প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েই বিজেপি মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

দেশজোড়া প্রবল প্রতিবাদের সামনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী এক পা পিছু হটে বলেছেন, এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনশিপ) নিয়ে সরকারে কোনও আলোচনা হয়নি৷ যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সভায় ‘এনআরসি হবেই’ বলে বীরদর্পে ঘোষণা করছিলেন, তিনিও বলতে বাধ্য হলেন, প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, এনআরসি নিয়ে সরকারে কোনও আলোচনা হয়নি৷ কিন্তু এই প্রবল প্রতিবাদ–আন্দোলনের মধ্যেই বিজেপি সরকার ঘোষণা করল, ২০২০–র এপ্রিল থেকে শুরু হবে এনপিআর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার) তথা জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার সংস্কারের কাজ৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এ বাবদ ৩৯৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করেছে৷

এর আগে ২০১০ সালে এনপিআর তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু এবারের এনপিআর নিয়ে সারা দেশে প্রতিবাদ উঠেছে৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এনআরসি এবং সিএএ–র মতোই এনপিআর অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন৷ কেন এই প্রতিবাদ? এবারের এনপিআর সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি সরকার এনপিআরকে এনআরসির সাথে জুড়তে চলেছে৷ যদিও প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘এনআরসির সাথে এনপিআরের কোনও সম্পর্ক নেই৷’’ বাস্তবে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও তাঁর কথার উপর দেশের মানুষের ভরসা নেই৷ কারণ, এনআরসি নিয়ে তিনি সংসদে এবং প্রকাশ্য জনসভায় বারবার যা ঘোষণা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ঠিক তার উল্টো কথাটি বলার পর তিনিও প্রধানমন্ত্রীর কথাতেই শেষ পর্যন্ত তাল মিলিয়েছেন৷ বিজেপির অন্য মন্ত্রীরাও এ বিষয়ে নানা জন নানা কথা, নানা নির্দেশিকার উল্লেখ করছেন৷ তাতে স্পষ্ট, এনপিআরকে সরকার উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এনআরসির সাথে যুক্ত করতে চাইছে৷ তাদের উদ্দেশ্য নানা কথার আড়ালে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাতে প্রতিবাদ না হতে পারে৷

রেজিস্টার জেনারেল অ্যান্ড সেন্সাস কমিশনার, ইন্ডিয়ার একটি বার্ষিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, এনপিআর হল এনআরসির প্রথম ধাপ৷ ২০১৪ সালের ১৮ জুন প্রেস ইনফরমেশন বুরোর (পিআইবি) টুইটে বলা হয়েছিল, এনপিআর থেকে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন রাজনাথ সিংহ৷ তিনি তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন৷ সেই বছরই ২৬ নভেম্বর রাজ্যসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজুও বলেছিলেন, ‘‘এনপিআরের পরেই এনআরসি হবে৷ দেশবাসীর নাগরিকত্ব যাচাই করে দেখা হবে৷’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫.১২.১৯)৷ আবার কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ ২৯ ডিসেম্বর জানালেন, ‘‘এনআরসি তৈরির কাজে এনপিআরের তথ্য ব্যবহার হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে৷’’ অন্য দিকে অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘অসমে এনআরসি হয়ে গিয়েছে বলে সেখানে এনপিআর হবে না৷’’ এনপিআর এবং এনআরসি যদি আলাদা হয়, তবে অসমে এনপিআর হবে না, এ কথা কোন যুক্তিতে বলছেন অমিত শাহ? তা হলে বিজেপি নেতারা আগে ঠিক করুন কোন মন্ত্রীর কথা ঠিক, কি আদৌ কারও কথা ঠিক নয়?

২৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের পাশে বসে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর ঘোষণা করেন, জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এন পি আর) হবে জনগণনার সঙ্গেই এবং কোনও বায়োমেট্রিক, আধার বা প্রমাণ দিতে হবে না৷ নিজে থেকে যা তথ্য দেওয়ার দেবে জনতা৷ অথচ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘‘কারও আধার কার্ড থাকলে, দিতে কী অসুবিধা?’’ এর সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বিনোদ বনশল নরেন্দ্র মোদি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘‘অনুপ্রবেশকারীর সমস্যা ঘুচবে এনপিআরে৷’’ ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, জনগণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়ে বিজেপি নেতাদের অবস্থা বেসামাল৷ না হলে এ ভাবে এক–এক মন্ত্রী এভাবে প্রকাশ্যে এক–এক রকম কথা বলতে পারেন না৷ তাঁদের এই একই রকম দুরবস্থা দেশের মানুষ দেখেছিলেন নোট বাতিলের সময়৷ কেন তাঁরা তা করছেন, তাতে জনগণের কী মঙ্গল, বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা সেদিন কিছুই বলতে পারেননি৷ এবারও সেই একই অবস্থা৷ আর না হলে বুঝতে হবে, আমলারাই বিজেপি সরকারের সব নীতি ঠিক করে দিচ্ছে, নেতা–মন্ত্রীরা তার খোঁজও রাখেন না৷ বাস্তবে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা এইভাবে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রেখে ধোঁয়াশা তৈরি করছেন৷ গোটা সমাজ–পরিবেশকে ঘুলিয়ে দিচ্ছেন এবং জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টিকে সরিয়ে দিচ্ছেন৷

২০১০–এ এনপিআরের জন্য ১৫টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল৷ কিন্তু ২০২০–তে এনপিআরের জন্য ২১টি বিষয়ে তথ্য চাওয়া হবে বলে বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ অতিরিক্ত ছটি প্রশ্ন যোগ করা হয়েছে৷ এ বার অতিরিক্ত জানতে চাওয়া হবে বাবা–মায়ের জন্মস্থান এবং তারিখ৷ আধার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট বা প্যান থাকলে তার নম্বরও চাওয়া হবে৷ প্রশ্ন উঠছে, এনপিআরে কেন এসব তথ্য চাওয়া হবে? এনপিআর হল, কোনও ব্যক্তি যিনি কোথাও গত ছ’মাস বাস করছেন এবং আগামী ছ’মাস বাস করবেন বলে ভাবছেন, তাঁদের তালিকা করা, তা তিনি বিদেশি হলেও৷

স্বাভাবিক ভাবেই দেশবাসীর আশঙ্কা, এই সব কার্ডের নম্বর সরকার কী প্রয়োজনে নিচ্ছে? আর কেনই বা বাবা–মার জন্মস্থান ও তারিখেরও উল্লেখের প্রয়োজন পড়ল? ফলে জনমনে এই সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছে, অমিত শাহ যতই অস্বীকার করুন, এই সব তথ্য এনআরসির কাজেই লাগানো হবে৷ তা ছাড়া এ প্রশ্নও উঠছে, জনগণনাতেই যখন বাসিন্দাদের সম্পর্কে সব রকমের তথ্য পাওয়া যায় তখন আবার আলাদা করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এনপিআর করার দরকার কী? এর মধ্যে জনগণের কী কল্যাণ রয়েছে? সত্যিই এই সরকারের লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ হলে, তারা এই সব নিয়ে এত জলঘোলা না করে অর্থনীতির এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থা দূর করতে তৎপর হতেন৷ অথচ সে নিয়ে কোনও তৎপরতা দূরের কথা সংকটের কথা অস্বীকার করতেই তারা ব্যস্ত৷ স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা এক সময়ে বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরাও এখন সরকার বিরোধিতায় নেমেছেন৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২১ সংখ্যা)

 

Check Also

সব রাজ্যের সব শাসকের ভরসা ‘খয়রাতি’তেই

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট নাগরিকদের অধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। বিধানসভা, লোকসভার মতো আইনসভাগুলিতে কে জনগণের প্রতিনিধিত্ব …