সরকারের সব রকমের ভয়-ভীতি, পুলিশি অত্যাচার, গ্রেফতার, মিথ্যা অভিযোগে মামলা সব কিছুকে হেলায় তুচ্ছ করে কৃষক আন্দোলন তিন মাসে পৌঁছতে চলল। যে আন্দোলন দিল্লি সীমান্তে ধরনা দিয়ে শুরু হয়েছিল তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ সারা দেশে। রাজ্যে রাজ্যে মহাপঞ্চায়েতগুলিতে কৃষকদের ভিড় উপচে পড়ছে। হরিয়ানা, পাঞ্জাবে বিজেপি নেতারা জনতার থেকে মুখ লুকোচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দ্রুত বাড়ছে। আন্দোলনের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি দেখে ভয় পেতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতারা। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতায় সেই ভয়ই ফুটে বেরল। যে আন্দোলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী এতদিন নিশ্চুপ ছিলেন, ভাবখানা ছিল এমন যেন আন্দোলন যে কিছু হচ্ছে তা তিনি জানেনই না– সেই আন্দোলনেরই নেতাদের তিনি ‘আন্দোলনজীবী’, ‘পরজীবী’ বলে যেন গায়ের ঝাল মেটালেন। প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চাইলেন, কৃষকরা আসলে কিছুই বোঝেন না। এই নেতারাই তাঁদের বিভ্রান্ত করছেন।
প্রধানমন্ত্রী আসলে খুব সচেতন ভাবেই আন্দোলনকারী কৃষক আর তার নেতৃত্ব, দুটিকে আলাদা করে দেখাতে চাইছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী খুব ভাল করেই জানেন, নেতৃত্ব ছাড়া কোনও আন্দোলনই হয় না এবং সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনও আন্দোলন সফলতার লক্ষে্য পৌঁছতে পারে না। আন্দোলন যদি নেতৃত্বহীন হয় এবং তা শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ থেকে গড়ে ওঠে, তবে তাকে দমন করাও সরকার তথা প্রশাসনের পক্ষে সহজ হয়। প্রজাতন্ত্র দিবসে সরকারি ষড়যন্তে্র আন্দোলনকারী কৃষকদের এক অতি ক্ষুদ্র অংশকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন গোটা আন্দোলনটাতেই কালি ছেটাতে চেয়েছিল। নেতৃত্বের বিচক্ষণতাতেই সরকার সে কাজে ব্যর্থ হয়। এই কঠিন সত্যটি প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই নেতৃত্বকে ‘আন্দোলনজীবী’, ‘পরজীবী’ প্রভৃতি বলে আন্দোলনকারী কৃষকদের থেকে তাঁদের বিছিন্ন করার এবং দেশের মানুষের সামনে তাঁদের আন্দোলনে বহিরাগত হিসাবে দেখানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী যা চাইছেন তা যদি সত্যি হত, যদি ভোটবাজ সংসদীয় দলগুলির টুইটারে গর্জনশীল নেতারাই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন, তবে হয়ত আন্দোলন দমন করতে প্রধানমন্ত্রীর সুবিধাই হত। কিন্তু কৃষক আন্দোলন তার মাটি থেকে লড়াইয়ের ময়দান থেকে নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে। চাইলেও তাই প্রধানমন্ত্রী আন্দোলন থেকে তাঁদের আলাদা করতে পারবেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত কৃষকরা, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের সব স্তরের মানুষ তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন। এই ধিক্কারের সামনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী সাফাই গেয়েছেন, ‘‘কৃষক আন্দোলনকে পবিত্র বলেই মনে করি। কিন্তু সেই পবিত্রতা যারা নষ্ট করেন, তাঁরা আন্দোলনকারী নন, আন্দোলনজীবী।” বলেছেন, যাঁরা হাজতে বন্দি সন্ত্রাসবাদীদের ছবি বুকে লাগিয়ে কৃষকের কথা বলছেন, টোল প্লাজা দখল করছেন, পাঞ্জাবে টেলিফোনের তার ছিঁড়ছেন, তাঁরা কৃষক আন্দোলনের পবিত্রতা নষ্ট করতে চান।
গত প্রায় তিন মাস ধরে প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে দু’শো জন কৃষক যে তিল তিল করে প্রাণ বিসর্জন দিলেন, তা প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ল না। কোথায় দুটো টেলিফোনের তার ছিঁড়েছে, সেটাই তাঁর কাছে বড় হল। এমনই হয়। যুগে যুগে শাসকরা এমন করেই মানুষের দাবিকে দাবিয়ে রাখতে, সত্যকে চাপা দিতে এমন করেই তুচ্ছ জিনিসকে সামনে এনে বড় করে দেখায়। এমন ভাষাতেই মানুষের ন্যায্য দাবিতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদের নিন্দা করে, তার নেতৃত্বের নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলে। ব্রিটিশরা বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী বলেনি? ফলে প্রধানমন্ত্রী নতুন আর কী বলেছেন!
কৃষকরা যে কোনও সন্ত্রাসবাদীর ছবি বুকে নিয়ে আন্দোলন করছেন না, তা প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। কৃষকদের বুকে আছে ভগৎ সিং, সুভাষচন্দ্র, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসফাকুল্লা, বিসমিলের ছবি। তাঁদের সংগ্রামের অনুপ্রেরণাই আন্দোলনকারীদের আজ এতখানি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি আন্দোলনজীবী হন, পরজীবী হন, তবে তো প্রধানমন্ত্রী ভগৎ সিং, সুভাষচন্দ্রদেরও পরজীবী বললেন! যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সুফল আজ ক্ষমতার গদিতে বসে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল ভোগ করছেন, সেই আন্দোলন কি নেতৃত্বহীন ছিল? অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন, তাঁদের পূর্বসূরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কিংবা হিন্দু মহাসভা কেউই সেই আন্দোলনে অংশ নেয়নি। ব্রিটিশকেই সহযোগিতা করেছিল।
অতীতের সব শাসকদের মতোই আজও সরকারের বিরুদ্ধে, রাষ্টে্রর বিরুদ্ধে যে কোনও ভিন্ন মতকে, ভিন্ন সুরকেই রাষ্ট্রদ্রোহ, দেশদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া এবং তার উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনাই বিজেপির রাজনীতি। সেই রাজনীতিই প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকার কৃষক আন্দোলন নিয়ে করছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশের মানুষের সামনে তাঁদের সেই স্বৈরাচারী শাসকের চরিত্রকে, আন্দোলন বিরোধী, কৃষক বিরোধী চরিত্রকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যে মতলব থেকেই বলুন না কেন, আন্দোলনকারী কৃষকরা ভাল করেই জানেন, আন্দোলনজীবী কথাটি গৌরবেরই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদের, আন্দোলনের পাশে এসে যাঁরা দাঁড়ান, তাঁরা মহৎ ব্যক্তি। যুগ যুগ ধরে মানুষ শাসকের, শোষকের শোষণ-অত্যাচারের শিকার হয়ে আসছে। তাঁদের জাগানোর, তাঁদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানোর কাজ তো এক মহান সামাজিক দায়িত্ব। আন্দোলনজীবীরা সেই দায়িত্বই পালন করছেন। আর যাঁরা আন্দোলন ভাঙে, আন্দোলনের নামে কুৎসা করে, যুগে যুগে মানুষ তাঁদের ঘৃণা করে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীরা তাই আজ মানুষের শুধু ঘৃণাই কুড়োবেন। প্রধানমন্ত্রীর আবদার, শোষণ-বঞ্চনা চলবে, কিন্তু আন্দোলন চলবে না। বাস্তবে এমন কখনও ঘটে না। যত দিন শোষণ থাকবে ততদিন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্দোলনও হবে।
আন্দোলনের নেতৃত্বকে বদনাম করতে করতেই প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে আইন সম্পর্কে পুরনো মিথ্যাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, বেসরকারি সংস্থার কাছে ফসল বেচতে বাধ্য করার কথা নতুন আইনে বলা হয়নি। কোনও অতি বড় স্বৈরশাসকও কি আইনে এমন কথা লিখতে পারে? প্রধানমন্ত্রীরা যদি এতই বোকা হতেন তবে ম্যানেজার হিসাবে তাঁদের আম্বানি-আদানিরা কখনওই বাছত না। ফলে সে কথা নিশ্চয়ই আইনের পাতায় তাঁরা লেখেননি। কিন্তু কৃষকরা এবং তাঁদের নেতারাও এতখানি বোকা নন যে, আইনের ফাঁকে এবং তার প্যাঁচে কী আছে, বা আইন প্রয়োগের ফল কী দাঁড়াবে, তা আগাম তাঁরা ধরতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রী নতুন আইনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছিল, আছে, থাকবে। সংসদে দাঁড়িয়ে বলছি।” প্রধানমন্ত্রী যদি এতই কৃষক দরদি, তবে সংসদে দাঁড়িয়ে যা এতখানি জোরের সঙ্গে বলছেন, তা আইনে এক লাইন লিখে দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না কেন? কেন তাঁরা এ ব্যাপারে জিদ করছেন? আসলে এর মধ্যেই আইনে কৃষকের ভাল করার মিথ্যাচারটি স্পষ্ট। একই সঙ্গে স্পষ্ট বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের ভণ্ডামিটিও।
প্রধানমন্ত্রী জানেন, সহায়ক মূল্য আইনসম্মত করে দিলে তাঁদের নতুন কৃষি আইন আনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। গোটা কৃষিক্ষেত্রটিকে যে আজ তাঁরা দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির অবাধ লুঠের জন্য খুলে দিতে চাইছেন, এ কাজের জন্য যে তাঁরা কর্পোরেট পুঁজির পায়ে দাসখত লিখে দিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন, সে উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যাবে। সহায়ক মূল্য আইনসম্মত হলে কর্পোরেট লুঠেরাদের যথেচ্ছ শোষণ-লুণ্ঠনের পথে বাধা পড়বে। বিজেপির কর্পোরেট প্রভুরা তা মানবে না। কৃষকদের লাগাতার আন্দোলন তাই যেমন কর্পোরেট পুঁজিপতিদের তেমনই বিজেপি নেতাদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা আসলে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে দম দেওয়া পুতুল। তারা যেমন চালায় এঁরা তেমনি চলেন। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থই বিজেপি নেতাদের স্বার্থ। দেশের জনগণের স্বার্থের সাথে এঁদের কোনও সম্পর্ক নেই শুধু নয়, জনগণের স্বার্থকে কর্পোরেট তথা একচেটিয়া পুঁজির পায়ে বলি দেওয়ার জন্যই তাঁরা নিয়োজিত। বিজেপি পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী একটি দল। তাঁদের রাজনীতিতে, নীতিতে, আচরণে, সরকার পরিচালনায়, আন্দোলন দমনে, বাজেটে-সব কিছুতে প্রতিদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়ছে।