যে ভাবে মিথ্যা অজুহাত তুলে দেশে দেশে হানাদারি চালিয়ে আসছে আমেরিকা, সেই একই কায়দায় ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধেও আগ্রাসনের ষড়যন্ত্র করছে তারা৷ দেশের মধ্যে সরকার বিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিয়ে, কলম্বিয়ার ড্রাগ মাফিয়াদের নামিয়ে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকাকে ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা৷ যদিও ভেনেজুয়েলার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও গণতন্ত্র বিপন্নতার যে অভিযোগ আমেরিকা তুলছে তার জন্য মূলত দায়ী তারাই৷
আমেরিকার বাণিজ্যিক ও আর্থিক অবরোধের জন্যই ভেনেজুয়েলার জনগণ এই অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখে৷ অথচ ভেনেজুয়েলার শান্তি ও গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য উদ্বেগ যেন তাদেরই কিন্তু তাদের এই চিন্তার আসল কারণ কী? প্রথমত, ভেনেজুয়েলার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রধানত তেল৷ তার থেকেই দেশের প্রধান আয় হয় এবং বিশ্বে তেল সম্পদে চতুর্থ স্থানে ভেনেজুয়েলা৷ এ ছাড়াও আছে সোনা, হীরে ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যার উপর দখলদারি কায়েম করার জন্য উদগ্রীব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷
দ্বিতীয়ত, নিকোলাস মাদুরোর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজের গৃহীত ‘বলিভার মডেল’৷ যে পথে স্যাভেজ নয়া উদারনীতিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়ান৷ স্যাভেজ গৃহীত জনকল্যাণমূলক আর্থিক নীতির লক্ষ্য ছিল, দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, সমস্ত দরিদ্র মানুষকে শিক্ষা–স্বাস্থ্য প্রভৃতি পরিষেবা প্রদান, ধনীদের উপর আয়কর চাপানো, দেশ থেকে অশিক্ষা–বেকারি দূর করতে ব্যবস্থা গ্রহণ, তেল কোম্পানিগুলির রাষ্ট্রীয়করণ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিভিন্ন জনকল্যাণকামী নীতি গ্রহণ করা, যা আমেরিকার স্বার্থে আঘাত করেছে৷
তৃতীয়ত, স্যাভেজের এই পদক্ষেপগুলি শুধু দেশের মধ্যে নয়, আশপাশের অন্যান্য দেশেও প্রভাব ফেলছিল, সমগ্র লাতিন আমেরিকার মানুষকে আকৃষ্ট করছিল৷ বিভিন্ন বামপন্থী শক্তি দ্বারা পরিচালিত প্রগতিশীল সরকারগুলি পরস্পর সহযোগী হয়ে উঠছিল, যারা আগে অনেক ব্যাপারে অনেক বেশি আমেরিকা নির্ভর ছিল তারা সেই নির্ভরতা কমাতে থাকে৷ স্যাভেজের সময়ে লাতিন আমেরিকায় নির্বাচনী রাজনীতিতেও দেখা যায় নতুন বৈশিষ্ট্য৷ ল্যাটিন আমেরিকায় দক্ষিণপন্থীরা অভিযোগ তোলে বামপন্থী মাত্রেই স্যাভেজের সহযোগী৷ লাতিন আমেরিকার দু’টি দেশ মেক্সিকো ও ব্রাজিলের নির্বাচনেও গত বছর এই কথা উঠেছে৷
দেশের সম্পদের ব্যবহার ও বণ্টনের এই নীতি এবং বলিভার মডেল শুধু ভেনেজুয়েলা নয় সমগ্র লাতিন আমেরিকায় যে ভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল৷ হুগো স্যাভেজের মৃত্যুর পর মার্কিন শাসকরা ভেবেছিল ভেনেজুয়েলাকে এবার কব্জা করা যাবে৷ কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সমস্ত রকম প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন৷ দেশের ভিতরে ও বাইরে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান৷ জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে চালিয়ে যেতে থাকেন৷ দেশের শিক্ষা–স্বাস্থ্য–বাসস্থান যতদূর সম্ভব বিনামূল্যে প্রদান করার নীতি গ্রহণ করা হয়৷ সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার সরকার তেইশ লক্ষের বেশি মানুষকে ঘর তৈরি করে দিয়েছে৷ আরও সাত লক্ষ বাড়ি তৈরি রয়েছে যা এ বছরই বন্টন করা হবে৷
এ সমস্ত কারণেই ভেনেজুয়েলা সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়৷ সমগ্র বিশ্বে সুপার পাওয়ার হিসাবে ইতিপূর্বে আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করেছে৷ বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে৷ ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, চিলি, ইয়েমেনের পর এখন ভেনেজুয়েলা৷ গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আসলে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে আমেরিকা, চূড়ান্ত স্বৈরচারী, বিশ্বমানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভেনেজুয়েলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও তার সেনাবাহিনী মাদুরো সরকারের সাথে আছে৷ কোনও দেশের সরকার কে চালাবে, তা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব আমেরিকাকে কেউ দেয়নি৷ ভারতের জনগণ বরাবরই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহ্য বহন করেছে৷ সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই আজ ভেনেজুয়েলায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়ানো দরকার৷