বিপদে চাষিদের রক্ষা করবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে এসেছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই প্রকল্প জনসমক্ষে আনা হয়েছে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে৷ এই প্রকল্প নিয়ে আসার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল, দেশের চাষিদের স্বার্থ আগের তুলনায় অনেক বেশি রক্ষিত হবে৷ বলেছিলেন, এই প্রকল্পে সবচেয়ে কম প্রিমিয়াম দিয়ে বিবিধ সুবিধা পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে বিমা সংস্থা চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেবে৷ খরা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমন সুবিধা মিলবে৷ আবার রোগে কোনও ফসল নষ্ট হলেও ক্ষতিপূরণ মিলবে৷ কেন্দ্র এবং রাজ্য চাষিদের হয়ে বিমার প্রিমিয়াম দেবে৷ আবার চাষিদেরও একটা অংশ দিতে হবে৷ এটাই হল মূল প্রকল্পের মূল কথা৷
এই বিমা সম্পর্কে গত দু’বছরে চাষিদের অভিজ্ঞতা কী? দেশ জুডে চাষিদের অভিযোগ, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার শরিক হয়ে প্রতারিত হচ্ছেন৷ এ রাজ্য সহ অন্যান্য রাজ্যে প্রতিনিয়ত এ ধরনের অভিযোগ উঠছে৷ ‘ফ্যাক্টচেকার’ নামের এক তদন্তকারী সংস্থা জানাচ্ছে, মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম জেলা হার্ডদারে দুই শতাধিক চাষি সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন কৃষি বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ তাঁদের অভিযোগ হিসাবের কারচুপিতে তাঁদের পাওনা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে৷ দ্বিতীয়ত, এই হিসাবেরও হের ফের ঘটিয়ে কম টাকা পেমেন্ট করছে বিমা কোম্পানিগুলি৷ তৃতীয়ত, বিমা চুক্তির বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলিকে কোনও রকম মান্যতা না দিয়েই ক্ষতিপূরণের হিসাব কষা হচ্ছে৷
একই অভিযোগ এসেছে মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাডু রাজ্য থেকেও৷ অভিযোগ এসেছে মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলা থেকেও৷ হার্ডদা জেলায় যে বার সয়াবিন চাষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সে সময় বিমা নির্ধারিত ফর্মুলা প্রয়োগ করে জানা যায় যে, প্রত্যেক চাষি বিমা কোম্পানি থেকে একর পিছু ৪,৫৪৩ টাকা করে পাবেন৷ অথচ বিমা কোম্পানি প্রত্যেক চাষিকে দিয়েছে একর পিছু মাত্র ১,৭০০ টাকা যা প্রকৃত পাওনার চেয়ে ৬২.৫ শতাংশ কম৷ এ নিয়ে সরকারের ভূমিকা কী? সরকার কোনও রকম পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসেনি৷ আর বিমা কোম্পানিগুলির লোকবল এত কম, পরিকাঠামো এত দুর্বল যে সঠিক হিসাব করাও তাদের কাছে এক দুরূহ ব্যাপার৷ মাঝখান থেকে মার খাচ্ছে সাধারণ চাষিরা৷ এই সমস্যা চাষিদের মধ্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর অস্থিরতায় ঠেলে দিচ্ছে, যা অনেক সময় তাঁদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে৷
আর একটি বিষয়ও খুব উদ্বেগের৷ চাষিদের একটা বড় অংশ এই বিমার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন না৷ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে যারা চাষ করছেন, ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তাঁরা এই যোজনার অংশীদার হতে পারলেও, বাকিদের একটা বড় অংশ নানা কারণে থেকে যান এই প্রকল্পের বাইরে৷ কৃষি দফতরের এক তথ্য বলছে, জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট কৃষকের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার৷ ফি বছর বিভিন্ন মরসুমে বিমার আওতায় আসেন আড়াই থেকে তিন লক্ষ চাষি৷ প্রায় ৫০ শতাংশ চাষি নানা কারণে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ সরকারি সহায়তাও এক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম৷ আবার আবেদনকারীদের ফসল নষ্ট হলেই যে তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাবেন এমনটা সবসময় হয় না৷ আবেদন করার সময়ও দেওয়া হয় খুব কম৷ তাছাড়া বিমা সংস্থাগুলির পরিকাঠামোর অভাব৷ নিয়ম হল, প্রাকৃতিক কারণে কোনও এলাকায় অন্তত ৩৩ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হলে তবেই ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় নাম ওঠে৷ ব্যক্তিগতভাবেও কোনও চাষি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে পারেন৷ কৃষি দফতর এবং বিমা সংস্থার কর্মীরা এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করেন৷ কিন্তু সমস্যা হল, বহু ক্ষেত্রে নিচু তলায় বিমা সংস্থার কোনও অফিস থাকে না৷ এমনকী, ব্লক বা জেলায়ও বিমা সংস্থাগুলির তেমন পরিকাঠামো নেই৷ আবার কিছু ক্ষেত্রে অফিস থাকলেও সংস্থাগুলির কর্মী সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷ তাছাডা মাঝে মধ্যেই বিমা কোম্পানি বদলে যাওয়ার কারণেও কৃষকরা নাজেহাল হন৷ বিমা করানো থাকলেও বহু ক্ষেত্রে সে কারণে টাকা মেলে না৷ এভাবেই বিমা কোম্পানিগুলির লাভ ক্রমবর্ধমান আর প্রতারিত হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা৷ এরপরও যারা টাকা পাচ্ছেন সেই পাওনা টাকার হিসাবের মধ্যেও থাকছে নানা কারচুপি৷
এর আগে কোনও রকম ফসল বিমা প্রকল্প ছিল না, এমনটা নয়৷ এর আগেও চালু ছিল এ জাতীয় বিমা প্রকল্প, যার নাম ছিল ন্যাশনাল এগ্রিকালচার ইন্সিওরেন্স স্কিম এবং পরে যার নাম হয় মডিফায়েড ন্যাশনাল এগ্রিকালচার ইন্সিওরেন্স স্কিম৷ নতুন প্রকল্প আনার অব্যবহিত পরে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এক প্রশ্ণের উত্তরে বলেছিলেন, পূর্বতন ফসল বিমার সাথে বর্তমান ফসল বিমার পার্থক্য হল, পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ টাকা চাষিরা ক্ষতিপূরণ হিসাবে পাবে৷ বর্তমানের বাস্তব চিত্র কিন্তু সে কথা বলছে না৷ ২০১১–১২ থেকে ২০১৫–১৬ আর্থিক বছরগুলিতে বিমার মোট প্রিমিয়াম যা সংগৃহীত হয়েছিল তার সমপরিমাণ বা কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দাবিদার কৃষকদের দিতে হয়েছিল৷ অথচ ২০১৬–১৭ আর্থিক বছরে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা লাগু হওয়ার পর দেখা গেল চিত্রটা উল্টে গেছে৷ এ ক্ষেত্রে মোট প্রিমিয়ামের ৬৯.৭১ শতাংশ ক্ষতিপূরণ বাবদ ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের দেওয়া হয়েছে৷ ইন্সিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার ২০১৭–১৮ বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬–১৭ আর্থিক বছরের সময়সীমায় ফসল বিমা প্রকল্প বাবদ ১১ টি প্রাইভেট বিমা কোম্পানির লাভের পরিমাণ ৩০৭৪ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ বিমা কোম্পানির লাভের অঙ্ক বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই নতুন সরকারের হাত ধরে নতুন বিমা প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে৷ এখানে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের স্বার্থ কতখানি রক্ষা পেল তা নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই৷ এ সত্য আরও পরিষ্কার হবে যদি আমরা ২০১৭–১৮ আর্থিক বছর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার দ্বিতীয় বছরের হিসাবের পর্যালোচনা করি৷ এই সময়সীমায় দেখা যায়, সংগৃহীত মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ যেখানে ২৫,১৪০ কোটি টাকা সেখানে মাত্র ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ ১২,৪০৮ কোটি টাকা দাবিদার চাষিদের দাবি মেটাতে ব্যয়িত হয়েছে৷
কেন এবং কীভাবে বিমা কোম্পানিগুলির অর্থ ভাণ্ডার পুষ্ট হচ্ছে তা একটি বিশেষ ক্ষেত্র নিয়ে দেখা যাক৷ অনিল জাট নামে হার্ডদার জেলার ৩২ বছর বয়সী এক কৃষকের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার টিমারনি শাখায় কিষান ক্রেডিট কার্ড স্কিমে অ্যাকাউন্ট আছে৷ সেখান থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই সয়াবিন ফসলের বিমা বাবদ প্রিমিয়াম কাটা হয়েছে ২,৪১২ টাকা৷ ঐ বছর ২৪ সেপ্টেম্বর প্রবল বৃষ্টিতে তাঁর ৮.৫ একর জমির সয়াবিন চাষ নষ্ট হয়ে যায়৷ ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তিনি এগ্রিকালচার ইন্সিওরেন্স কোম্পানি অফ ইন্ডিয়াকে চিঠির মাধ্যমে জানান তাঁর ৮৫ শতাংশ সয়াবিন বন্যায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ এই কোম্পানির কোনও অফিস জেলায় না থাকায় তিনি ঐ চিঠি জেলা কৃষি দপ্তরে জমা করেন৷ ওই দিনই তিনি একটি ক্লেম ফর্মের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণেরও দাবি করেন, যে ফর্মে নিয়ম অনুযায়ী ব্যাঙ্ক ম্যানেজারেরও সই ছিল৷ দু’দিন পর পর্যন্ত দেখা গেল ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিমা কোম্পানির কোনও প্রতিনিধি মাঠ পরিদর্শনে আসেননি৷ নিয়ম অনুযায়ী ঐ বছর অক্টোবরের শেষে তাঁর ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার কথা৷ না পেয়ে তিনি যান কনজিউমার ফোরামে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের আগস্টে তিনি পান ৪,৪২৩ টাকা৷ এ কেবল জাটের নয়, অন্তত আরও ৮ জন কৃষক এভাবেই ঐ এলাকায় প্রতারিত হয়েছেন৷
জাটের হিসাব অনুযায়ী বিমা কোম্পানির শর্ত মোতাবেক এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হওয়া উচিৎ ছিল ৪৭,৬০০ টাকা৷ এ নিয়ে বিমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ‘এরিয়া কারেকশন ফ্যাক্টরে’র তত্ত্ব দিয়ে জাটের দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়৷ অথচ রাজ্য কৃষি দপ্তরের প্রচারপত্রে এ জাতীয় কোনও ফ্যাক্টরের উল্লেখ ছিল না৷ এ রকম বিভিন্ন শর্ত বা হিসাবের পদ্ধতি সাধারণ কৃষকদের কাছে অজ্ঞাত৷ ২০১৭ সালে কম্পড্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ৬৩ শতাংশ চাষির এই যোজনার প্রিমিয়ামের হার, রিস্ক্, ক্লেম, তার হিসাব সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই৷ অর্থাৎ এভাবেই সাধারণ মানুষের টাকা দিয়ে বিভিন্ন বিমা কোম্পানির অর্থ ভাণ্ডারকে পুষ্ট করা হচ্ছে৷ বিমা কোম্পানির হাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সময়ে সময়ে এমন অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে যাতে অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা করতে তাদের কোনও অসুবিধা না হয়৷