Breaking News

প্রধানমন্ত্রীর কলসির অমৃত জনগণের জন্য নয়

 

দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। গত আট বছর ধরে দিচ্ছেন, এবারও দিলেন। ‘হর ঘর তিরঙ্গা’, ‘স্বাধীনতার অমৃতকাল’-এর নামে প্রচারের তুফান তোলার চেষ্টা হল শাসক দলের তরফ থেকে। আড়াল করার চেষ্টা হল দেশের হতদরিদ্র মানুষের ঘর না থাকা, পেটভরা খাবার না পাওয়া, বেঁচে থাকার অধিকার না পাওয়ার মতো জরুরি বিষয়গুলি। সোসাল মিডিয়ায় তেরঙা পতাকার ভিড়ে হারিয়ে গেল দেশের অগণিত চাষি-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা।

স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া জনগণের জন্য মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করা, বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা ভুলেও উচ্চারণ করলেন না। মঞ্চে যখন তিনি বলছেন মহিলাদের যেন অসম্মান করা না হয়, ঠিক তার পরই বিজেপির নেতারা গুজরাট গণহত্যার সময় বিলকিস বানোর ধর্ষণকারী এবং তাঁর পরিবারের ১৪ সদস্যের নৃশংস হত্যাকারীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। এই সম্মানই কি মহিলাদের দিলেন প্রধানমন্ত্রী?

প্রধানমন্ত্রী বললেন, শততম স্বাধীনতা দিবসে ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করবেন তিনি। করবেন কীভাবে? কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ না করে দেশকে উন্নত করা সম্ভব কি?

দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জাতপাত-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ শোনা গেল প্রধানমন্ত্রীর মুখে। আর ওদিকে উচ্চবর্ণের জন্য রাখা কলসী থেকে জল খাওয়ার অপরাধে রাজস্থানে উচ্চবর্ণের শিক্ষকের হাতে ৯ বছরের দলিত শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটল ঠিক দু’দিন আগে। রাজস্থানে তাঁর দলের এক নেতা সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে মারার ডাক দিয়েছেন ‘গোরক্ষার’ অজুহাতে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা তাঁর মুখে সাজে কি? আর দুর্নীতি বিরোধী তাঁর লড়াই কি কেবল বিরোধী দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের দুয়ারে সিবিআই-ইডি পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ? তাঁর দলের নেতারা তো খনি-রাফাল-কফিন-ব্যাপম সহ অসংখ্য দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, রাম-নাম করতে করতে অযোধ্যায় রামমন্দিরের জমি নিয়েও তারা কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করছে। আর পি এম কেয়ার ফান্ড! সেটা তো বর্তমান কালে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি।

আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই! সাম্প্রদায়িকতাই বিজেপির প্রধান পুঁজি। ভোটে জেতার জন্য ধর্মকে পুঁজি করে বারবার তারা হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি লাগিয়েছে। বিজেপি নেতাদের ‘অমৃত’বচনে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ইন্ধন পেয়েছে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাট সহ সারা দেশে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কর্ণাটকে বিজেপি সরকার এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে যে, স্বাধীনতা দিবসের দিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে।

এবারের স্বাধীনতা দিবসের সময় আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি প্রধানমন্ত্রী হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা ভুলতে চেয়েছিলেন! তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে, সবার জন্য বাড়ির ব্যবস্থা হবে ইত্যাদি। ২০২২-এর প্রায় শেষে এসে কৃষকরা দেখছেন, সেচ-সার-কীটনাশকের বিপুল খরচে চাষের খরচ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আজও চাষের জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সত্তে্বও অনেক চাষির খেতে জল পৌঁছয় না, উন্নত প্রথায় চাষ তো দূরের কথা। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিজীবী মানুষ সহ জনসাধারণের উপর। চাল, গমের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। শুধু নুন ভাত খাওয়া মানুষের চালটুকু জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বিজ্ঞাপন ছেয়ে রয়েছে সর্বত্র, অথচ প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজই হয়নি। বহু জায়গায় প্রকৃত প্রাপক ঘর পাচ্ছেন না, চলছে দলবাজি-স্বজনপোষণ-দুর্নীতি।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে কালো টাকা উদ্ধার করবেন। প্রত্যেক দেশবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে পৌঁছেও দেবেন। বহু সাধারণ মানুষ কালো টাকা উদ্ধারের কথাটা বিশ্বাস করেছিল, ভেবেছিল দেশের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই মিথ্যা বলবেন না। অথচ তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বলেছেন, এটা আসলে ‘জুমলা’। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দেবেন। চাকরি দেওয়া দূরের কথা, বছরে লক্ষ লক্ষ বেকার নতুন করে তৈরি হচ্ছে। তবে কোনও প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেননি প্রধানমন্ত্রী, এ কথা বলা যাবে না।

শিল্পপতিদের অবাধ ছাড়ের, তাদের লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুবের, তাদের প্রায় বিনা পয়সায় জমি, বিদ্যুৎ, খনি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করে চলেছেন। তার দাক্ষিণ্যেই তো আদানি-আম্বানি বিলিওনিয়ারের জগতে বিশ্বের এক-দু নম্বর হওয়ার দৌড়ে টেসলার এলন মাস্ক, লুইস ভুইটোর বার্নার্ড আরনল্ট এবং আমাজনের জেফ বেজোসের কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করছে! বিজেপির ‘দানেই’ তো লজ্জাজনকভাবে করোনা অতিমারির সময় আদানি-আম্বানিদের সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটির রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, দেশের ১ শতাংশ ধনীর হাতে ২২ শতাংশ সম্পদ এবং ১০ শতাংশ ধনীর হাতে দেশের ৫৭ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। অথচ ৫০ শতাংশ মানুষের মিলিত সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১৩ শতাংশ। ধনীদের হাতে গচ্ছিত সম্পদের রমরমাও বিজেপি সরকারের দৌলতে। ফলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন ধনকুবেরদের ক্ষেত্রে।

এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণকে যত প্রতিশ্রুতিই দিন না কেন, তাঁর কলসির অমৃত শুধু ধনকুবেরদের জন্য। সাধারণ মানুষ পেয়েছে শুধুই গরল।