রাখা। এ ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী বিদ্বেষমূলক, সাম্প্রদায়িক এবং উত্তেজক পোস্ট। দেখা গেছে, জনগণের ঐক্য-সম্প্রীতি, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো, এমনকি মানুষের প্রাণরক্ষারও তোয়াক্কা না করে এই ধরনের পোস্টগুলিকেই ফেসবুক বেশি প্রমোট করছে। বেশি লাইক কমেন্ট পাওয়ার ঝোঁক থেকে এধরনের আক্রমণাত্মক পোস্ট করার প্রবণতাও বাড়ছে। ২০১৫-তে ফেসবুক চালু করল নতুন ছ’টি বাটন–লাভ, হা হা, ইয়া, ওয়াও, স্যাড, অ্যাংরি। দেখা গেল যে পোস্টে অ্যাংরি ইমোজি পড়ছে সেই পোস্টকে বেশি প্রমোট করতে শুরু করল ফেসবুক। ফেসবুক গবেষকরা বলছেন, এই ধরনের পোস্টে পাঁচগুণ বেশি এনগেজমেন্ট আসে, ফলে মুনাফার সুযোগ আরও বেশি। অথচ দেখা গেছে এই ধরনের পোস্টগুলোই বহুক্ষেত্রে ভুয়ো এবং নিম্নমানের হয়।
সুতরাং মোদ্দা কথা দাঁড়াল, যুক্তিসঙ্গত সঠিক তথ্য বা বিচার বিবেচনার খুব একটা জায়গা ফেসবুকে নেই। তথ্যের প্রামাণ্যতা বা যুক্তিবোধের চেয়ে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া। ফলে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারছে, বিভেদমূলক মানসিকতাকে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কতদূর হতে পারে তার প্রমাণ আমেরিকায় ক্যাপিটাল রায়ট, মায়ানমারের ক্যুপ এবং ইথিওপিয়ায় জাতিগত দাঙ্গা, পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা মেনে নিয়েছেন এই ঘটনাগুলোয় ফেসবুকের প্রভাব ছিল যথেষ্ট।
২০১৯-এ ‘প্রজেক্ট ডেইজি’ নামে একটি ইন্টার্নাল প্রজেক্ট নিয়ে আসে ফেসবুক। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য লাইক বাটনটাকে হাইড করার (লুকিয়ে ফেলা) প্রস্তাব দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, কম লাইক পাওয়া থেকে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও হতাশা কমানো। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ফেসবুকের মালিক মার্ক জুকেরবার্গ তা বাতিল করে দেন। ওই একই বছরে ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরও একটা গুরুতর অভিযোগ ওঠে যে, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে মানুষ পাচারের মতো ঘটনাও ঘটছে। মার্ক জুকেরবার্গ এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নিয়েও বলেছেন যে একদল বেছে বেছে ফেসবুকের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরে তার বদনাম করতে চাইছে। কিন্তু ফেসবুক পেপারসে যা আছে তার পুরোটা যদি জনগণের সামনে রাখা যায়, মানুষ জানতে পারবে, সেখানে বাছাই করে বলার কোনও জায়গা নেই। সম্পূর্ণটাই মুনাফার স্বার্থে ফেসবুক কী কী কুকীর্তি করছে তার নজির। সংবাদমাধ্যমের মতো সমাজমাধ্যমেরও দায়িত্ব হওয়া উচিত সত্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করা।
কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় গণমাধ্যমের এই ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য তাকে মিথ্যের সাথে আপস করতেই হয়। নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে মুনাফাকেন্দ্রিক নীতি নিতেই হয়। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সমাজে গণতন্ত্রের খোলসে মানুষের সমস্ত কিছু এমনকি হৃদয়বৃত্তিকেও যেখানে একচেটিয়া পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, সেখানে সমাজমাধ্যম এর বাইরে থাকতে পারে না। ফেসবুক পেপারসের তথ্য আবার প্রমাণ করল, বহুজাতিক পুঁজি পরিচালিত ফেসবুকও এর ব্যতিক্রম নয়।