৫ ডিসেম্বর নয়া দিল্লির নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃত্বের সাথে প্রাক বাজেট আলোচনা সভায় মিলিত হন৷ কার্যত প্রতি বছর প্রথামাফিক অনুষ্ঠিত এই মিটিং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার খোলসটুকুকে কেবল ধরে রেখেছে৷ ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেণির যে জ্বলন্ত দাবিগুলি বছরের পর বছর তুলে ধরেন বাস্তবে সেগুলির কোনও সুরাহাই হয় না৷
এ আই ইউ টি ইউ সি–র পক্ষ থেকে এই মিটিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শংকর সাহা৷ তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই অর্থমন্ত্রী প্রাক বাজেট সভা আহ্বান করেন৷ ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের বক্তব্য মনযোগ সহকারে শোনেন, কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাজেটে তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না৷’ দেশের আর্থিক অবস্থার ক্রমাবনতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক সংকট প্রতিদিন গভীর থেকে আরও গভীর হয়ে উঠছে৷ এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ শ্রমজীবী জনসমাজের জীবন ও জীবিকা’৷
‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী ক্ষুধার্তের সংখ্যা তালিকায় ১১৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০০ তম৷ উন্নয়নের খতিয়ান কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়ই দিয়ে থাকেন, কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নের হাল কী এই পরিসংখ্যানেই তার প্রকাশ৷ ১২০ কোটির দেশ ভারতে ২৩কোটি মানুষ ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য দু’মুঠো খাদ্যের সংস্থান করতে পারে না৷ প্রতি বছর ১ কোটি মানুষ দীর্ঘদিন ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে না পারার কারণে অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যায়৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় সুজলা সুফলা এই দেশে প্রতি ১০ সেকেন্ডে ক্ষুধার জ্বালায় একজন মানুষকে মৃত্যুর শিকার হতে হয়৷ সোসিও–ইকনমিক সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতের ৪৯ শতাংশ পরিবার সরকার নির্ধারিত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে৷ ৫০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার অনিয়মিত কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন৷ ৬.৬৮ শতাংশ পরিবার ভিক্ষাজীবী এবং ৪.০৮ শতাংশ পরিবারের জীবন ধারণের উপায় হল কাগজ ও বাতিল জিনিসপত্র সংগ্রহ করা অর্থাৎ যারা কাগজকুড়ানি নামে পরিচিত’৷ এ দেশের কৃষিজীবীদের প্রসঙ্গে কমরেড সাহা বলেন, ‘ইতিমধ্যে দেশের ৩ লক্ষেরও বেশি ঋণভারগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ বিজেপি শাসনে গত দুই বছরে কৃষক আত্মহত্যা ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে’৷ কমরেড শংকর সাহা সারা ভারতের ভিত্তিতে পঞ্চবার্ষিক কর্মসংস্থান/বেকারি সমীক্ষা রিপোর্টের উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের কোনও নিয়মিত উপার্জন নেই অর্থাৎ পরিবারে কোনও বেতন বা নিয়মিত পারিশ্রমিক পান এমন সদস্য নেই৷ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের ৩০ শতাংশের বেশি যুবকের কোনও কাজ নেই বা তারা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত নয়৷ আরও উল্লেখ্য ৩৬৮টি পিওন পদের জন্য ২০ লক্ষ আবেদনপত্র জমা পড়ে যার মধ্যে এম এ পাশ এবং পি এইচ ডি করা প্রার্থীও আছেন’৷
বেকারি, কর্মসংস্থানের চূড়ান্ত অভাব ও কর্মহীনতা বর্তমানে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এক্ষেত্রে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার যে সম্পূর্ণ মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে সেই বিষয়ে কমরেড শংকর সাহা বলেন, ‘২০১৭–র জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাত্র এই চার মাসের মধ্যে ১৫ লক্ষ কর্মসংস্থান বিনষ্ট হয়েছে৷ বিমুদ্রাকরণের এই হল অব্যবহিত ফল৷ ভারতের সর্ববৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে যে বিমুদ্রাকরণের ৩৪ দিনের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ৩৫ শতাংশ চাকরি কমে গেছে এবং ৫০ শতাংশ রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে৷ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের আর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী বলা হয়েছিল ২০১৭–এর মার্চ মাসের মধ্যে কর্মসংস্থান কমবে ৬০ শতাংশ এবং রেভেনিউ কমবে ৫৫ শতাংশ৷
২০১৪–র নির্বাচনে বিজেপি তাদের ইস্তাহারে ঘোষণা করে যে, ক্ষমতায় এসে তারা প্রতি বছর ২ কোটি যুবকের কর্মসংস্থান করবে৷ এই প্রসঙ্গে কমরেড সাহা বলেন, ‘আমাদের দেশে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ হল ৩৫ বছরের কম বয়সীরা৷ এঁদেরই কাজ দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ২০১৫ তে কাজ সৃষ্টি হয়েছিল ১.৫৫ লক্ষ এবং ২০১৬–তে তা দাঁড়ায় ২.৩১ লক্ষে৷ এদিকে কাজ বিনষ্ট হওয়ার সংখ্যা হল ১৫ লক্ষ’৷
কমরেড সাহা আরও বলেন, ‘যখন মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার, ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির চাপে দিশাহারা হয়ে কোনও মতে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজছে তখন নানা ব্যক্তির বিশাল বিশাল স্ট্যাচু বসানোর, দ্রুতগতি বুলেট ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করার মধ্যে কোনও যুক্তি আছে কি?’ অনাদায়ী ঋণ প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘যখন বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির নেওয়া অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে তখন কেন সরকার কর্পোরেট হাউসগুলির ঋণ মকুব করে দিচ্ছে? কেনই বা ব্যাঙ্কগুলিকে সরকারি অর্থভাণ্ডারের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের পুঁজির ঘাটতি মিটিয়ে দিচ্ছে৷ কেনই বা ঋণ খেলাপকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে নতুন করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে? কীভাবে গৌতম আদানির মতো শিল্পপতি যার ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৯৬,০০০ কোটি টাকা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর খনি প্রকল্পের জন্য ৩,০০০ কোটি টাকার নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান৷
এই প্রাক বাজেট মিটিং–এ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি পুনরায় শ্রমিক জীবনের মূল দাবিগুলি তুলে ধরে৷ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দাবি হল – সামাজিক ক্ষেত্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, কর ফাঁকি ও ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ, ন্যূনতম মজুরি মাসে ১৮,০০০ টাকা করা, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের ব্যবস্থাকরণ, স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ঠিকা ও ক্যাজুয়াল কর্মীদের স্থায়ী কর্মীর স্বীকৃতি প্রদান, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিলগ্ণিকরণ বন্ধ করা ইত্যাদি৷