প্রধানমন্ত্রীর কথার কারসাজি কৃষককে কোনও সুরাহা দেবে না

এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে যা বলেছেন এবং তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট না হয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ও দপ্তরকে বাজেট পরবর্তী ‘ওয়েবিনার-সিরিজ’-এর আয়োজন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত মোট ১২টি ওয়েবিনার আয়োজিত হচ্ছে। ওয়েবিনারের সবকটিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং বত্তৃতা দিয়ে চলেছেন।

ওয়েবিনার-সিরিজের দ্বিতীয় দিনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলেছেন যে, ২০১৪ সালের আগে কৃষিতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। তিনি ক্ষমতায় আসার ৯ বছর পর তা তিনি ৫ গুণ বাড়িয়ে করেছেন ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং সেই জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলির বাজেট হয়ে উঠেছে গ্রাম, গরিব ও কৃষকের বাজেট।

যেদিন তিনি বুক বাজিয়ে এই কথাগুলি বলছেন, ঠিক সেইদিনই তার দল বিজেপি শাসিত মহারাষ্টে্রর শোলাপুর জেলার বারশি তালুকের বড়গাঁও গ্রামের এক গরিব কিষাণ রাজেন্দ্র তুকারাম চ্যবন জানিয়েছেন, তার জমিতে উৎপাদিত ৫০০ কেজির কিছু বেশি পেঁয়াজ বিক্রির জন্য ৭০ কিলোমিটার দূরে বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে দর উঠেছে কেজি প্রতি ১ টাকা। মোট দাম হয়েছে ৫১২ টাকা ৭০ পয়সা। ট্রান্সপোর্টেশন খরচ ও অন্যান্য চার্জ বাবদ ৫০৯ টাকা ৫১ পয়সা কেটে নিয়ে তার হাতে দেওয়া হয়েছে ২ টাকা ৪৯ পয়সার একটি চেক। তিনি জানিয়েছেন, ঋণ করে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে দুই একর জমিতে তিনি পেঁয়াজ চাষ করেছেন। এখন তিনি ঋণশোধ করবেন কী ভাবে, বাঁচবেনই বা কী উপায়ে?

যিনি রাজেন্দ্র তুকারাম চ্যবনের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনেছেন, নাসির খলিফা নামে সেই ব্যবসায়ী বলেছেন, ফসলের দাম যাই হোক না কেন, ‘ডিজিটাইজেশনের দ্বারা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে রসিদ ও চেক এর মাধ্যমে ফসলের দাম দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী তাকে সেই চেক দেওয়া হয়েছে। রাজেন্দ্র তুকারাম চ্যবন বুঝতে পারছেন না এই ডিজিটাইজেশন পদ্ধতি চালুর দ্বারা তাঁর মতো চাষির কী লাভ হল?

যে বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্বের সাথে ওয়েবিনার সিরিজে কৃষকের উন্নতির গল্প শোনাচ্ছিলেন, সেই বাজেটের দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের দেশের কৃষিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, রোগপোকার আক্রমণে এবং নিকৃষ্ট মানের বীজ সরবরাহের ফলে ফসল নষ্ট হওয়াটা নিত্য দিনের ব্যাপার। যে কোনও দায়িত্বশীল সরকারের কৃষককে এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করাটা দায়বদ্ধতা। আমাদের দেশে এর জন্য নাম-কা-ওয়াস্তে ফসল বিমা বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই বিমাটির নামের সামনে ‘প্রধানমন্ত্রী’ কথাটি বসিয়ে করা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’। গত বছর এই যোজনায় বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ বছরের বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের চাইতে ১,৮৭৫ কোটি টাকা কম। প্রান্তিক চাষিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মাননিধি’ তে গত বছর বরাদ্দ করা হয়েছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ বছর তা কমিয়ে করা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। খাদ্যে ভর্তুকিতে গত বছর বাজেটে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এ বছর ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কমেছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় এ বছরের বাজেটে বরাদ্দ কমেছে ৩১.৫ শতাংশ। বরাদ্দ কমেছে ফসল বিমায় ১২.১ শতাংশ এবং পিএম কিসান সম্মান নিধিতে ১১.৮ শতাংশ।

চাষিরা যাতে ফসলের কিছুটা দাম পেতে পারে, তার জন্য মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট এর জন্য গতবছর বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ বছর সংখ্যাটা ‘কোটি’ থেকে নামিয়ে মাত্র ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি বলে থাকেন, তিনি কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন। কিন্তু বাজেট নিয়ে যাদের ধারণা আছে তারাই জানেন, যে হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে তাকে হিসাবে যুক্ত করে এবং নানা ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরিসরে বরাদ্দ করার ফলে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছরই বাজেটে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ আয়তনে বেড়েছে। কিন্তু কোনও সরকার যদি কোনও ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে থাকে, তা হলে তা সেই ক্ষেত্রটিতে মোট বাজেটের কত শতাংশ বরাদ্দ করা হচ্ছে তা দিয়ে বুঝতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০২১-২২ সালে বরাদ্দ করেছিল সমগ্র বাজেটের ৩.৭৮ শতাংশ, ২০২২-২৩ সালে তা কমে হয়েছে ৩.৩৬ শতাংশ এবং এ বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালে কৃষিতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের ২.৭৮ শতাংশ। তা হলে কৃষিকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হল কী ভাবে?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়েবিনার সিরিজের আলোচনায় তার বাজেটকে ‘গাঁও’য়ের বাজেট বলেছেন। সেই গাঁও বা গ্রামগুলিতে এখন শুধুই কর্মহীনতা। গ্রামীণ কর্মহীন মানুষগুলোকে গ্রামেই কাজ দেওয়ার জন্য যেখানে ১০০ দিনের কাজকে ২০০ দিন করার দাবি উঠেছে দেশের সর্বত্র, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ বছরের বাজেটে এমজিনারেগা-তে বরাদ্দ গত বছরের চাইতে ৩৩ শতাংশ কমানো হয়েছে। তার ফলে ঘরবাডি, আত্মীয়-স্বজন, গ্রাম ছেড়ে অন্য রাজ্যে এবং বিদেশে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আরও বিপুল হারে বাড়বে।

বাজেটে কৃষকদের জন্য অর্থ বরাদ্দে যতই কার্পণ্য থাকুক, কৃষকদের জন্য বাণী বিতরণে তিনি উদারহস্ত। তাই ওয়েব-সিরিজে তিনি কৃষকদের শোনালেন শ্রুতিমধুর নানা কথা। কৃষিতে অগ্রগতির সাল তারিখ উল্লেখ না করে বললেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ভারতের কৃষি দুর্দশার মধ্যে ছিল এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশকে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হত। সেই দেশকে আজ খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভর করেছে ভারতের কৃষকরাই। শুধু তাই নয়, ভারত আজ নানা ধরনের কৃষিপণ্য বিদেশেও রপ্তানি করছে। এই খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে ভারতকে খাদ্যে ‘আত্মনির্ভর’ করার কৃতিত্বটি কৃষকদের দেওয়ার কথা বলার সাথে সাথে কৃষির উন্নতির বাধাগুলি দূর করার লক্ষে্যই তার সরকার কাজ করে চলেছে–সেটাও শোনাতে ভোলেননি। শুনলে মনে হবে যেন তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ভারত খাদ্যে স্বয়ম্ভর হয়েছে।

তিনি এখানেই থামেননি। এখনও কোথায় কোথায় কৃষিতে বাধা রয়েছে তারও উল্লেখ তিনি করেছেন। ওয়েব সিরিজের আলোচনায় তিনি বলেছেন, ২০২১ সালে ডাল আমদানি করতে ১৭ হাজার কোটি টাকা, খাদ্যমূল্য যুক্ত পণ্য আমদানি করতে ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ভোজ্য তেল আমদানিতে দেড় লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ ডাল, তেল প্রভৃতি খাদ্যপণ্য আমদানিতে মোট দু লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে চলে গিয়েছে। ডাল এবং ভোজ্য তেল উৎপাদন বাড়িয়ে আত্মনির্ভর হয়ে এই টাকা বিদেশে চলে যেতে না দিয়ে এ দেশের কৃষকদের হাতে যাতে তুলে দেওয়া যায় সেই দিকে লক্ষ রেখেই নাকি তিনি বাজেট তৈরি করেছেন। অথচ, তিন কৃষি আইনে এই মোদি সরকারই তৈলবীজ এবং ভোজ্য তেলকে অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল এবং যুক্তি তুলেছিল এগুলোর সরবরাহে আর ঘাটতি নেই।

প্রধানমন্ত্রী আরও স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার সরকার ‘ডিজিটাইজেশন অফ এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং’ করে কৃষকদের বড়ই সুবিধা পাইয়ে দেবেন। গ্রামীণ যুব শিল্পোদ্যোগীদের উৎসাহিত করতে তিনি কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ চালুর কথা বলে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। গত বছরের এবং এ বছরের বাজেটে লক্ষ করলে দেখা যাবে মোদি সরকারের কৃষি বাজেটে বাস্তবে কৃষকদের প্রাপ্তি প্রায় শূন্য। চাষির চাষ করার জন্য যে উপকরণগুলির দরকার অর্থাৎ সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, সেচের জন্য বিদ্যুৎ, কৃষিযন্ত্রপাতি প্রভৃতি সবকিছুর দামই বেড়েছে বিপুল হারে। অন্য দিকে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনি গ্যারান্টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে তিনি দিয়েছিলেন, সেই পথে এক পা-ও হাঁটেননি। তাঁর বাজেটে দেখা যাবে, ফসল কৃষকের হাত থেকে সস্তায় ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীদের জন্য যা যা করণীয়, মোদি সরকার সে-সবই করেছে। তার দ্বারা বড় কৃষি ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের লাভ বৃদ্ধিতে তিনি নানা রকম সাহায্য করে চলেছেন।

কৃষককে ঋণ করে ফসল ফলানোতে বাধ্য করে, ঋণগ্রস্ত হওয়ার পর তা শোধ করার কোনও পথ না রেখে কৃষকদের আরও বেশি বেশি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে মোদিজির সরকার। তাই প্রধানমন্ত্রীর মিষ্টি কথায় কৃষকের সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। যদি সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, বিদ্যুতের দাম ও কৃষি যন্ত্রের দাম কমানোর জন্য এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি গ্যারান্টি পেতে হয় তা হলে কৃষকদের সাম্প্রতিক অতীতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া কৃষকের বাঁচার অন্য কোনও পথ খোলা নেই।