এ রাজ্যে প্রায় প্রতি বছর বন্যায় জনজীবনের চরম দুর্দশা, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি যেন অনিবার্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন এর কোনও প্রতিকার নেই। এমনকি দুর্গত মানুষদেরও কেউ কেউ মনে করেন, প্রকৃতির মার কি আটকানো সম্ভব! ফলে সরকারগুলি মাঝে মধ্যে কোনও রকমে কিছু বাঁধ বানিয়ে অথবা ভাঙা বাঁধে একটু মাটি ফেলে আর যৎসামান্য ত্রাণ বিলি করেই দায় সারে এবং এসব করতে গিয়ে শাসকদলের মদতপুষ্ট ক্ষমতাশালীরা নানা দুর্নীতি করে আখের গোছায়। বছরের পর বছর ধরে এই চলছে। মানুষ মাঝে মাঝে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, আবার কিছু দিন পরে স্তিমিত হয়ে যায়। বিপদে বুক পেতে তারা বাঁধ আগলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তাতেও রাষ্ট্রের টনক নড়ে না। অথচ এই মানুষেরাই নানা ভাবে শ্রম দিয়ে সভ্যতাকে সচল রাখে। বিনিময়ে তারা হয়তো বা একটু ত্রাণ পায় কিন্তু পরিত্রাণ পায় না।
দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে ৭৫ বছর। তবুও বন্যার ধ্বংসকাণ্ড থেকে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার কাজ বহুলাংশেই অধরা থেকে গেল কেন? এর উত্তর একটাই, সাধারণ মানুষের প্রতি ভারতের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অনন্ত অবজ্ঞা আর অসীম উদাসীনতা।
যেমন, দক্ষিণবঙ্গ। এখানে আমফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সমুদ্রের জল ঢুকে প্লাবিত হয়েছে বহু জনপদ। সরকারি হিসাবেই বাঁধ ভেঙেছে ২৮ কিলোমিটার। ৭৬ কিলোমিটার নদীবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবনের নদী বাঁধের ভাঙন আটকানো যায়নি। ৭১টি স্থানে সেই নদী বাঁধ ভেঙেছে। আয়লার সময় ১৭৭ কিলোমিটার বাঁধ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে ৭৭৮ কিলোমিটার বাঁধে আংশিক ক্ষতি হয়েছিল। এই সমস্ত বাঁধ পুনর্নিমাণ কবে হবে বা আদৌ স্থায়ী বাঁধ তৈরি করা হবে কিনা তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। এই সব জায়গায় বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে, হয় হাতিবাঁধ যা ৫.৮ মিটার উঁচু বা সমুদ্রবাঁধ যা ৭.২ মিটার উঁচু করতে হবে। ৪০ মিটার ভিতের এই বাঁধ আটকাতে পারবে জোয়ারের জল। এছাড়া নদীর দিকে বাঁধের সামনে ম্যানগ্রোভ আর জমির দিকে সুন্দরী গাছ বসাতে হবে। কিন্তু এই সব কাজ হবে কবে? গড়িমসি, অবজ্ঞা, অবহেলা চলছেই। দপ্তরে দপ্তরে ঠেলাঠেলি, কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর চলছে। বছরের পর বছর ধরে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
উত্তরবঙ্গে বন্যার তাণ্ডব থেকে বাঁচার অন্যতম পথ, বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীগুলোর উপরের অববাহিকাতে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। এছাড়া, যে বহু ছোট ছোট শাখানদীগুলোকে নানা কারণে প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে সেগুলোকে সংস্কার করে দ্রুত জলনিকাশি স্বাভাবিক পথ তৈরি করে দেওয়া। যেমন, ১৯৫৯ সালে জলঙ্গি-করিমপুর রোড তৈরির সময়ে সরকারি উদ্যোগে জলঙ্গি নদী বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর অনেকেই নদীর বুকে মাটি ফেলে আবাদী জমি বাড়িয়ে নিয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ, তেহট্টের এক ঘাট মালিক জানিয়েছেন, প্রতি শীতে তিনি ৭০ থেকে ৮০ লরি মাটি ফেলে নদীর দু’পাড়কে কাছে আনেন। তারপর নদীর বুকে খান চারেক নৌকো বেঁধে তার উপর তক্তা ফেলে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করেন। এর বাইরে আছে মৎস্য সমবায়গুলি। যারা লিজের নামে নদী যেন কিনেই ফেলেছে এমন মেজাজে নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে ব্যবসা করছে। এ সবই চলে শাসকদলের প্রশ্রয়ে। শাসকদলের নেতারা কাটমানি নেয় আর হাজার হাজার মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
এর পর আছে ডিভিসি নামক জুজু। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নদী বিশেষজ্ঞরা বহু প্রশ্ন তুলেছিলেন যা আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু রাষ্ট্রের তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। তাই এই প্রকল্পের কোনও সংস্কারও নেই। ডিভিসির ছাড়া জলে বন্যা লেগেই থাকে। এখনও সেই বিপর্যয় চলছে। ডিভিসির এক কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘আমেরিকার ‘টেনেসি ভ্যালি প্রকল্প’-এর অনুসরণে পরিকল্পিত এই প্রকল্প রূপায়ণের ভার দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার ডবলিউ এল ভরদুইন-এর উপর। …ভরদুইনের নকশা অনুযায়ী মূল প্রস্তাবে ৭টি স্টোরেজ ড্যাম ও একটা ডাইভারশন ড্যাম তৈরি করার প্রস্তাব ছিল। …চারটি ড্যাম তৈরি হল। এর পরেই শুরু হল বাংলা-বিহার বিতর্ক। বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্র থেকে অর্থ বরাদ্দ। চারটি বাঁধ আর তৈরি হল না। ভরদুইনের প্রস্তাবের এক-তৃতিয়াংশ রূপায়িত হল। ওই কর্মকর্তা আরও লিখেছেন, ‘যে চারটি বাঁধ তৈরি হল, দেখা গেল তাতে ১০.৪৩ লক্ষ একর ফুট জল নিয়ন্ত্রণ এবং ৯.৭৫ লক্ষ একর ফুট সেচের জল ‘লাইভ স্টোরেজ’ করে রাখা সম্ভব। ১৯৫৯ সালের এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, জল ধরে রাখতে না-পারার ক্ষমতা অর্থাৎ ডিভিসির এই বিকলাঙ্গতা তার জন্মসূত্রেই পাওয়া।’ ২০০০ সালে প্রবল বন্যার সময় বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছিলেন, ডিভিসি-র জলাধারগুলোর ধারণ-ক্ষমতা কিছুটা বাড়াতে হলেও বছরে শীতের সময় অন্তত একটির পলি তুলে ফেলা দরকার। প্রয়োজনে কোনও দূরবর্তী স্থানে জল সরিয়ে রেখে এটা ধাপে ধাপে করা দরকার। যদিও গত বিশ বছরে তেমন কোনও উদ্যোগ হয়নি।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ঘটনা আরও ভয়াবহ। এক সমাজকর্মীর ভাষায়, ‘ফি বছর ঘাটাল মহকুমায় নিয়ম করে বন্যা হয়। বানভাসি হয় ঘাটাল, চন্দ্রকোনা ১ ও ২ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। নিঃস্ব হন বহু মানুষ। প্রশাসন থেকে শাসকদলগুলি আশ্বাস দেয়, পরের বার ঠিক সমাধান হয়ে যাবে। বছরের পর বছর আসে, কিন্তু সেই আশ্বাস ভেসে যায় বন্যার জলের তোড়ে। তিনি দেখিয়েছেন, ‘…জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভা ১৯৫৯ সালে ঘাটাল-সহ সংলগ্ন এলাকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য অর্থনীতিবিদ মান সিংহের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই কমিটি রিপোর্ট পেশ করতেই পেরিয়ে যায় ২০ বছর। ১৯৭৯ সালে ওই কমিটির পেশ করা রিপোর্টের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। ১৯৮২ সালে ঘাটাল শহরের শিলাবতী নদীর ধারে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সূচনা হয়েছিল। তখন প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা। প্রাথমিক ভাবে ৩০ লক্ষ টাকা অনুমোদনও হয়। ১১৮ কিলোমিটার নদী বাঁধ নির্মাণ-সহ নানা কাজ ওই প্রকল্পে ছিল। ঘাটাল শহরের পূর্ব পারে শিলাবতীর ধারে রুপোর কোদাল দিয়ে তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় সেই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। কিন্তু কাজ শুরুর কিছু দিন পরেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে একাধিক বার এই প্রকল্প অন্ধকারে তলিয়ে গেছে।
এসব ঘটনা জনস্বার্থের প্রতি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অবহেলাকেই প্রমাণ করে। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের নানা পরামর্শ তারা কার্যত ডাস্টবিনে ফেলে দেন। প্রাকৃতিক উপায়ে নদী এবং নদীবাঁধের ভাঙন ঠেকাতে গবেষকরা জানিয়েছেন, নদীর পাড় বা বাঁধের ক্ষয় রোধে কাশ, কুশ, সর, ইরাগ্রসট্রস, সায়ানইডিস ইত্যদি প্রজাতির গাছ নদীর পাড়ে লাগালে সেগুলি নদীর পাড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখে। গাছগুলি লম্বায় সাধারণত দশ-বারো ফুট হলেও মাটির নীচে চলে যায় প্রায় ২০-২৫ ফুট। ফলে ওই শেকড় মাটির অভ্যন্তরকে যেমন আঁকড়ে ধরে রাখে তেমনি মাটির উপরিভাগকেও দৃঢ় করে। এসবের প্রয়োগেও দেখা যাচ্ছে একই অবহেলা। অবাধে বালি চুরি চলে শাসকদলের মদতে। ফলে, এই ধরনের প্রয়োগে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা।
প্রযুক্তিগর্বোদ্ধত এই একুশ শতকে গ্রামের মানুষকে জীবন বাজি রেখে বুক দিয়ে বাঁধ আগলাতে হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মার্কিন সাহিত্যিকের লেখা হল্যান্ডের (এখন নেদারল্যান্ডস) কল্পচরিত্র হান্সের কথা মনে পড়ছে আমাদের। মজার ব্যাপার হল, হান্সের বীরত্বকে মর্যাদা দিয়ে হল্যান্ড শুধু হান্সের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেনি, বন্যা প্রতিরোধে বিশ্বে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। যে হল্যান্ডের এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রসীমার নিচে এবং দুই-তৃতীয়াংশ বন্যাপ্রবণ সেই দেশ আজ বন্যা প্রতিরোধে বিশ্বের পথপ্রদর্শকের স্তরে উন্নীত।
আমাদের দেশের মন্ত্রীরা সে দেশে গিয়ে নানা বাণিজ্যিক চুক্তি করেন কিন্তু বন্যা প্রতিরোধে তাদের পারদর্শিতা নিশ্চিন্তে এড়িয়ে যান। ভারতে ঝড়-বন্যার প্রকোপ থেকে জনজীবনকে রক্ষা করতে কোনও স্থায়ী কর্মসূচির দিকে রাষ্ট্র যাচ্ছে না। মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু করে একেবারে ভাগীরথীর মোহনা পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথীর ভাঙন এক মারাত্মক সমস্যা। এই সমস্যা যে হতে পারে, তা বহু আগেই চিহ্নিত করেছিলেন নদী-বিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্য সহ অনেকেই। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ত্রুটি নিয়েও তাঁরা সরব হয়েছিলেন। ভাঙন, বন্যা, খরা একই সমস্যার এ পিঠ-ও পিঠ বলেও কিছু বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন। এই সমস্যা সমাধানে একদিকে নদীর উচ্চগতিতে জল ধরে রাখার জন্য জোড়বাঁধ, পুকুর খনন, ছোট জলাশয় তৈরি ইত্যাদি নানা পদ্ধতির কথা বারবার সরকারকে তাঁরা বলেছেন। মধ্য এবং নিম্নগতিতে বাঁধের সঠিক ঢাল তৈরি করা যাতে স্রোতের গতিমুখ বাধা না পায়, আবার বাঁধও না ভাঙে– তা নিশ্চিত করার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা আজ মানুষের জানা। নদীকে পলিমুক্ত রাখার জন্য ভূমিক্ষয় রোধ এবং নিয়মিত ড্রেজিং ইত্যাদি নানা পরামর্শ সরকারকে যেমন বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, তেমনি ‘খরা-বন্যা-ভাঙন প্রতিরোধ কমিটি’ও বারবার একই সুপারিশ করেছে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের কোনও সরকারই তা শোনেনি। পরিবেশবিদ, প্রযুক্তিবিদ, নদী বিজ্ঞানী, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ও ভূগোলবিদদের যুক্ত কমিটির পরিকল্পনা কার্যকরী করার পথেই আছে সমাধান, অবশ্যই তা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত হতে হবে।
আমাদের মতো বন্যাপ্রবণ দেশে কেন সরকারগুলো তেমন কোনও কার্যকরী উদ্যোগ নেয় না, ভাবতে আশ্চর্য লাগে। এমনকি, বন্যার সময় অস্থায়ী যে ন্যূনতম পূর্ব পরিকল্পনা যেমন– ক) জলবন্দি মানুষের বাসস্থানের সুবিধা প্রদানের জন্য বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা, খ) বন্যাকবলিত মানুষদের পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয় বিশেষ করে শিশুদের খাদ্য, গবাদিপশুর খাদ্য সরবরাহের জন্য সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি ও তা সক্রিয় রাখা, গ) বন্যার জল নেমে গেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে প্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রস্তুত রাখা, ঘ) বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, ঙ) বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র কৃষকদের বিনামূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক দেওয়া, জমি থেকে বালি অপসারণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সরকারকে আশানুরূপ পাওয়া যায় না।
এত বড় অন্যায় আর চলতে দেওয়া যায় না। অতীতের স্তিমিত আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ইতিমধ্যেই ইয়াস পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে ‘সুন্দরবন নদীবাঁধ ও জীবন জীবিকা রক্ষা কমিটি’ ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছে। এই ধরনের আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। কেন না, ইতিহাসের শিক্ষা, জনস্বার্থকে কাঙ্খিত অগ্রাধিকার এবং যথোচিত মর্যাদা দিতে পারে গণআন্দোলনই।