চিন বা পাকিস্তান সাতদিন আগে জেনে ফেললে তেমন কোনও ক্ষতি হত না বা বিরোধী নেতারা জেনে ফেললে মোদীজির গদিও উল্টে যেত না, তবুও দেশবাসীর কাছে তা গোপন রেখে, কাউকে কোনও রকম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই রাত আটটায় টিভিতে আবির্ভূত হয়ে রাত বারোটায় দেশজোড়া ‘লকডাউন’ কার্যকরী করে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁর এই চমক দেওয়া ঘোষণার চরম মূল্য চোকাতে হচ্ছে দেশের মানুষকে আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে এবং বিপুল সংখ্যায় করোনা সংক্রমিত হয়ে।
লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল করোনা সংক্রমণ আটকাতে, একের সাথে অপরের ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার জন্য। আর সেই সুযোগে দ্রুত ও ব্যাপক সংখ্যায় পরীক্ষা করে সংক্রমিতদের সুস্থ করে তোলা ছিল সরকারের কর্তব্য। তারও আগে বিদেশ থেকে আগতদের কড়া নজরদারি ও কোয়ারেনটাইনে রাখা কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। মোদী সরকার সেই অবশ্য করণীয় কাজের কোনওটিই না করে তালি বাজানো, থালি বাজানো, ঘর অন্ধকার করে প্রদীপ জ্বালানো, কোটি কোটি টাকা খরচ করে হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়ানোর তামাশা করে গেল। একশো ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে করোনা প্রতিরোধে নামমাত্র বরাদ্দ করল। এমনকী করোনার বিরুদ্ধে প্রকৃত যোদ্ধা চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকুও তারা করল না। লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা তৈরি করা দূরে থাক, সরকার করোনা পরীক্ষা কম করার জন্যেই প্রথম থেকে ব্যস্ত থেকেছে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের রাজ্য গুজরাটের অ্যাডভোকেট জেনারেল হাইকোটে দাঁড়িয়ে স্বীকার করেছে, ডাক্তাররা করোনা পরীক্ষার যত প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন রাজ্যের বিজেপি সরকার তার ১০ শতাংশের কম পরীক্ষা করার অনুমতি দিচ্ছে। বিজেপি নেতাদের ঘনিষ্ঠরা জাল টেস্ট কিট, খারাপ ভেন্টিলেটর সরবরাহ করে লাল হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আর নামমাত্র বরাদ্দ নিয়ে এমন এক ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলস্বরূপ দেশে আজ আক্রান্তের সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়ছে।
আরও মারাত্মক ঘটনা, কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক সম্পর্কে মাসাধিক কাল চূড়ান্ত উদাসীন থেকে, তাদের কার্যত আশ্রয়হীন খাদ্যহীন রেখে, স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রায় কোনও ব্যবস্থা না করে বাস্তবে করোনা-আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে আজ তাদের ঘরে ফেরানো হচ্ছে। বাস্তবে ঘরে ঘরে করোনা ছড়ানোর বিপুল আয়োজন করা হচ্ছে। অথচ লকডাউনকে মোদীজি ‘গোপন অ্যাজেন্ডা’ না বানালে আজ হয়তো পরিযায়ী শ্রমিকদের এমন কষ্ট, ক্ষুধা, মর্মান্তিক মৃত্যু ও সংক্রমণের শিকার হতে হত না।
মানুষ কয়েক মাস আগেই দেখেছে, এই সরকারই জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণাকে ‘গোপন অ্যাজেন্ডা’ রেখে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কাশ্মীরে বিপুল সেনা ও আধাসেনা সমাবেশ ঘটিয়ে, হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটককে এবং হাজার হাজার তীর্থযাত্রীকে জম্মু-কাশ্মীর থেকে সরিয়ে এনেছিল। তা হলে করোনা-লকডাউন ঘোষণার সাতদিন বা দশদিন আগে থেকে কি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যের ছাত্র, পর্যটকদের ঘরে ফিরতে আবেদন বা ফেরানোর ব্যবস্থা করা যেত না? তখন তো রোগের সংক্রমণ মাত্র কয়েকশোতে আবদ্ধ ছিল। এমনকি লকডাউন ঘোষণার ঠিক পরেই রাজ্যগুলির সহযোগিতা চেয়ে যদি স্পেশাল শ্রমিক ট্রেন, চিকিৎসা করাতে গিয়ে আটকে পড়া রোগী ও তাদের পরিবার, পর্যটক ও ছাত্রদের বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা যেত তা হলেও তারা এমনভাবে আক্রান্ত হত না।
অথচ তখন প্রধানমন্ত্রী এসব নিয়ে কোনও কিছু না ভেবে ‘করোনা যুদ্ধ’কে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের সাথে তুলনা করে ১৮ দিনে যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনিয়ে হাততালি কুড়ানোর চেষ্টায় থাকলেন।
আজ দেশে যখন করোনা সংক্রমণের নিরিখে ভারতবর্ষ বিশ্বে অন্যতম স্থান দখল করে নিয়েছে, তখনও যে আদৌ করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর কোনও মাথাব্যথা মোদীজির আছে, তা মনে হয় না। তাঁর ২০ লক্ষ কোটির প্যাকেজেও করোনা প্রতিরোধ স্থান পায়নি। বরং লকডাউন কালে বৃহৎ পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের মুনাফার কমতি পুষিয়ে দিতে তিনি অকাতরে সুবিধা ও উপঢৌকন দিয়েছেন। অথচ যে হারে প্রতিদিন সারা দেশের জেলায় জেলায় নতুন নতুন এলাকায় সংক্রমণ ঘটছে তা নিয়ে সেই মানুষটি এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন, যে নরেন্দ্র মোদী ২৪ ঘন্টার ‘জনতা কার্ফু’ ‘তালি’ এবং ‘থালি বাজানো, ‘দিয়া জ্বালানো’র ডাক দিয়ে করোনাকে জব্দ করতে গিয়ে কত রকমই আস্ফালন না করেছিলেন!
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্বও অবশ্যই কম নয়। কিন্তু ওই হাস্যকর আস্ফালনগুলি যখন মোদীজিই করে যাচ্ছিলেন এবং করোনা সংক্রমণ কমার যখন কোনও লক্ষণই আজ দেখা যাচ্ছে না, তখন দেশবাসীর নরেন্দ্র মোদীকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে, এত দীর্ঘ লকডাউনে দেশের গরিব মানুষের জীব-জীবিকা রক্ষায় কী করেছে, জবাব চাই। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে করোনা চিকিৎসা খাতে কত বরাদ্দ করেছ তার হিসাব দাও। করোনা মহামারি ব্যাপকভাবে বাড়তে পরোক্ষ সাহায্য কেন তার জবাব সরকারকে দিতে হবেই।