প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের কথা ভুলেই গেলেন


দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তথা শ্রমিকদের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে দিল্লিতে লকডাউন উপেক্ষা করে হাজার হাজার শ্রমিকের পথে নামার ঘটনায় তা আবার স্পষ্ট হয়ে গেল। চার ঘণ্টার নোটিসে প্রধানমন্ত্রী যখন লকডাউন ঘোষণা করলেন তখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকেরা এর ফলে কী দুরবস্থার মধ্যে পড়বে, তা কথা একবারের জন্যও ভাবলেন না তিনি। ভাবলে একই সঙ্গে নির্দেশ দিতেন, এই শ্রমজীবী মানুষগুলি, যাঁরা জীবিকার তাগিদে বাড়ি থেকে বহু দূরে এসে আটকে পড়েছেন, তাঁদের দ্রুত ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। তা তো হলই না বরং তাদের অস্তিত্বের কথা বেমালুম ভুলে গেল সরকার।
অন্যান্য বড় বড় শহরগুলির মতো দিল্লিতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন কলে-কারখানায় নির্মাণে হোটেলে রেস্টুরেন্টে দোকানে ড্রাইভার রিকশাচালক গৃহকর্মী হিসাবে। এরা মূলত অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক। কেউ নিম্ন অঙ্কের মাস-মাইনে, কেউ দৈনিক রোজগারের উপর নির্ভরশীল। দেশের দূর প্রান্তে তাঁদের পরিবারগুলি অপেক্ষায় থাকে ওই রোজগারটুকুরই ভরসায়। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় কাজ বন্ধ বলে এঁরা মজুরিও পাবেন না। মালিকরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার নিদান দিয়েছে। কিন্তু ফিরবে কীভাবে? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় মালিকের নেই। দায় সত্যিই যাদের ছিল তারা থালা বাজাতে আর মোমবাতি জ্বালাতে বলেই দায়িত্ব শেষ করেছে।

কর্ণাটকের গুলবার্গায় দলের কর্মীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছে।

ইতিমধ্যে বাস ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের ঘরে ফেরার স্বাভাবিক রাস্তা বন্ধ। রাস্তায় বেরোনোর চেষ্টা করলে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠিপেটা করতে থাকে। তাঁরা বাধ্য হন দোকানে, গ্যারেজে, ছোট ছোট কারখানায় গাদাগাদি করে দিন কাটাতে। খাদ্য অমিল। অনেকেরই পকেটে অর্থ নেই। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটতে থাকে। পরিবারের কথা, অনাগত দুর্দিনেরর কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন সকলে। এমন অবস্থাতেও মানুষগুলির পাশে না দাঁড়াল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, না দাঁড়াল দিল্লির আপ সরকার। না ব্যবস্থা করল এতটুকু খাদ্যের বা আশ্রয়ের, না ব্যবস্থা করল তাদের ফিরে যাওয়ার। কোনও কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে এসে কিছু শ্রমিকের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সেই খাবার নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য অনেকেই ভিডিওতে দেখেছেন। এরা তো কেউ ভিখারি নন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শ্রমিক। পরিশ্রম করে রোজগার করেন। সরকারের দিশাহীন সিদ্ধান্তই এমন এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল তাঁদের। এই মানুষগুলি বেশিরভাগই উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ বিহার রাজস্থানের বাসিন্দা। বেশিরভাগেরই বাড়ির দূরত্ব একশো দুশো তিনশো চারশো কিলোমিটার পর্যন্ত। কয়েক দিন অর্ধাহারে-অনাহারে কাটানোর পর মরিয়া মানুষগুলি পুলিশি অত্যাচারকে অগ্রাহ্য করে, করোনার সংক্রমনের ভয়কে তুচ্ছ করে পথে নামতে শুরু করলেন। হাইওয়ে ধরে হাঁটতে লাগলেন তাঁরা দলে দলে, হাজারে-হাজারে— বন্যার জলের মতো রাজপথ ভাসিয়ে নিয়ে চললেন। সে দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সংক্রমণ ছড়ানোর আতঙ্কে চমকে উঠেছেন, আবার সহানুভুতিতে চোখে জলও এসেছে তাঁদের।
এঁদের বহুজনই শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি তাঁদের গন্তব্যে। টিভিতে অনেকেই দেখেছেন কীভাবে ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষগুলি চলতে চলতে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েছেন রাস্তার ধারে। রণবীর সিংহ নামে রেস্টুরেন্টে ডেলিভারি এজেন্ট হিসাবে কাজ করা এক শ্রমিক তাঁর গন্তব্য সাড়ে তিনশো কিলোমিটারের শ’দুয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করেই ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে। হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছেন চারজন, আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যে ক্ষতবিক্ষত হন বিবেকবান মানুষ। শ্রমিকদের প্রতি এমন চরম অমানবিক আচরণের অভিযোগে দেশজুড়ে প্রবল নিন্দার ঢেউ ওঠে একদিকে কেন্দ্র এবং উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার, অন্য দিকে দিল্লির আপ সরকারের বিরুদ্ধে। মানুষ প্রশ্ন তোলে, দরিদ্র শ্রমিক বলেই কি সরকারগুলি তাদের সঙ্গে এমন নির্মম আচরণ করল? মাত্র কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এরাই তো কলে-কারখানায়, নির্মাণে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে, দোকানে, গৃহকর্মী হিসাবে প্রাণপাত করে দেশের জন্য সম্পদ তৈরি করেছেন। এঁদের কঠোর পরিশ্রমের ফসলই তো মালিকরা মুনাফা হিসাবে ঘরে তুলেছেন। অথচ আজ চরম বিপদের দিনে তাঁদের প্রতি সরকারগুলি নূ্যনতম মানবিক আচরণও করল না। এই আচরণ শাসক নেতা-মন্ত্রীদের কোন মনোভাবের পরিচয়? প্রশ্ন উঠেছে, হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনের গভীর উদ্বেগ, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তার শরিক কেন হতে পারলেন না এইসব সরকার এবং দলগুলির নেতা-মন্ত্রীরা? প্রধানমন্ত্রীর সভা ভরানোর জন্য যেখানে রাতারাতি বাস ট্রেনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় সেখানে দুর্গত শ্রমিকদের জন্য কেন তা করা হল না, এই প্রশ্নের জবাব প্রধানমন্ত্রী কেন দেবেন না?
দেশজুড়ে তীব্র ধিক্কার প্রতিবাদে সরকার একটুখানি নড়েচড়ে বসলেও বিজেপি নেতাদের মনোভাব গোপন থাকে না। শ্রমিকরা যখন এভাবে রাস্তায় জীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন তখন দেখা গেল, বিজেপি সরকারের তাবড় মন্ত্রীরা কেউ বাড়িতে সোফায় বসে টিভিতে রামায়ণ দেখার ছবি টুইট করছেন তো আর এক নেতা নানা রকম রান্নার ছবি টুইট করছেন। বিজেপি নেতা বলবীর পুঞ্জ তো এই সবকিছুর জন্য শ্রমিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণকেই দায়ী করে দিলেন। বললেন, আসলে ছুটি পেয়ে তারা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ছুটছে। করোনা পরিস্থিতির গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। এইসব নেতাদের কারও মধ্যে কি এই বিপন্ন মানুষগুলির জন্য এতটুকু সহানুভূতি চোখে পড়ল?
প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রী যত নাটকীয় ভাবেই ঘোষণা করুন না কেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত তো তাঁর ব্যক্তিগত বা তাৎক্ষণিক ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু তো সরকারকে অনেকদিন আগেই সাবধান করেছিল। তখন তাঁরা সাবধান হননি কেন? কেনই বা বা দেশের মানুষকে সাবধান করেননি? যেদিন প্রধানমন্ত্রী জনতা কারফিউ ঘোষণা করেছিলেন সেদিনই কেন লকডাউনের অন্তত সম্ভাব্য দিন ঘোষণা করলেন না? লকডাউন তো নোট বাতিল নয় যে, মানুষ আগে থেকে জানতে পারলে কালো টাকা রাতারাতি সাদা করে ফেলবে! এ ক্ষেত্রে শুধু শ্রমিকরা নন, সারা দেশের মানুষই প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পেতেন, তাদের এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে তাদের পড়তে হত না। বাস্তবে বিজেপি সরকারের সমস্ত কাজেই যেমন চিন্তার গভীরতার অভাব দেখা যায়, জনস্বার্থকে অগ্রাহ্য করতে দেখা যায়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
আসলে বিজেপি নেতারা এইসব শ্রমিকদের পিঁপড়ের অধিক গুরুত্ব দেননি যাদের অনায়াসে পায়ে পিষে ফেলা যায়। তাই তাদের ভালো-মন্দ, বাঁচা-মরা তাদের হিসেবের মধ্যেই ছিল না। অথচ এই সরকারই লকডাউন ঘোষণার পরেও বিমান চলাচল বন্ধ করেনি। বিদেশ থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁদের ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে রীতিমতো বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সে কি শুধু তাঁরা সমাজের উঁচু তলার মানুষ বলে? উত্তরপ্রদেশের বরেলিতে যোগী সরকার যেভাবে ফিরে আসা শ্রমিকদের উপর কীটনাশক ছড়িয়েছে তা কি তারা পারত বিদেশ থেকে ফেরা বিমান যাত্রীদের উপর করতে? এ কথাটি কি সত্য নয় যে শুধুমাত্র দরিদ্র শ্রমিক বলেই তারা তাদের উপর এমন অমানবিক আচরণ করতে পারলেন? এই আচরণ তাঁদের শ্রমিক বিরোধী চরিত্রকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই নির্মম শোষণ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছে দেশের শ্রমিকদের। ভারতের সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের দুরবস্থাকে আরও প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এল এই লকডাউন। এই পরিস্থিতিতে সভ্য সমাজের ন্যায্য দাবি, লকডাউন চলাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে সমস্ত শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।