Breaking News

প্রবল দারিদ্র ও বিপুল বৈভবের সহাবস্থান পুঁজিবাদেরই বৈশিষ্ট্য

দেশে সুস্থায়ী উন্নয়নের (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট) অগ্রগতি সংক্রান্ত ২০২৩-এর রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে মোদি সরকারের নীতি আয়োগের সিইও বি আর সুব্রহ্মণ্যম বলেছেন, দেশে আর্থিক অসাম্য উদ্বেগের কারণ।

সুব্রহ্মণ্যমের এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই যে প্রশ্নটি উঠে আসে– নীতি আয়োগ কি এই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অসাম্য দূর করার কোনও নিদান সরকারকে দিয়েছে? না, তেমন কোনও নিদানের কথা তাদের প্রকাশিত উন্নয়নের রিপোর্টে নেই। তা হলে নীতি আয়োগের কাজ কী? তা কি শুধু পরিস্থিতির বিবরণ দেওয়া এবং তার বিবর্ণ চিত্র দেখে উদ্বিগ্ন হওয়া?

বহুজাতিক সংবাদসংস্থা রয়টার এ বছর মে-জুন মাসে ৫১ জন অর্থনীতিবিদকে ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে প্রশ্ন করে যে উত্তরগুলি পেয়েছে, তাতেই উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া যেতে পারে। সংস্থার প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতির এই বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই এ ব্যাপারে সহমত হয়েছেন যে, আগামী দিনগুলিতে ভারতের অর্থনীতিতে আয়বৃদ্ধি দ্রুতগতিতে ঘটতে থাকবে। কিন্তু তাঁরা এ ব্যপারেও সহমত যে, এই দ্রুতগতির আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও সমাজে যে আর্থিক বৈষম্য ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে তা কমবে না। বরং আগামী দিনগুলিতে তা আরও বাড়তে থাকবে।

কেন দ্রুত আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও আর্থিক অসাম্য কমবে না? দিল্লি আইআইটি-র উন্নয়ন-অর্থনীতির অধ্যাপিকা রীতিকা খেরা তার উত্তরে বলেছেন, অসাম্য এমন একটা বিষয় যা আপনাআপনি দূর হয়ে যায় না। তা দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা দরকার। দেশের পরিচালক তথা নীতিনির্ধারকরা যে তা কমাতে চান, তাদের নীতি নির্ধারণ থেকে তা অন্তত বোঝা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, নীতি আয়োগই হোক বা মন্ত্রিসভাই হোক, দেশ থেকে অসাম্য দূর করার কোনও পরিকল্পনা তাঁদের নেই। তা হলে কী ধরনের নীতি তাঁরা নির্ধারণ করে চলেছেন? মার্চে প্যারিস স্কুল অফ ইকনমি’-এর ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে আর্থিক অসাম্য এখন ব্রিটিশ জমানার থেকেও বেশি। আর্থিক অসাম্য নিয়ে অ’ফ্যাম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে দেশে তৈরি ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ ধনীতম এক শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত হয়েছে। দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের ভাগে জুটেছে সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট, বর্তমান অর্থনীতি, যা আদতে একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতি, তাতে আয়বৃদ্ধি যা ঘটছে, যাকে দ্রুততম আয়বৃদ্ধি বলা হচ্ছে, তা ঘটছে কেবল সমাজের মুষ্টিমেয় ধনীতম অংশের মানুষেরই। অর্থাৎ যে নীতি নির্ধারণ এই সব আয়োগ বা কমিশনগুলি এবং মন্ত্রিসভা ও তাদের দফতরগুলি করে চলেছে তা এই ধনীতম অংশটির মুনাফাবৃদ্ধি তথা আয়বৃদ্ধির দিকে লক্ষ রেখেই।

আয়বৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক অসাম্যের যে সম্পর্ক ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যাতে অসাম্য দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তার ভিত্তি রয়েছে এই পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নীতি তথা নিয়মের মধ্যেই। বহু আগে মানবমুক্তির দিশারি কার্ল মার্ক্স প্রমাণ করে দেখিয়ে গিয়েছেন, পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা আসে শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষকে বঞ্চিত তথা শোষণ করার মধ্য দিয়েই। শোষণ যত তীব্র হয় মালিকদের মুনাফা ততই বাড়ে। বর্তমানে মালিক শ্রেণি তথা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের যে আকাশছোঁয়া মুনাফাবৃদ্ধি ঘটছে, তা থেকেই স্পষ্ট যে শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ কোন তীব্র মাত্রায় পৌঁছেছে। সম্প্রতি দেশের অন্যতম ধনীশ্রেষ্ঠ গৌতম আদানি বর্তমান সময়টিকে ভারতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে ভাল সময় বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, ‘অর্থনীতির চলতি গতি বজায় থাকলে আগামী এক দশকে প্রতি ১২ থেকে ১৮ মাসে এক লক্ষ কোটি ডলার যুক্ত হবে ভারতীয় অর্থনীতিতে। আর ২০৫০ সালে ভারতীয় অর্থনীতি ৩০ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যাবে।’

অর্থনীতির এই বিপুল কলেবর বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, তা কি সাধারণ মানুষের রোজগার, কেনাকাটা, ভোগব্যয় বাড়ার জন্য হচ্ছে? একেবারেই নয়। সাধারণ মানুষের ভোগব্যয় কমছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রায় ১০০ কোটি কর্মক্ষম মানুষ পরিশ্রম করে নিয়মিত দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছেন। কিন্তু তার ফলে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটে চলেছে তার সুফল তাদের ঘরে পৌঁছায় না। তা চলে যায় মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি তথা ধনকুবেরদের দখলে।

বাস্তবে অর্থনীতির নজিরবিহীন অগ্রগতি তথা ধনকুবেরদের মুনাফাবৃদ্ধি ঘটছে দুটি উপায়ে। প্রথমটি হল, কলকারখানা, বন্দর, বিমানবন্দর রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ, যা দেশের জনগণের পরিশ্রম এবং করের টাকায় তিল তিল করে গড়ে উঠেছে সেগুলিতে ধনকুবেরদের দখল কায়েম করা, তার সাথে ধাতু, তেল, কয়লা সহ সব ধরনের খনি, নদী, জঙ্গল সহ সব রকমের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুঠতরাজ। আর দ্বিতীয়টি হল শোষণকে সীমাহীন মাত্রায় পৌঁছে দেওয়া। ধনকুবেররা দুটিই চালাচ্ছে দেশের বর্তমান কর্ণধার তথা সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ মদতে। অর্থাৎ পরিশ্রম করে বা বৈধ উপায়ে নয়, সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং বেআইনি উপায়ে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠছে দেশের ধনকুবেররা। সেই সম্পদকে পুঁজি করে তারা দেশের অভ্যন্তরে যেমন অবাধে শোষণ-লুণ্ঠন চালাচ্ছে, সরকার তথা রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করছে, তেমনই রাষ্ট্রের পূর্ণ মদতে পুঁজিবাদী বিশ্ববাজারে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অবতীর্ণ হয়ে দেশে দেশে ব্যবসা করছে এবং সেখানকার বিদেশের সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল লুঠ করে আরও বিপুল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে। আর এই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি তথা ধনকুবেরের সীমাহীন সম্পদবৃদ্ধিকেই জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধি তথা আয়বৃদ্ধি হিসাবে দেখানো হচ্ছে।

১৯৯১-এ কংগ্রেস সরকারের নয়া আর্থিক নীতি কায়েমের মধ্যে দিয়ে এই লুঠ এবং তীব্র শোষণ লাগামছাড়া আকার নিয়েছে। এই নীতির মধ্যে দিয়ে সরকার সমস্ত সরকারি সম্পত্তি, কলকারখানা, রেল, তেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, বন্দর, বনজ সম্পদ, খনি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি পুঁজিপতিদের মুনাফার জন্য তাদের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। ২০১৪-তে বিজেপির নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় বসে এই লুঠতরাজের পাশাপাশি শোষণকে তীব্র করতে শ্রম আইন বদলে ফেলে। ৪৪টি শ্রম আইন, যা শ্রমজীবী মানুষের হাতে কিছুটা হলেও অধিকার তুলে দিয়েছিল, বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল, সেগুলি সব ছেঁটে ফেলে ৪টি শ্রমকোড তৈরির মধ্যে দিয়ে বিজেপি সরকার মালিকদের হাতে অবাধ শ্রমিক শোষণের অধিকার তুলে দিয়েছে। নয়া শ্রমকোডে শ্রমিকদের বহু সংগ্রামে অর্জিত অধিকারগুলি– আট ঘণ্টা কাজের অধিকার, সংগঠিত হওয়ার অধিকার, ‘ন‌্যূনতম মজুরি, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, লে-অফ, লক-আউটের ক্ষেত্রে আইন মানার বাধ্যতা প্রভৃতি বহু কিছু ছেঁটে ফেলা হয়েছে। কার্যত নয়া কোড চালু করে বিজেপি সরকার মালিকদের হাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের শুষে ছিবড়ে করে ফেলার একচেটিয়া অধিকার দিয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, শোষণ যতই তীব্র হচ্ছে মালিকদের মুনাফা ততই লাফিয়ে বাড়ছে। পাশাপাশি, জনগণের বৃহত্তর অংশের জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নামে সরকার যতটুকু ব্যয় করত, বিশেষত খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ প্রভৃতি পরিষেবা খাতগুলিতে, সেই সব ব্যয় সরকার বন্ধ করে দিয়েছে শুধু নয়, এই সব ক্ষেত্রগুলির ব্যাপক বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে জনগণকে নিঃশেষে লুঠ করার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণিকে সুযোগ করে দিয়েছে। এই সব বহুমুখী শোষণ ও লুঠতরাজের মধ্যে দিয়েই একতরফা পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে এবং রোজগার কমে যাওয়া, শিক্ষা-চিকিৎসা-পরিবহণ সহ পরিষেবা ক্ষেত্রগুলিতে বিপুল ব্যয় বহন করার ফলে জনসাধারণ ক্রমাগত বেকারত্ব, দারিদ্র, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। সমাজের এই একটি ক্ষুদ্র অংশের বিপুল সম্পদবৃদ্ধিকেই সরকার এবং পুঁজিপতিরা অর্থনীতির দ্রুতগতির বৃদ্ধি এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পৌঁছে যাওয়ার উজ্জল ভবিষ্যৎ হিসাবে তুলে ধরছে– যে ভবিষ্যতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জায়গা নেই। কারণ, অসাম্যের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি সমাজ গড়েই ওঠে যেমন অন্যায়ের ভিত্তিতে, তেমনই তা সমস্ত সুযোগ এবং সুবিধাগুলি কেন্দ্রীভূত করে দেয় মুষ্টিমেয় ধনী এবং ক্ষমতাসীন মালিকদের হাতে।

এ থেকেই বোঝা যায় যে, নীতি আয়োগের শুকনো উদ্বেগের কারণ কী। নীতি আয়োগের মতো সংস্থাগুলি পুঁজিবাদী সরকারের মতোই পুঁজিপতি শ্রেণির পুঁজির অপ্রতিহত বিকাশের জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনই নীতি-নির্ধারণ করে চলে। সেই নীতিতে রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য বড় জোর কিছু খয়রাতির ব্যবস্থা করতে পারে, রেশনের সামান্য চাল-গম ছুঁড়ে দিতে পারে, কিন্তু বৈষম্য কমানোর কোনও চেষ্টা তাতে থাকতে পারে না। জনসাধারণকে দরিদ্র অবস্থাতেই ফেলে রেখে মুনাফার রসদ হিসাবে ব্যবহার করাই তো তাদের লক্ষ্য। কিন্তু এই বৈষম্যের একটা প্রতিক্রিয়াও আছে। তা সমাজ অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বকে ক্রমাগত তীব্র করবে এবং গণবিক্ষোভের জন্ম দেবে। জন্ম দেবে পরিবর্তনের আকাঙক্ষার। দিচ্ছেও।