কর্ণাটকে ৮০ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭২ শতাংশ এলাকা খরায় জ্বলছে৷ এ ছাড়াও রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডে খরার প্রবল প্রকোপ চলছে৷ প্রতি বছরের মতো এ বারও খরা কবলিত এলাকার কৃষকরা পড়েছেন গভীর সংকটে৷ সেচের জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, এমনকি প্রচুর খরচ করে ফলানো ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ফসল বিমার টাকাও পাচ্ছেন না কৃষকরা৷ গরিব, অসহায় কৃষকের রক্ত জল করা পরিশ্রমে জমানো টাকাও আত্মসাৎ করছে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলি৷
তথ্যের অধিকার আইন বলে সমাজকর্মীরা বের করে এনেছেন একটা মারাত্মক চিত্র– ২০১৮ সালের খরিফ মরসুমে চাষিদের থেকে বিমা কোম্পানিগুলি প্রিমিয়াম হিসাবে নিজেদের ঘরে তুলেছে ২০ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা, কিন্তু চাষিরা হাতে পেয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা৷ বিমা কোম্পানিগুলি চাষিদের প্রাপ্য ৫ হাজার কোটি টাকা সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেয়নি৷ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার (পিএমএফবিওয়াই) অর্ন্তভুক্ত হয়ে কাজ করে এই বিমা কোম্পানিগুলি, অর্থাৎ সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই চাষিরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷
দেশের অর্ধেকের বেশি অংশ যখন ভয়াবহ খরার কবলে, সেই সময় নষ্ট হওয়া ফসলের জন্য বিমার টাকা পাওয়া দূরে থাক, ক্ষতি যে হয়েছে তা প্রমাণ করতেই হয়রান হচ্ছেন চাষিরা৷ নানা অজুহাতে বিমার টাকা দিতে অস্বীকার করছে কোম্পানিগুলি৷ কৃষকদের টাকা না দিয়ে বিমা কোম্পানিগুলি লাভ করছে হাজার হাজার কোটি টাকা৷
মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই খরা চলছে৷ বহু জেলায় নদীগুলি শুকিয়ে গেছে৷ চাষিদের ফসল শুকিয়ে গেছে৷ চাষের জল, শিল্প–কলকারখানায় ব্যবহারের প্রয়োজনীয় জল নেই– এমনকি পানীয় জল, শৌচাগারে ব্যবহূত জল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না৷ জলাধারগুলির জল শুকিয়ে গেছে৷ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও বৃষ্টির জলের উপরই একমাত্র ভরসা রাখতে হচ্ছে চাষিদের৷ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে খরা কবলিত এলাকায় রিলিফ ও চাষিদের ঋণ ছাড় দেওয়ার বিষয়ে৷ খরা মোকাবিলার বহু আলোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ এই বছর প্রথম তিন মাসে ৮০৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ অথচ মহারাষ্ট্র খরাপ্রবণ রাজ্য এটা নেতা–মন্ত্রীদের অজানা নয়৷ গত তিন বছর ২০১৫–১৮ সালের মধ্যে বিজেপি শাসিত এই রাজ্যেই শুধু ১২ হাজার ২১ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ তা সত্ত্বেও খরা মোকাবিলায় বিজেপি–শিবসেনা জোট সরকারের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷
কর্ণাটকের ঘটনা আরও নাটকীয়৷ লোকসভা নির্বাচনের আগে কৃষকদের মহাজনদের থেকে নেওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাজ্য সরকার৷ সেই মতো তাঁদের অ্যাকাউন্টে সেই পরিমাণ টাকা ঢুকেছিল৷ কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা গেল তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকা মুছে গেছে৷ ইয়াদগিরি জেলার সাগর গ্রামের চাষি সিভাপ্পা তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে (এপ্রিল মাসে) ৪৩ হাজার ৫৫৩ টাকা ঢুকতে দেখেন৷ তিনি ভাবেন, সরকার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে কিন্তু ৩ জুন দেখেন, কোনও কারণ না দেখিয়েই ওই টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব হয়ে গেছে৷ এরকম আরও ১৩ হাজার ৯৮৮ জন কৃষক, যাদের টাকা ঢুকেছিল, তাদেরও টাকা গায়েব হয়ে গেছে নির্বাচনের পর৷ মুখ্যমন্ত্রী এ সমস্তই ‘বিরোধীদের মিথ্যা ও ভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা’ বলে জানিয়েছেন, এগুলি সবই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ জাতীয় ব্যাঙ্ক৷
চাষিদের এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থা, চাষের ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও খরা ঘোষণা করেনি৷ জলশক্তি মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত নতুন মন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াত দাবি করেছেন, দেশে কোথাও খরা নেই৷ তাহলে নীতি আয়োগের বৈঠকে খরা নিয়ে আলোচনা হল কেন? দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত পরিবারে নলবাহিত জল পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তারও আগে মধ্যপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে কৃষকদের আন্দোলন ধামাচাপা দিতে তাদের ঋণ মকুব করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ও বিজেপি শাসিত রাজ্যের তাঁর অনুগত মুখ্যমন্ত্রীরা৷ কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি৷ দেশ জুড়ে কৃষি ও কৃষকের ভয়ঙ্কর দুরবস্থা চলছে৷ উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা চাষের জল ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মহত্যার অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন৷ আবারও সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি বিতরণ করেই কি প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব সারবেন? এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কৃষি ঋণ মকুব ও ফসল বিমা যোজনার শুকনো প্রতিশ্রুতি অসহায় কৃষকদের প্রতি তামাশা ছাড়া আর কী?