সরকার পাল্টালেই যে রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টায় না, নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন মন্ত্রিসভা আরও একবার স্পষ্ট করে দিল সে কথা। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে জো বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় যাঁরা আশা করেছিলেন, আমেরিকায় এবার খোলা হাওয়া বইবে, প্রগতির পথে হাঁটবে সরকার, বাইডেনের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচন হতাশ করেছে তাঁদের। দেখা যাচ্ছে বাইডেন-প্রশাসনে নির্বাচিত সদস্যদের অনেকেই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী নির্মম হানাদারি ও লুঠতরাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ নীতির কট্টর সমর্থক এই ঝানু আমলাদের সঙ্গে যোগ আছে মার্কিন একচেটিয়া মালিকদের টাকায় পরিচালিত বিভিন্ন পরামর্শদাতা সংস্থা ও অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের।
যেমন ধরা যাক যুদ্ধবাজ অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের কথা। বাইডেন-প্রশাসনের সেক্রেটারি অফ স্টেট পদে মনোনীত হয়েছেন তিনি। কে এই অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন? প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ডেপুটি সেক্রেটারি অফ স্টেট ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে লিবিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্মম হানাদারির পিছনে অন্যতম মাথা ছিলেন এই ব্লিঙ্কেন। গত ১৯ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন, তিনি চান সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চলুক। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবরোধ চালিয়ে যেতে এবং চিনকে চাপে রাখার ধুয়ো তুলে এশিয়া জুড়ে মিসাইল মোতায়েন করতেও চান তিনি। ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ চালাতে কিংবা ভেনেজুয়েলায় নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যে যে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলছে, তার সাথেও তিনি জড়িয়ে। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুবৃত্তিতে আমেরিকার স্যাঙাৎ রাষ্ট্র ইজরায়েলের প্রতিও অসীম দায়বদ্ধতা অনুভব করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে ইজরায়েলের সঙ্গে আমেরিকার যৌথ দস্যুবৃত্তি নীতির প্রবল প্রশংসা ব্লিঙ্কেনের মুখে মাঝেমাঝেই শোনা যায়।
না শোনার কারণ নেই। অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুদিন ধরেই ঘনিষ্ঠ এই ব্লিঙ্কেন। ওবামা আমলে মার্কিন প্রশাসনে নিজের উচ্চ পদটিকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের পরামর্শদাতার লোভনীয় কাজ বাগিয়ে নিতেন ব্লিঙ্কেন। ‘ওয়েস্টএক্সেক অ্যাডভাইসার’ নামের পরামর্শদাতা সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই সংস্থাটির কাজ ছিল সামরিক সরঞ্জাম তথা যুদ্ধাস্ত্র তৈরির সংস্থাগুলিকে গোপন পরামর্শ দেওয়া। এরা ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকার মতো বৃহৎ ব্যাঙ্ক ও বিনিয়োগ সংস্থাগুলিকেও গোপন পরামর্শ দিত। মার্কিন যুদ্ধ-নীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ওবামা-প্রশাসনের বড়কর্তারা, সামরিক কর্তা ও কূটনীতিবিদরা জড়িত ছিলেন এই সংস্থার সঙ্গে।
এবার বাইডেন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন জেনারেল লয়েড অস্টিন। তিনিও যুক্ত ছিলেন এই ওয়েস্টএক্সেক অ্যাডভাইসারের সঙ্গে। পাশাপাশি আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র উৎপাদক সংস্থা রেথিয়নের পরিচালকমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। এই অস্টিন ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সামরিক বাহিনীর কম্যান্ডার ছিলেন। সিরিয়ায় মোতায়েন মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
বাইডেন মন্ত্রিসভার আরও এক সদস্য অ্যাভ্রিল হেইন্স। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর হয়েছেন তিনি। এই হেইন্স যুক্ত ছিলেন ওয়েস্টএক্সেক-এর সঙ্গে। ওবামা আমলে ইনি ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএ-র ডেপুটি ডাইরেক্টর। সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানোয় অভিযুক্ত এই হেইন্স।
সংবাদে বেরিয়ে আসছে, এই ওয়েস্টএক্সেক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মার্কিন সামরিক বাহিনী ও বিদেশ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একযোগে বাইডেনের হয়ে প্রচার চালিয়েছিলেন, সংগ্রহ করেছিলেন বিপুল অর্থ। প্রেসিডেন্ট হয়ে বাইডেন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে এঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।
বেশ কয়েকটি পরামর্শদাতা সংস্থা রয়েছে আমেরিকায়, ধনকুবেরদের স্বার্থে সরকারের ভিতরে ও বাইরে থেকে কাজ করার জন্য যাদের পিছনে বিপুল টাকা খরচ করে সেখানকার ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান– উভয় রাজনৈতিক দল এবং অস্ত্র-ব্যবসার বড় বড় মালিকরা। ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি’-র ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা এবং মার্কিন সরকারের জাতীয় সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা বিভাগ গত পাঁচ বছরে ৫০টি প্রভাবশালী পরামর্শদাতা সংস্থার পিছনে ১০০ কোটি ডলার ঢেলেছে।
এবার বাইডেনের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়েছে এ ধরনের পরামর্শদাতা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী আমলার। যেমন ক্যাথলিন হিকস। আমেরিকার অন্যতম নির্মম একটি পরামর্শদাতা সংস্থা হল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস। এই সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন হিকস। লকহিড মার্টিন সহ আমেরিকার বড় বড় অস্ত্র ব্যবসায়ী সংস্থা বিপুল টাকা ঢালে এর পিছনে। অস্ত্র ব্যবসা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে এদের মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়াই এই সংস্থার কাজ। এবার মন্ত্রিসভায় এলেন এখানকার অন্যতম কর্তা হিকস। কুর্ট ক্যাম্পবেল, ভিক্টোরিয়া নিউল্যান্ডের মতো বাইডেন মন্ত্রিসভার মনোনীত সদস্যরাও এই ধরনের নানা পরামর্শদাতা সংস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত।
যে প্রশাসনে উজ্জ্বল রত্ন হিসাবে শোভিত হচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থবাহী এইসব যুদ্ধবাজরা, তার বড়কর্তা যে ক্ষমতায় বসেই অস্ত্রে শান দেবেন, তা বলাই বাহুল্য। সেই মতোই প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই বাইডেন সরকার হেলিকপ্টার, যুদ্ধজাহাজ, অস্ত্রশস্ত্রে ভরা ট্রাক ইত্যাদিতে সজ্জিত মার্কিন মিলিটারি বাহিনীর একটা বিরাট বহর সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করিয়েছে, সেখানকার খনিজ তেল সহ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন চালানোর উদ্দেশ্যে।
চরম সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অমোঘ নিয়মে ধুঁকতে থাকা মার্কিন অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ধরেই অক্সিজেন জুগিয়ে আসছে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসা। সঠিক ভাবে বলতে গেলে, অর্থনীতিরই সামরিকীকরণ ঘটিয়েছে মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণি। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে দেশে দেশে অবিরাম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধ চালিয়ে দেশের অস্ত্র-ব্যবসায়ী ধনকুবের পুঁজিপতিদের মুনাফার ভাণ্ডার অটুট রাখার কাজ নিখুঁত ভাবেই করে চলেছে আমেরিকার পুঁজিবাদী সরকার। এ বিষয়ে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দলের মধ্যে কোনও পার্থক্যই নেই। মার্কিন রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করতে পুঁজিপতি শ্রেণি সে দেশে কায়েম করেছে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা। অর্থাৎ পুঁজিপতিদেরই স্বার্থ রক্ষাকারী দু’টি দলকে দিয়ে পর্যায়ক্রমে সরকার চালানোর ব্যবস্থা। ট্রাম্পের মতোই বাইডেনও সেই ব্যবস্থার দাবার বোড়ে। ফলে সরকারে যে-ই থাকুন– রিপাবলিকান দলের ট্রাম্প বা ডেমোক্র্যাট দলের বাইডেন, মার্কিন রাষ্ট্রটির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র একই থাকে। নির্বাচনের আগে দুই দল যতই একে অপরের বিরুদ্ধে গলা ফাটাক, সরকারে বসে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষায় এদের প্রণীত নীতি ও কার্যকলাপে বিশেষ পার্থক্য থাকে না। বাইডেনের মন্ত্রিসভায় প্রার্থী মনোনয়ন সে কথাই স্পষ্ট ভাবে বুঝে নিতে সাহায্য করল।