প্রশ্ন উঠছে এবং উঠবেই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২২ মে রাজস্থানের বিকানেরে এক জনসভায় ছাতি ঠুকে বক্তৃতা দিলেন, ‘‘গত কয়েক দশকে পাকিস্তান সন্ত্রাস ছড়াত, নির্দোষ মানুষকে হত্যা করত। কিন্তু পাকিস্তান একটা কথা ভুলে গিয়েছিল– এখন ভারতমাতার এক সেবক মোদি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’’ তার পরেই তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘‘মোদির মাথা ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু মোদির রক্ত গরম। আর এখন তো মোদির শিরায় রক্ত নয়, গরম সিঁদুর বইছে।’’ অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানকে জবাব দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দেশের দুশমনরা টের পেয়েছে, যখন সিঁদুর বারুদে পরিণত হয়, তার ফল কী হয়’!’

প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল বিজেপির গত এক দশকের কার্যকলাপ যাঁরা দেখেননি, তাঁরা এই বক্তৃতা শুনে ভাবতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মধ্যে দিয়ে দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করে ফেললেন। বাস্তবটা কী? পহেলগামে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এক মাস পার হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত একজনও সন্ত্রাসবাদী ধরা পড়েনি। শুধু তাই নয়, সরকার এখনও সুনির্দিষ্ট ভাবে তাদের চিহ্নিতও করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী এ দিনের বক্তৃতায় বলেছেন, অপারেশন সিঁদুর-এ সামরিক বাহিনীর ‘চক্রব্যুহ’ পাকিস্তানকে নতজানু হতে বাধ্য করেছে। তিনি আগেও দাবি করেছেন, ভারতের তীব্র আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানের তরফে সংঘর্ষবিরতির প্রার্থনা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কথাই যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ পাকিস্তান যদি ভারতের কাছে সংঘর্ষবিরতি প্রার্থনা করে থাকে তবে সেই সংঘর্ষবিরতির প্রধান শর্তই তো হওয়া উচিত ছিল পহেলগাম সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি সন্ত্রাসবাদীকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া। সেই শর্ত ভারত পাকিস্তানকে দিয়েছিল কি?

এ প্রসঙ্গে একটি শব্দও তাঁর বক্তৃতায় উচ্চারণ করেননি প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আরও যে সব সন্ত্রাসবাদীর কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের হস্তান্তরের কথাই বা যুদ্ধবিরতির শর্তে থাকল না কেন? প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য দাবি করলেও একবারও বলেননি, পহেলগামে গোয়েন্দারা সন্ত্রাসি হামলার আশঙ্কা করায় প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি বাতিল করা হলেও পর্যটকদের জন্য কেন কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হল না। এই রকম একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় সরকার তা হলে পর্যটকদের কিসের ভরসায় ছেড়ে দিয়েছিল? এ সব কোনও প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রী দেননি। প্রধানমন্ত্রী যতই এই অপারেশনের সাফল্য প্রচার করতে দেশ জুড়ে দলের কর্মীদের দিয়ে তিরঙ্গা যাত্রা করান, এই প্রশ্নগুলি কিন্তু দেশের মানুষ বিশেষত পহেলগামে নিহত পরিবারগুলি এবং পাকিস্তানের গোলায় নিহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি তুলবেনই এবং তার উত্তরও তাঁরা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের কাছে চাইবেনই।

এ প্রশ্নও প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারবেন না যে, যদি পাকিস্তানই ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতি প্রার্থনা করে থাকে তবে তা ভারতের শর্তে না হয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শর্তে হল কেন? আমেরিকার কোন কোন শর্তে ভারত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হল? কেন ভারত সংর্ঘষবিরতি ঘোষণার আগেই ট্রাম্প তা ঘোষণা করে দিলেন? ট্রাম্প ইতিমধ্যে এগারো বার দাবি করেছেন, তাঁর উদ্যোগেই এবং ব্যবসা বন্ধের হুমকিতেই ভারত এবং পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। ট্রাম্পের এই বক্তব্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিশ্চুপ কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যতই সফল অভিযানের গর্ব করুন, তাতে প্রশ্ন ওঠা বন্ধ করা যাবে না।

বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, ‘‘অপারেশন সিঁদুর শুরুর আগে আমরা পাকিস্তানকে বার্তা পাঠিয়েছিলাম এই বলে যে, আমরা সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে আঘাত করতে চলেছি। আমরা কোনও সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত করছি না’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ মে, ২০২৫)। এক দিকে বিজেপি নেতারা বলছেন, এই সন্ত্রাসবাদী হামলার পিছনে রয়েছে পাকিস্তানের সরকারের প্রত্যক্ষ মদত, আবার তাদেরই জানিয়ে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে হামলা চালানো হচ্ছে। বিজেপি নেতারা কি দেশের মানুষকে বুঝিয়ে বলবেন, এটা কি ধরনের সন্ত্রাসবাদ দমন অভিযান? এর থেকে যদি দেশের মানুষের মনে এই সন্দেহ হয় যে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বোধহয় অপারেশন সিঁদুর, তবে বিজেপি নেতারা তাঁদের কী উত্তর দেবেন? অপারেশন সিঁদুরের নামে দুই দেশের জনগণের দেশপ্রেমকে পুঁজি করে তাঁদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি ভুলিয়ে দেওয়া এবং তাকে ভিত্তি করে নিজেদের শাসনকে নিষ্কণ্টক করে তোলাই যে দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রধান উদ্দেশ্য, এ কথাও কি কোনও ভাবে অস্বীকার করা যাবে?

এ তা হলে কিসের সাফল্য?

মোদির এই বক্তৃতায় কোথাও এই সামরিক অভিযান কী ভাবে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূলের পথে এগোল তার কোনও বিবরণ নেই। দেশের মানুষ জানতে চায়, তা হলে এই অভিযান কিসে সফল হল? প্রধানমন্ত্রীর এ সব প্রশ্নগুলির উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার দ্বারা তো এ কথাই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করা এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল না। বাস্তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভকে পুঁজি করে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে দেশ জুড়ে মানুষের মনে যে আবেগ তৈরি করা হয়েছিল তাকে নিজের ও দলের প্রচারে কাজে লাগানোটাই তাঁর আসল উদ্দেশ্য। মনে রাখতে হবে, ‘ভারতমাতার সেবক’ এই নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা দখলের পর দেশে অজস্র বার সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছে এবং তাতে কয়েক শত ভারতীয় নাগরিক ও সেনার মৃত্যু ঘটেছে। এমন সেনা অভিযান এবং সার্জিক্যাল স্ট্রাইকও এই প্রথম নয়। ২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিংবা ২০১৯-এর বালাকোট স্ট্রাইক, কোনওটিই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে পারেনি। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহতের সংখ্যা ২০১৫-এর ১৭৫ থেকে বেড়ে ২০১৬ তে ২৬৭তে পৌঁছেছে। এবং তা ২০১৯ পর্যন্ত বাড়তেই থেকেছে (দি হিন্দু, ২৪ মে, ২০২৫)। যদিও প্রতিটি সংঘর্ষের পরেই প্রধানমন্ত্রী এমনই নাটকীয় কায়দায় বক্তৃতা দিয়ে স্ট্রাইকের সাফল্য দাবি করে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার কথা বারবার বলে গেছেন। ২০১৬ সালে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের কথা বলে নোট বাতিলের সময়েও তাঁকে একই রকম অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। বলেছিলেন, পঞ্চাশ দিনের মধ্যে যদি এর সাফল্য না মেলে তবে আপনারা আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কোনও শাস্তি দিতে পারেন। ২০১৯-এ ৩৭০ ধারা বাতিলের সময়েও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা নিয়ে একই রকম বাগাড়ম্বর করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বাস্তবে তাঁর প্রতিটি বক্তৃতাই যে ছিল মানুষকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তা আজ প্রমাণিত।

সংঘর্ষে সাফল্যের মাপকাঠি কী

আর একটি বিষয়ও লক্ষ করার মতো। পাকিস্তান সরকার এবং তার সেনাবাহিনীও ভারতের মতো একই রকম ভাবে সে দেশের জনগণের সামনে নিজেদের সাফল্যের কথা এমনই জোর গলায় প্রচার করে চলেছে। ভারত যেমন পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটিগুলিতে নিখুঁত আক্রমণের সাফল্যের কথা প্রচার করছে, তেমনই পাকিস্তানও ভারতীয় সেনাঘাঁটিগুলিতে নিখুঁত আক্রমণের কথা প্রচার করছে। তারা দাবি করছে, ভারতের বেশ কিছু অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমানকে তারা ধরাশায়ী করেছে। এই সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর সাফল্যকে দেশ এবং বিশ্বের সামনে বিরাট করে তুলে ধরতে পাকিস্তান সরকার তার সেনাপ্রধানকে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ফিল্ড মার্শাল শিরোপায় ভূষিত করেছে। অর্থাৎ এই সংঘর্ষ পাকিস্তানে মিলিটারি-জাতীয়তাবাদের আরও বাড়-বাড়ন্তেই সাহায্য করেছে। অর্থাৎ দুই দেশের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের দাবির মাঝে মূল লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নটিই পিছনে চলে যাচ্ছে।

কাশ্মীরের মানুষকে দূরে ঠেলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা সম্ভব কি

এ কথা আজ কারও অজানা নেই যে, পহেলগামে হামলার পর কাশ্মীরের মানুষ তার প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, হরতাল পালন করেছিলেন, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন। এই ঘটনা এক কথায় নজিরবিহীন। এর থেকে প্রমাণ হয়, কাশ্মীরের মানুষ সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করেন না। কাশ্মীরের মাটিতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদকে যদি নির্মূল করতে হয় তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের মানুষের এই প্রতিবাদী মানসিকতাটিকেই আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। অথচ শাসক বিজেপির নেতারা কী করলেন? কাশ্মীরের মানুষের এই প্রতিবাদকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাঁরা সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করতে থাকলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরী ছাত্ররা, ব্যবসায়ীরা আক্রান্ত হতে থাকলেন। বিজেপি প্রচার করতে থাকল কাশ্মীরের মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসবাদের সমর্থক। বিজেপির নেতারা কেউ কেউ এমনকি তাঁদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই বলেও প্রচার চালাতে থাকলেন। অথচ কাশ্মীরের ইতিহাস বলে, স্বাধীনতার সময়ে কাশ্মীরের মুসলমান-ধর্মী সাধারণ মানুষ পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি। সেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে তাঁরা ভারতে থাকার জন্যই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক কেন্দ্রীয় শাসক দল তাদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে কাশ্মীরের মানুষের আবেগের উপর বারবার আঘাত করে তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। আজ কাশ্মীরের মাটিতে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা যাতে কোনও সমর্থন না পায় তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল কাশ্মীরের মানুষের এই মানসিকতাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া।

বাস্তবে ‘কাশ্মীরের মানুষের একাংশের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা কাজ করেছে তার জন্য কেন্দ্রের একের পর এক সরকার এবং শাসক দলগুলি এবং তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে আমরা এ কথা বারবার বলেছি যে, গোটা ‘কাশ্মীরের জনগণকেই কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দেগে দেওয়া যায় না। জনগণ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারা চাই।’ অথচ এই চেষ্টা কোনও সরকারই করেনি। এ বারের ঘটনা গোটা দেশের সামনে দেখিয়ে দিল, ‘কাশ্মীরের জনগণ পহেলগামে সন্ত্রাসবাদের শিকার মানুষগুলির পাশে সর্বান্তকরণে দাঁড়িয়েছেন বলেই নয়, তাঁদের সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ তাঁদের ভারতীয়ত্বেরই প্রমাণ দিয়েছে– যা আমাদের বক্তব্যের সত্যতাকে আবার প্রমাণ করেছে। অথচ যারা যখন কেন্দ্রের ক্ষমতায় থেকেছে, কেউ কখনও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাশ্মীরকে বিচার করেনি।

২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পূর্বতন সম্পাদক দিলীপ পদগাঁওকরের নেতৃত্বে তিন জনের এক টিমকে কাশ্মীরে পাঠিয়েছিলেন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মতামত দেওয়ার জন্য। এই টিম ‘কাশ্মীরের ছাত্র যুব সাধারণ মানুষ এবং পণ্ডিতদের সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, ‘কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেন না। তাঁরা পাকিস্তানেরও সমর্থক নন। তাঁরা ভারতবাসী হিসাবে পরিচয় দিতেই গর্ব অনুভব করেন।’

কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘কাশ্মীরের মানুষের এই মানসিকতাকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী একবারও বললেন না, সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে সারা দেশের সঙ্গে কাশ্মীরীদের এই ঐক্য এবং সংহতি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। একবারও ছুটে গেলেন না পাকিস্তান সেনার ছোঁড়া গোলায় কাশ্মীর সীমান্তে দেশের নিহত মানুষগুলির পরিবারের কাছে, হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ভেঙে যাঁরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন, তাঁদের কাছে। কেন গেলেন না? কারণ জনগণের কল্যাণ, ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে ঐক্য সংহতি গড়ে তোলা তাঁদের রাজনীতিই নয়। বরং এগুলিকে ভেঙে দিয়ে মানুষকে বিভক্ত করে, পরস্পরকে দাঙ্গায় মাতিয়ে দিয়ে তা থেকে ফয়দা তোলাই তাদের রাজনীতি। তাই পহেলগামের ঘটনার পরই দেশ জুড়ে বিজেপির নেতা-কর্মীরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধেই বিষোদগার করতে নেমে পড়লেন এবং যুদ্ধ শুরু হতে সেই প্রচারকে তুঙ্গে তুললেন। অথচ এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে যথাযথ ভাবে অনুসরণ না করলে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা শুধু কল্পনা ছাড়া আর কোথাও থাকে না।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা নাকি নির্বাচনসাফল্য কিসের প্রয়োজনে

প্রধানমন্ত্রী এবং শাসক বিজেপি নেতারা অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রচার করতে গিয়ে জোর দিচ্ছেন রাষ্ট্রের সামরিক তাকতের উপর। আসলে এই তাকতের প্রদর্শনীটি মানুষের সামনে সাফল্য হিসাবে উপস্থিত করতে পারলে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের ব্যর্থতাকে ঢেকে ফেলে দেশ শাসনে নিজেদের যোগ্য হিসাবে তুলে ধরা যায়। নিকটবর্তী নির্বাচনগুলিতে তা খুবই কাজ দেওয়ার সম্ভাবনা। ঠিক যেমন ২০১৯-এর আগে পুলওয়ামা বিস্ফোরণ এবং ৪০ জন ভারতীয় সৈনিকের মৃত্যুতে দেশের মানুষের মনে জন্ম নেওয়া অভিঘাত সমর্থন-হারানো বিজেপির ছেঁড়া পালে হাওয়া লাগিয়ে লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে কাজে লেগেছিল। অথচ আজও দেশের মানুষের অজানাই থেকে গেছে যে, কী ভাবে সে দিন বিস্ফোরক আরডিএক্স ভর্তি একটি গাড়ি সেনা কনভয়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারল, কারাই বা সেই হামলা ঘটাল? মানুষ এখনও জানে না এত বড় একটি হামলার আদৌ কোনও তদন্ত হল কি না, হলে সেই তদন্তে কী উঠে এল! অথচ সেই হামলা এবং সেনাদের মৃত্যুকে পুঁজি করে বিজেপি নেতারা দিব্যি নির্বাচনে জিতে রাজা উজির হয়ে শাসন ক্ষমতা ভোগ করে চলেছেন, আর দেশবাসী একটার পর একটা সন্ত্রাসবাদী হামলায় প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে।

তাই প্রধানমন্ত্রী যতই বুক বাজিয়ে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য দাবি করুন, ঘটনাক্রম বুঝিয়ে দিচ্ছে, এর সাথে সত্যি সত্যি সন্ত্রাসবাদ দমনের কোনও সম্পর্ক নেই।

 

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত