টিভির ব্রেকিং নিউজ থেকে শুরু করে খবরের কাগজের পাতার হেডলাইন কিংবা একেবারে কোনার খবরেও প্রধান বিষয় এখন যেন একটাই–রাজনৈতিক খুনোখুনি, বোমা-অস্ত্র উদ্ধার ইত্যাদি। বীরভূমের রামপুরহাটে বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের খুনের বদলা নিতে বগটুই গ্রামের নৃশংস গণহত্যা মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
তার আগে ঘটেছে আনিস খানের হত্যাকাণ্ড, যেখানে অভিযুক্ত পুলিস নিজেই। ঝালদার কাউন্সিলর হত্যাতেও অভিযোগ পুলিশের দিকে। পানিহাটিতে দলীয় কোন্দলের কারণে তৃণমূল কাউন্সিলর গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এরপরেও রাজ্যের নানা জায়গায় একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে। মজুত বোমা ফেটে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের সর্বগ্রাসী দখল বজায় রাখা, পঞ্চায়েত-মিউনিসিপ্যালিটির ক্ষমতার মধুভাণ্ডদখল, অবৈধ বালি ও কয়লা খাদান, নানা ধরনের সামগ্রী পাচার এবং তোলার বখরা নিয়ে হানাহানিই এই সব ঘটনার পিছনে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের ভূমিকা দেখে মনে হয় পুলিশ এবং প্রশাসন যেন পুরোপুরি শাসক দলের অঙ্গেই পরিণত হয়েছে। বগটুই হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে মুখ্যমন্ত্রী গ্রামে গিয়ে ক্ষতিপূরণ, চাকরি ইত্যাদি নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু দোষীদের শাস্তি? আর এমন ঘটনা কোথাও ঘটতে দেবে না প্রশাসন, তার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি? এ সব বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি মানুষ। যদিও এক্ষেত্রে বিবদমান দু’পক্ষই মুখ্যমন্ত্রীর দলীয় সদস্য।
মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাকে সাক্ষী রেখে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ইত্যাদি উদ্ধার করতে হবে। বাসন্তীর তৃণমূল বিধায়ককে দেখা গেছে হাতজোড় করে সকলকে অনুরোধ করছেন, বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ইত্যাদি পুলিশের কাছে জমা দিন। অর্থাৎ অস্ত্র মজুত যে কিছু অঞ্চলে একেবারে ঘরে ঘরের বিষয় হয়েছে তা স্পষ্ট। শোনা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর নাকি পুলিশ বহু অস্ত্র ভাণ্ডার উদ্ধারও করে ফেলেছে! প্রশ্নটা এখানেই, পুলিশ বাহিনীকে জনগণের পয়সায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে পোষা হয়েছে কেন? বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের মতো একেবারে রুটিন কাজের জন্যও সংবাদমাধ্যমকে শুনিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হচ্ছে! পুলিশ বাহিনীটি রাখার তবে দরকার কী? জেলায় জেলায় আজ শোনা যায় দুষ্কৃতী-শাসকদলের নেতাদের চক্র এবং তাদের সাথে পুলিশের বেশকিছু কর্তার মাখামাখির কথা। এ সত্য আরও স্পষ্ট হয়েছে বগটুইতে। পুলিশ সেখানে যে ধরনের গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে ঘটনা ঘটতে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে তা কি বিশেষ স্তরের কোনও নির্দেশ ছাড়া সম্ভব? হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত চললেও অতীত অভিজ্ঞতা বলছে সে তদন্তেরও রোগের গভীরে ঢোকার সম্ভাবনা কম।
সরকার এবং পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা চাইলে কি পরিস্থিতির এতটা অবনতি রোখা যেত না?? অবশ্যই যেত। কিন্তু তার জন্য সরকারি দলের নেতাদের যে সদিচ্ছা এবং প্রশাসনের কর্তাদের যে মেরুদণ্ডের জোর দরকার তা কি আদৌ আছে? সরকারি দলের বড় নেতারা নিজের প্রভাবাধীন দুষ্কৃতী বাহিনী এবং স্থানীয় ক্ষমতার রাশ কার হাতে থাকবে এই নিয়ে ব্যস্ত। ২০২০-র ৩ এবং ৪ জুলাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলতলিতে যে দুষ্কৃতী বাহিনী বিধায়কের নেতৃত্বে এসইউসিআই (সি) নেতা কর্মীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে কমরেড সুধাংশু জানাকে খুন করে তাণ্ডব চালিয়েছিল তারা নাকি ‘যুব তৃণমূল’, এই ‘যুব’ বাহিনীকেই দেখা যায় একের পর এক নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিংবা একেবারে রেকর্ড ভোটে দলের প্রার্থীদের জেতানোর জন্য ছাপ্পা ভোট থেকে শুরু করে গায়ের জোর ফলানোর সব কাজে নামতে। বাহিনী পুষতে গেলে তাদের খুশিও রাখতে হয়, তাই বেআইনি বালি, পাথর, কয়লা, গরু পাচার, মদ ব্যবসা, নারী পাচার চক্র ইত্যাদির রমরমা। সেই সব কারবারে কখনও নেতারা সরাসরি জড়াচ্ছেন, কখনও চোখ বুজে থেকে করতে দিচ্ছেন। আর প্রশাসনের কর্তারা! বখরার সরাসরি ভাগের বিষয়টি ছাড়াও তাঁদের অনেকেই লাভজনক পোস্টিং, প্রমোশন, অবসরের পর নানা সুযোগ সুবিধা সহ পুনর্নিয়োগ প্রভৃতির আশায় শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের পায়ে তেল মাখানোটাকে কর্তব্যের মধ্যেই ধরেন। শাসকদলের পোষা দুষ্কৃতীদের সব বেআইনি কাজ দেখেও চুপ করে থাকা, তাদের লুঠের ব্যবস্থা করে দেওয়া এগুলো সেই সব কর্তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিরোধীদের দেখলেই চোখ রাঙানো, সামান্য মিটিং মিছিল করতেও বাধা দেওয়া, হেনস্থা করা এ সবই পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তব্যের তালিকায় বেশ বড় অক্ষরে জ্বলজ্বল করে।
অবশ্য তৃণমূল বলতে পারে আমরা একা নই, এটাই দীর্ঘদিন ধরে দেশের শাসকদলগুলির বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। আজ কেন্দ্র এবং রাজ্যে প্রশাসন এবং পুলিশ, এমনকি সিবিআই-ইডি-র-এনআইএ ইত্যাদি তদন্ত সংস্থা পুরোপুরি শাসকদলের আজ্ঞাবাহী ভৃত্য বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারটা কোন দল চালাচ্ছে, তা বিজেপি না তৃণমূল, কংগ্রেস, ডিএমকে, শিবসেনা অথবা সিপিএম ইত্যাদি যাই হোক না কেন, পরিস্থিতির ফারাক বিশেষ নেই। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেস-সিপিএম আমলে দুষ্কৃতীরা শাসকদলের আশ্রয়ে থাকলে কেমন বুক ফুলিয়ে ঘুরেছে তা অজানা নয়। কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে কলকাতার তৎকালীন নামকরা সমাজবিরোধীদের আনাগোনা এবং তাদের কাউন্সিলর থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত হওয়ার ইতিহাস কি ভোলার? কংগ্রেসী আমলেই থানাগুলি শাসকদলের নির্দেশে চলতে শুরু করে। সিপিএম আমলে ১৯৮২ সালে বিজন সেতুতে ১৪ জন আনন্দমার্গীকে পুড়িয়ে মারা বা ২০০১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের ছোট আঙারিয়ার ঘরে আগুন লাগিয়ে ১১ জনকে হত্যার ঘটনা আজও মানুষ ভোলেনি। ছোট আঙারিয়ার এই ঘটনায় সিপিএমের যে দুই নেতা অভিযুক্ত ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তাদের দলীয় ‘সম্পদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কারও শাস্তি হয়নি। সিপিএম সরকারের আমলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলতলি-জয়নগরে বারবার হত্যাকাণ্ড, লুঠপাট যারা চালিয়েছিল তাদের অন্যতম মাথা ছিলেন এক মন্ত্রী। একান্ত আলাপে সিপিএম নেতারা তা স্বীকারও করতেন। খুনিদের শাস্তি হয়নি। কিন্তু মিথ্যা মামলায় সরকার জেল খাটিয়েছে ওই এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় গণআন্দোলনের নেতাদের। থানা এবং শাসকদলের অফিসের পার্থক্য সিপিএম প্রায় মুছে দিয়েছিল। বিজেপির রেকর্ড হল গুজরাট গণহত্যা ঘটিয়েও শাস্তিভোগ দূরে থাক, সেদিনের গণহত্যার নায়করাই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের হর্তাকর্তা। গুজরাট, কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড, আসাম, উত্তরপ্রদেশের মতো নানা রাজ্যে বিজেপি শাসনে পুলিশের পুরোপুরি দলদাসে পরিণত হওয়া, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের বিজেপির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়ার ঘটনাও অজানা কোনও তথ্য নয়।
প্রশাসনের ন্যূনতম নিরপেক্ষতা বজায় রাখা আজকের বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থায় এমনিতেই সম্ভব নয়। অতীতে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সরকার এবং প্রশাসকদের জনগণের সাথে কিছুটা হলেও সম্পর্ক রাখতে হত। জনগণের ভোটেরও তারা কিছুটা মূল্য দিতে বাধ্য হতেন। কারণ গণআন্দোলনের ফলে গণতান্ত্রিক চেতনার ন্যূনতম যে মান একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছিল তাকে উপেক্ষা করা পুরোপুরি তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজ বুর্জোয়া ব্যবস্থার অবক্ষয় এতটাই যে, সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ কারও জনগণের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সরকারি দলগুলি জানে নির্বাচনে জেতার জন্য আজ প্রথম দরকার টাকা। তা হলেই মাসল পাওয়ার, মিডিয়া পাওয়ার, আর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ারকে অক্লেশে কেনা যায়। ফলে একচেটিয়া মালিকদের টাকার থলি যেদিকে ঝোঁকে সেদিকেই ঝোঁকে তথাকথিত গণতন্ত্রের সবকিছু। মানুষের ন্যূনতম চেতনা, টিকে থাকা ছিটেফোঁটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আরও ক্ষয় ধরানোর জন্য শাসকদলগুলি চেষ্টা করে চলেছে। তারা চায় চরম শোষণে নিঃস্ব জনগণকে সামান্য কিছু সুবিধার লোভ দেখিয়ে নিজের লেজুড়ে পরিণত করতে। ন্যায্য অধিকারের দাবি তোলার বদলে সামান্য পাইয়ে দেওয়াটাকেই যেন সরকারের চরম বদান্যতার প্রকাশ বলে মেনে চুপ করে থাকে মানুষ। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, রোজগারহীনতায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ এর অসহায় শিকার। এরই সুযোগ নিয়ে একদলকে কিছু অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে দলীয় মাফিয়ায় পরিণত করছে শাসকদলগুলি। তাদের এরা কাজে লাগায় আবার প্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আর প্রশাসন? মালিক শ্রেণির পুরোপুরি আজ্ঞাবাহী দাস হিসাবে প্রশাসন ভালই জানে কখন কাকে মদত দিতে হয়, কখন চোখ ঘুরিয়ে নিতে হয়। যার প্রকাশ আমরা আজকের বাংলায় দেখছি।
আশার কথা সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় যাঁরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই বুদ্ধিজীবীরা আবার প্রতিবাদে নেমেছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনসাধারণের মধ্য থেকেও দাবি উঠছে বগটুই, আনিস হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুধু নয়, দলদাস পুলিশের শাস্তি চাই, এর আসল কলকাঠি নাড়া চাঁইদের শাস্তি চাই। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বেড়ে ওঠাটাই আজকের অন্ধকার পরিস্থিতিতে আলোর রেখা।