অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন তাঁর দ্বিতীয় বাজেট পেশ করেছেন। বলা হচ্ছে, এটাই নাকি দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতা। কিন্তু তাতে দেশের মানুষের জন্য আছেটা কী? সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির তাবড় সব নেতারা কেউই সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। বিরাট বত্তৃতার বিশাল নথিটি দেশের মানুষের কোন কম্মে লাগবে তাই স্পষ্ট হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদি জমানায় সরকারের বৈশিষ্ট্য হল, আসল কাজ কিছু করার দরকার নেই। কোনও ভাবে একটা তাক লাগিয়ে দিতে পারলেই হল! অনেকটা যেন লম্বা দাড়ি রেখে রেকর্ড করে পৃথিবীবিখ্যাত হওয়ার মতো চেষ্টা।
দেশের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কেনার ক্ষমতা কমে যাওয়া। গ্রামীণ ভারতে যা আরও মারাত্মক আকার নিয়েছে। সরকারের লেবার বুরোর হাউসহোল্ড সার্ভে দেখিয়েছে গ্রামীণ মজুরির প্রকৃত হার অক্টোবর ২০১৯-এ প্রায় ৪.৭ শতাংশ কমে গেছে (দ্য হিন্দু, ২.০২.২০২০)। যা মূল্যবৃদ্ধি তাতে মজুরির হার আরও অনেকটাই কমবে। কিছুদিন আগেই নানা বেসরকারি কোম্পানির কর্তারা বারবার বলেছিলেন, গ্রামে দু’টাকার শ্যাম্পু, পাঁচ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট কিনতে গেলেও মানুষ দশবার ভাবছে। দেশের মানুষের এই ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে অর্থনীতির সাময়িক ঝিমুনি, বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাব ইত্যাদি নানা কিছু বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে সরকার। কিন্তু এটাই যে দেশের অর্থনীতির মূলকাঠামোটিতেই পুরোপুরি ঘুণ ধরে যাওয়ার প্রকাশ, তা সরকার স্বীকার করেনি। যদিও যে সরকার দু’দিন আগেও মানতে চাইছিল না যে, দেশে আদৌ কোনও আর্থিক সংকট আছে, তারা আজ অন্তত আন্তর্জাতিক মন্দার দোহাই পেড়ে মন্দার উপস্থিতিটুকু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু কোন জাদুতে দেশের বাজারে চাহিদা বাড়বে? অর্থমন্ত্রী লম্বা বত্তৃতাতেও সে কথাটুকু উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন! চাহিদা বাড়ানোর জন্য তিনি পরিকাঠামো অর্থাৎ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট-ব্রিজ ইত্যাদি তৈরিতে বেসরকারি পুঁজিকে ছাড় দিয়ে অনেক আশা দেখিয়েছেন। আর তার সাথে বেচে দিয়েছেন এলআইসির মতো সরকারি সংস্থাকে– যে সংস্থার ভরসায় বহ সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের পরিবারের দিন গুজরান হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া, এইচপিসিএলের মতো লাভজনক কোম্পানি বেচে তাঁর সরকার আগেই ‘বেচারাম সরকার’ নাম কিনেছে। এবার এলআইসি বেচে পুরোপুরি বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশের মানুষের কষ্টের টাকায় গড়া সম্পদ বিক্রি করাই তাদের সরকারের একমাত্র উপায়। বিজেপি যাদের দাসত্ব করতে সরকারে এসেছে, গত বাজেটে সেই কর্পোরেট প্রভুদের ১ লক্ষ কোটি টাকা করছাড় দিয়ে সরকারের রাজস্বের হাল ভাঁড়ে মা ভবানী। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলের এক লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও তা পূর়ণ করা যায়নি। এতে বাজারও চাঙ্গা হয়নি। এ দিকে রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিতে অর্ধেক করতে হয়েছে খাদ্যসুরক্ষার বাজেট। কমেছে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের বরাদ্দ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন তাঁর বাজেটের পাতায় পাতায় নাকি এত কর্মসংস্থানের ফিরিস্তি আছে, যে তা পড়তেই তাঁর সময় লেগে গেছে। কিন্তু কোথায় কর্মসংস্থান? গত আর্থিক বছরে বেকারত্বের হার ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। অর্থমন্ত্রী তার সমাধান কী করেছেন? তিনি দাওয়াই দিয়েছেন সরকারি চাকরির সংস্থা তৈরি হবে, এখন থেকে একটি পরীক্ষাতেই যেন জুটে যাবে সরকারি চাকরি। অথচ বলেননি সরকারি চাকরি বলতে দেশে কতটুকু তাঁরা অবশিষ্ট রেখেছেন? সরকারি চাকরি যা আছে তার বেশিরভাগটাই আউটসোর্সিং করে দিয়েছেন।
কর্মসংস্থান হবে কোথা থেকে? এ বছরের অ’ফ্যাম রিপোর্ট বলছে, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে যেখানে ৭০ শতাংশ লোকের হাতে যত সম্পদ আছে তার চার গুণ বেশি সম্পদ জমা হয়েছে ১ শতাংশের হাতে। এই ভয়াবহ বৈষম্যই তো দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা পুরোপুরি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, ‘উন্নয়ন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া’র তত্ত্ব– এসব কোনও বাগাড়ম্বরেই যে কাজ হবে না তা মন্ত্রী না বুঝতে পারেন, জনগণ হাড়ে হাড়ে বোঝে।
দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারে অনেক কারচুপি করেও বাজেটের তথ্যে অর্থমন্ত্রী তাকে ৫ শতাংশের উপরে তুলতে পারেননি। তাঁর রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানার লক্ষ্যমাত্রাও যে পূরিত হয়নি সে কথাও তাঁকে মানতে হয়েছে। তারপরেও অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী বছরে বাজার চাঙ্গা হবে এবং জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কোন ম্যাজিকে? সরকারের সমর্থক আর কর্পোরেট মিডিয়ার ভাষ্যকাররা বলে চলেছেন, আবাসন আর পরিকাঠামো শিল্পে যে ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, তাকে ধরেই বাড়বে সাধারণ মানুষের রোজগার, বাড়বে কেনাকাটা। কাটবে আর্থিক সংকট। কিন্তু মূল ক্ষেত্রগুলিতে সংকট কাটার কোনও লক্ষণ অতিবড় বিজেপি সমর্থকের পক্ষেও বোধহয় দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
এর জন্য কী দরকার ছিল? বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, শহর এবং গ্রামের কোটি কোটি মানুষের হাতে বাড়তি রোজগার, বাড়তি টাকার বন্দোবস্ত করে না দিলে বাজারের মন্দা কাটার কোনও পথ নেই। তারাও লিখছে, কর্পোরেট কর কমিয়ে, উচ্চমধ্যবিত্তদের কিছু আয়কর ছাড় দিয়ে আর যাই হোক, বাজারের চাহিদা বাড়ানো যাবে না। তার জন্য গ্রামের এবং শহরের নিতান্ত সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী করেছেন তার উল্টো কাজটি। তিনি অি’জেন দিতে চেয়েছেন কর্পোরেট মালিকদের। ছাড় দিয়েছেন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীদের আর কৃষি বরাদ্দ কমিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন কৃষির উন্নতির জন্য তিনি বিরাট সুযোগ করে দিচ্ছেন। কী ভাবে? কৃষি ফসল পরিবহণের জন্য ‘কিসান রেল’ আর ‘কিসান উড়ান’ চালু হবে। তাতে কোন উন্নতিটা হবে? রেলের ঠাণ্ডা ওয়াগন আর বিমানের পেটে ভরে কৃষকরা তাঁদের ফসল দেশের নানা প্রান্তে পাঠিয়ে দিতে পারবেন! অর্থাৎ কৃষি ব্যবসা জমবে! কারা নিতে পারবে এই আধুনিক সুবিধা? উত্তরটা দিতে গেলে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই চলে। এর সুবিধা নেবে ভারতের বিশাল কৃষিক্ষেত্রে থাবা বসাতে যারা উদগ্রীব, সেই সব দেশি-বিদেশি কর্পোরেট হাউস। তাতে রিলায়েন্স, আদানি গোষ্ঠী, গোয়েঙ্কা, টাটা কিংবা আইটিসির মতো গোষ্ঠীদের লাভ। লাভ ওয়ালমার্ট, পেপসিকোর মতো দৈত্যাকার খাদ্য ব্যবসায়ী কোম্পানির। চাষির কী লাভ? তাদের হাতে বাজারের চাবিকাঠি অর্থাৎ বিপুল পুঁজি আছে নাকি?
সরকার কী করেছে? এবারের বাজেটে খাদ্য সুরক্ষায় শস্য কেনার বরাদ্দ ১ লক্ষ ৫১ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ৭৫ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অন্যান্য শস্য সংগ্রহের বাজেট ১ হাজার কোটি টাকা কমেছে। (ইকনমিক টাইমস, অনলাইন এডিশন, ১.০১.২০২০) অর্থাৎ শস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ার বদলে কমতে চলেছে। এমনিতেই গত বছর মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফা বাজেটে শস্য সংগ্রহের জন্য যে বরাদ্দ ছিল সরকার তার মাত্র ২.৮৮ শতাংশ কাজে লাগিয়েছে (দ্য হিন্দু, ২.০২.২০২০)। এবারে বরাদ্দ কমে অর্ধেক হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে সরকার কৃষকের ফসল ন্যায্য দামে বিক্রির বিষয়ে আদৌ ২মাথা ঘামাচ্ছে না। সারে ভর্তুকি কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা, প্রধানমন্ত্রী আনন্দ আয় সংরক্ষণ অভিযান প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষককে ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ অর্ধেক ছাঁটাই করা হয়েছে। মোট কৃষি বাজেট ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবে মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে এটা বৃদ্ধি নয়, বরং বরাদ্দ কমেছে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প যা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বলে পরিচিত, তাতে বরাদ্দ কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান কমবে।
উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে শুধু বাজেট কমেছে তাই নয়, শিক্ষার দরজাকে পুরোপুরি ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের সামনে খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের সাধারণ ঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে শিক্ষার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষায় ব্যবসা এবং মুনাফাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। স্বাস্থ্য খাতেও সামান্য কিছু বরাদ্দ বাড়ানের কথা বললেও আসলে জনস্বাস্থ্য থেকে সরকার যে পুরোপুরি সরে যাচ্ছে সেটাই দেখা যাচ্ছে বাজেটে। একমাত্র স্বাস্থ্যবিমাকেই সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে।
বাজেটের সামগ্রিক পর্যালোচনা দেখাচ্ছে এবারের বাজেট একটি অন্তঃসারশূন্য বাজেট। এ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি প্রভুদের সেবায় নিজেদের মন-প্রাণ ঢেলে নরেন্দ্র মোদির সরকার যে বাজেট এনেছে তাতে নিজেদের দেউলিয়া দশাটা আরও প্রকট হয়েছে।
(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৬ সংখ্যা)