‘সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু, তা সে যেখানেই হোক না কেন, ঘোর নিন্দাযোগ্য।’ বক্তার নাম শুনলে চমকে যেতে পারেন। কথাগুলি বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত জি-২০র অনলাইন বৈঠকে, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনার শেষে। বহু মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও যাঁর মুখ থেকে একটি নিন্দাবাক্য বের হয়নি, তাঁর মুখ থেকে এমন কথা শুনলে চমক লাগারই কথা। সাথে ভাবনা হয়, যিনি মণিপুরে জাতিগত দাঙ্গায় মাসের পর মাস অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, গুজরাট উত্তরপ্রদেশ দিল্লি সহ দেশ জুড়ে একের পর এক দাঙ্গায় অজস্র মানুষের প্রাণহানি, ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি দেখেও নিশ্চুপ থেকেছেন তাঁর হঠাৎ এমন বোধোদয়ের কারণ কী।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ইজরায়েল-হামাস সংঘাত যাতে কোনও ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের চেহারা না নেয় তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বলেছেন, নিষ্পাপ শিশু এবং মহিলাদের উপর আক্রমণ একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, জি-২০র বৈঠকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির বেশিরভাগই যে ভাবে যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে সুর চড়িয়েছে তার চাপেই প্রধানমন্ত্রীর এই সুর পরিবর্তন।
ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের উপর নির্বিচারে আক্রমণ চালিয়ে শয়ে শয়ে মহিলা ও শিশুকে হত্যা শুরু করলে তার বিরুদ্ধে ভারত সহ বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মানুষ তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়তে থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একটিও নিন্দাবাক্য উচ্চারণ দূরের কথা ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে তাঁকে সমর্থনের কথা জোর গলায় ঘোষণা করেছেন। মণিপুরে শয়ে শয়ে নারী-শিশু সহ সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছেন, দেশজুড়ে দাবি উঠছে– প্রধানমন্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করুন, পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধর্ম পালন করুন, দু-পক্ষের মাঝে গিয়ে দাঁড়ান। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সচেতন নীরবতায় সব দাবিকে অগ্রাহ্য করে হত্যাকাণ্ড চলতেই দিয়েছেন। গুজরাট দাঙ্গায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। সে-সময় তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। হত্যাকাণ্ড আটকানোর কোনও চেষ্টা দূরে থাক, নীরব থেকে তা চলতে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ভূমিকা দেশজুড়ে এতই ধিক্কৃত হয় যে, তার প্রতিক্রিয়া সামলাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত তাঁকে তাঁর রাজধর্ম পালন করার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য হন। তা হলে আজ হঠাৎ কী এমন ঘটল যে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে শান্তির দূত হিসাবে তুলে ধরতে তৎপর হয়ে উঠলেন?
দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্যের কারণে ভারতের জনগণ সব সময়ই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জনমতের এই চাপে দেশের শাসকরাও সাহস করেনি সাম্রাজ্যবাদী হামলাবাজদের পক্ষ নিতে। এই ঐতিহ্য মেনেই ভারত প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবির পাশে সব সময়ই দাঁড়িয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে দু-পায়ে মাড়িয়ে বিজেপি সরকারই প্রথম প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী হামলাকে সমর্থন জানাল। কেন প্রধানমন্ত্রী এমন বিপরীত রাস্তায় চলতে শুরু করলেন? তীব্র মুসলিম বিদ্বেষই কি এর কারণ? উগ্র ইহুদিবাদ এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ– এই দুই ধর্মান্ধ মতবাদের মিলই কি রয়েছে এই সমর্থনের পিছনে?
না, এগুলিই একমাত্র কারণ নয়। বিষয়টি এত সরলও নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকেই কংগ্রেস-যু্ক্তফ্রন্ট-বিজেপি নির্বিশেষে ভারতের সরকারগুলি মুখে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবিকে ন্যায্য বলে স্বীকার করলেও ধীরে ধীরে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকতে থাকে। বিজেপি শাসনে ইজরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে ভারত সরকারের সখ্যতা গভীর হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসার পর তা ব্যাপক মাত্রা নিয়েছে। দুই দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম সহ প্রতিরক্ষা লেনদেন ব্যাপক আকার নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যস্থতাতেই বিজেপির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ধনকুবের আদানিদের সঙ্গে ইজরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাইফা বন্দর অধিগ্রহণ সহ অন্যান্য নানা ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে। টাটা, মাহিন্দ্রা, সান ফার্মা, উইপ্রো, ইনফোসিস সহ ভারতীয় বহু কোম্পানি ইজরায়েলের নানা কোম্পানির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ব্যবসায়িক লেনদেন চালাচ্ছে। ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির এই ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই নরেন্দ্র মোদিরা আজ দেশের সমস্ত ঐতিহ্য, মর্যাদা, মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে জনমতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এই অন্যায় যুদ্ধে ইজরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু ইতিমধ্যে গোটা আরব বিশ্ব জুড়ে প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েলের বর্বর আক্রমণ এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ভারতের ইজরায়েল-সমর্থনের বিরুদ্ধে প্রবল ধিক্কার উঠেছে। জনমতের এই চাপ আরব সরকারগুলির উপরেও সমান তালে বাড়ছে। আরব দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ কম নয়। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে সেই লেনদেনে তা প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এই অবস্থায় বিজেপি সরকার নির্লজ্জ ইজরায়েল-সমর্থন বজায় রেখেও শান্তির কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। সেই বাধ্যতারই মৃদু উচ্চারণ শোনা গেছে জি-২০ বৈঠকে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী এই শান্তির বাণী আওড়ানোর সময়েও ইজরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
ঠিক একই জিনিস দেখা যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরোধিতায় গোটা বিশ্বের মানুষ সোচ্চার হলেও বিজেপি সরকার তার নিন্দা করেনি। সেখানেও দেখা গেছে, ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থই ভারত সরকারের বিদেশনীতি এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতিকে পরিচালিত করেছে। যুদ্ধ বিরোধী মানুষ যখন রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করার দাবি তুলছে, তখন ভারত রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বিপুল পরিমাণে বাড়িয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিজেপি সরকার রাশিয়া থেকে অতি সস্তায় তেল আমদানি করার সুযোগ করে দিয়েছে ভারতীয় একচেটিয়া তেল কোম্পানিগুলিকে। তারা সস্তায় আনা তেল শোধন করে ইউরোপ সহ বিশ্বের দেশে দেশে এবং ভারতীয় বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে চলেছে। অথচ ভারতের জনগণকে এই সস্তা তেলের এতটুকু সুবিধাও পেতে দেয়নি নরেন্দ্র মোদি সরকার।
শুধু বিজেপি সরকারই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রনায়কদের কাছেই যুদ্ধ কিংবা শান্তি সব কিছুই নির্ধারিত হয় দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থের দিখে লক্ষ্য রেখে। তাই ইউক্রেন কিংবা প্যালেস্টাইন– এত ধ্বংস, এত মৃত্যু দেখেও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি যুদ্ধের অবসানে কোনও কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে বরং যুদ্ধকেই মদত দিয়ে চলেছে এবং নিজ নিজ দেশের অস্ত্র উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিরাট সুযোগ হিসাবেই যুদ্ধকে কাজে লাগাচ্ছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও এই শান্তির ভেক বিপন্ন মানুষের প্রতি কোনও দরদ থেকে নয়, দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির ব্যবসায়িক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই। দেশের প্রান্তে প্রান্তে শত সহস্র নারী-শিশুর রক্তে যে প্রধানমন্ত্রীর হাত রঞ্জিত তাঁর মুখে শান্তির বাণী যে নিপীড়িত মানুষের প্রতি পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয় তা দেশের মানুষকে পরিষ্কার ভাবে আজ বুঝতে হবে এবং যথার্থ শান্তির পক্ষে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সরকারকে বাধ্য করতে যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে সেই আন্দোলনে সামিল হতে হবে।