এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার অন্যতম প্রবীণ নেতা, পূর্বতন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্বতন সভাপতি কমরেড সহদেব নস্কর ১২ ফেব্রুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মৃত্যুসংবাদ পাওয়ামাত্র দলের জেলা দপ্তরে ও জেলার সকল কার্যালয়ে রক্তপতাকা অর্ধনমিত করা হয়। কমরেডরা কালো ব্যাজ পরিধান করেন। তাঁর মরদেহ জেলা অফিসে শায়িত রাখা হয়। জেলার নানা প্রান্ত থেকে দল ও গণসংগঠনের অসংখ্য নেতা-কর্মী সমবেত হয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। দলের পলিটবুরো সদস্য ও জেলা সম্পাদক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। পর দিন সকালে তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল রাধাকান্তপুর অভিমুখে শেষযাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় অফিসে মরদেহ পৌঁছলে শত শত সাধারণ মানুষ ও কর্মী-সমর্থক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন দলের নেতৃত্বে অন্যান্য এলাকার মতো রাধাকান্তপুর অঞ্চলেও বেনাম জমি উদ্ধার করে চাষির হাতে বিলি করার আন্দোলন শুরু হয়। সেই জমিতে ধান রোয়ার কাজে দলের কর্মীরা চাষিদের সাহায্যার্থে সামিল হন। সেখানে জোতদারদের স্বার্থে তৎকালীন কংগ্রেসী নেতারা (পরবর্তীকালে সিপিএম) গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেও প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায়। কিছু গরিব মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তারা এনেছিল। এ ঘটনায় সহদেববাবুর মনে প্রশ্ন জাগে– নিজেদের কর্মীদের বিপদে ফেলে কিভাবে নেতারা পালাতে পারেন? প্রথমে তিনি কংগ্রেসের অনুগামী থাকলেও গণআন্দোলনের প্রতি নিষ্ঠা দেখে এসইউসিআই(সি) দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে গ্র্রামবাসীদের সাথে বৈঠক করে একযোগে এসইউসিআই(সি) দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন স্থানীয় নেতা কমরেড জগন্নাথ হালদার, প্রভঞ্জন নস্কর, রাধাকান্ত হালদার, জমিরুদ্দিন সেখ প্রমুখের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে আজীবন প্রয়াসী ছিলেন।
তিনি রাজনীতির চর্চায় মগ্ন হয়ে থাকতেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের নানা লেখা ও দলের বইপত্র, পত্রপত্রিকা নিজে পড়তেন এবং কমরেডদের পড়ানোর চেষ্টা চালাতেন। দলের প্রদর্শিত পথে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা, যৌথ প্রক্রিয়ায় দলের কাজ পরিচালনা, কর্মী সংগ্রহে তিনি খুবই যত্নবান ছিলেন। জুনিয়র কমরেডদের গভীর মমতায় ও যত্নে গড়ে তোলার কাজে সর্বদা তাঁর নজর থাকত। কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের প্রতিটি আন্দোলনের সাথে স্থানীয় স্তরে বহু আন্দোলন গড়ে তোলায় তাঁর ভূমিকা ছিল নেতৃত্বকারী। মহান নেতার আদর্শ ও উচ্চ রুচি-সংস্কৃতির মান আয়ত্ত করার সংগ্রামে নিজে ও কর্মীদের অনুশীলনে প্রভূত চেষ্টা চালিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবীদের ও নবজাগরণের মনীষীদের জীবনচর্চা ও অনুষ্ঠানে সকলকে সামিল করাতেন। আজ ‘আটেশ্বরতলা সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ সংস্কৃতি-চর্চার কেন্দ্র হিসাবে এলাকায় দল মত নির্বিশেষে সকলের গর্বের বিষয়। এই মঞ্চ গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁরই। এলাকার এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের স্পর্শেই রাজ্যে গণআন্দোলনের অমর শহিদ কমরেড মাধাই হালদারের স্বল্পশিক্ষিতা মা গয়েশ্বরী দেবী সন্তান হারানোর বেদনার চরম মুহূর্তেও বলতে পেরেছিলেন– ‘আমার এক মাধাই গেছে, হাজার মাধাই আছে।’
কমরেড সহদেব নস্কর আন্দোলন গড়ে তোলার পথে বারবার পুলিশি নির্যাতন সয়েছেন। এমনকি পুলিশ ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত তাঁর সংগ্রামী প্রচেষ্টাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। পুলিশের নজর এড়িয়ে দলের কাজ সচল রেখে গেছেন। অন্য কর্মীদেরও এভাবে চাপের মুখেও কাজ করে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলায় তাঁর ভূমিকা অনুকরণযোগ্য।
তিনি যখন মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করে সাইকেল চালিয়ে বহু পথ কষ্টসাধ্যভাবে পাড়ি দিতেন। তিনি ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। তাঁর ছেলে স্কুলের ‘স্টাইপেন্ড’ পাওয়ার আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে গেলে তিনি শিক্ষক হিসাবে নিজের বেতনের উল্লেখ করে দরখাস্তে স্বাক্ষর করেননি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করার সংগ্রামের একটি ধাপ হিসাবে পুত্র-কন্যাদের আর্থিক ভবিষ্যতের প্রতি দুর্বলতা বর্জন করে সমূহ জমি তিনি পার্টির নামে লিখে দিয়েছেন। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসাবে তিনি সততার অনন্য নজির রেখে গেছেন। স্বার্থান্বেষীরা তাঁর আচরণ থেকে বুঝে নিতেন যে, এখানে অসঙ্গত দাবি করে কোনও ফল মিলবে না।
সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত, স্বল্প ও মৃদুভাষী এই নেতা আদর্শগত প্রশ্নে যে কোনও বক্তব্য সরাসরি বলতে কুণ্ঠিত হতেন না। শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনে তিনি সর্বদা সক্রিয় থাকতেন। প্রাথমিক শিক্ষক ফ্রন্টের তিনি ছিলেন জেলার ইনচার্জ। সেভ এডুকেশন কমিটি, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পর্ষদ পরিচালিত বৃত্তি পরীক্ষা পরিচালনায় তিনি ছিলেন জেলার অগ্রগণ্য নেতা। শেষজীবনে অনেক বছর যাবৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পূর্বের মতো কাজে সচল থাকতে পারছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিনিয়ত দলের কাজকর্মের খোঁজখবর রাখার পাশাপাশি নতুন কর্মী-সংগঠকদের নানা ভাবে উৎসাহিত করতেন। তাঁর সংগ্রামী জীবনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি রাধাকান্তপুর অঞ্চলের আটেশ্বরতলায় শহিদ কমরেড মাধাই হালদারের স্মরণ বেদির সামনের ময়দানে সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, সভাপতিত্ব করেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড মাদার নস্কর। তাঁর প্রয়াণে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার গরিব খেটে খাওয়া মানুষ তাদের এক বিশিষ্ট সংগ্রামী নেতাকে হারাল।
কমরেড সহদেব নস্কর লাল সেলাম