প্রধানমন্ত্রীজি, নেতাজির পথে চলা আপনার কর্ম নয়

 

ইন্ডিয়া গেটের সামনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তির উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, গত আট বছরে তাঁর সরকার যে সমস্ত কাজ করেছে, যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে নেতাজির আদর্শ, স্বপ্নের ছাপ রয়েছে। বলেছেন, নেতাজির ভাবনার পথে চললে ভারত অনেক উঁচুতে পৌঁছতে পারত। তিনি এখন সেই পথেই চলেছেন বলে জানিয়েছেন মোদি।

বক্তার অতীত এবং বর্তমান কার্যকলাপ সম্পর্কে পরিচিতি না থাকলে কারও মনে হতে পারে, দেশে বোধহয় নেতাজির কোনও বড় অনুগামীর আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যকলাপ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এ-সবই যে প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর, একজন আপসহীন, আদর্শবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ নেতা হিসাবে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে দেশের মানুষের মনে যে গভীর আবেগ রয়েছে, তা আত্মসাৎ করার হীন প্রচেষ্টা ছাড়া এ যে আর কিছু নয়, তা বুঝতে তাঁদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন– কেন, প্রধানমন্ত্রী কি নেতাজির ভাবনার পথে চলতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কিন্তু যাঁর এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে, তিনিই বলবেন, প্রধানমন্ত্রী যে পথে চলেছেন, তা নেতাজির পথ তো নয়-ই, বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিপরীত পথে চলাটাই, নরেন্দ্র মোদি যে দলের নেতা, যে দলের সরকারের প্রধান হয়ে তিনি দেশ চালাচ্ছেন, সেই বিজেপির রাজনীতি। নিজেকে যে আরএসএসের সেবক বলতে তিনি গর্ববোধ করেন সেই আরএসএসেরও রাজনীতি।

প্রধানমন্ত্রীর দল বিজেপির পূর্বসূরি যে জনসংঘ, তার প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা। জনসংঘ এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মিলিত উদ্যোগে তৈরি হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএসের ভূমিকা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতার। সেই সময়কার ইতিহাসের খবর যাঁদের ভাল করে জানা নেই, তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন– এ কি কখনও হতে পারে যে, কোনও ভারতবাসী, ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিরোধিতা করছে। হ্যাঁ হতে পারে, যদি কারও দেশ সম্পর্কে, জাতীয়তা সম্পর্কে ধারণাটিই ঘোলাটে হয়, যদি এই ধারণার পিছনে অন্ধতা কাজ করে, পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রভাব কাজ করে। ঠিক এই জিনিসটিই ঘটেছিল আরএসএস-হিন্দু মহাসভার ক্ষেত্রে।

আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর আরএসএস-এর পরিচালক হন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএসের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল” (চিন্তাচয়ন, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৫)। অর্থাৎ আরএসএসের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন’। স্বাভাবিক ভাবেই এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা আরএসএস যে সর্বদাই জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাস্তবে স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণ কোনও সংগ্রামেই আরএসএস অংশগ্রহণ করেনি। পূর্বসূরিদের এই কলঙ্কিত অধ্যায় এখন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিজেপিকে বিপাকে ফেলেছে।

কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএসের এমন বিকৃত ধারণা হল কেন? আসলে জাতি গঠনের বৈজ্ঞানিক নিয়মকে, এ সম্পর্কিত ইতিহাসের ধারাকে তথাকথিত এই হিন্দুত্ববাদীরা উপলব্ধিই করতে পারেনি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ-পারসিক-খ্রিস্টান ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শত-সহস্র বছর ভারত ভূখণ্ডে বাস করে এসেছে পরস্পরের সাথে নিবিড় সংযোগ গড়ে তুলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অধীনতার শৃঙ্খল থেকে, একই শোষণ-যন্ত্রণা, একই অত্যাচার-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্খা ভারতীয় জাতি ধারণার জন্ম দেয়। জাতি গড়ে ওঠার এই বৈজ্ঞানিক কারণ ও পদ্ধতিটাকেই তারা অস্বীকার করে। বিজ্ঞানের যুক্তি ও ইতিহাসের ধারা অনুসরণ না করে মনগড়া ধারণার দ্বারাই আরএসএসের নেতারা পরিচালিত হয়েছেন। এই চিন্তা থেকেই তাঁরা সর্বদা হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি করেছেন। পরাধীন ভারতে তাঁরা ব্রিটিশদের শত্রু মনে করতেন না, করতেন মুসলমানদের। ঠিক যেমন এখনও তাঁরা শোষক পুঁজিপতিদের নয়, শত্রু মনে করেন মুসলিমদের। তাঁদের মতে, ‘‘আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে যে, সব কিছু করেছে একমাত্র হিন্দুরা। এর অর্থ কেবল হিন্দুরাই এই মাটির সন্তান হিসেবে এখানে বসবাস করেছে” (গোলওয়ালকর, চিন্তাচয়ন, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৩-২৪)। আরএসএসের এই বক্তব্য ভারতীয় জাতি গঠনের ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিরোধী। এমনকি বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথও এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘কোনও সভ্যতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত একটিও পাওয়া যায় না। একটি সুসভ্য জাতি আসিয়া কোনও জাতির সহিত মিশিয়া যাওয়া ছাড়াই যে জাতি সভ্য হইয়া উঠিয়াছে–এরূপ একটি জাতিও জগতে নাই।” (বিবেকানন্দ রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৪২)। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষের কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না। ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থপতিবিজ্ঞান প্রভৃতিতেও হিন্দু-মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে। তারই পরিচয়ে ভারতবর্ষীয়ের পূর্ণ পরিচয়” (রবীন্দ্র রচনাবলি, ১৪ খণ্ড, পৃঃ ২৫৯, বিশ্বভারতী সংস্করণ)। বিজেপি নেতারা এরপর হয়তো বলবেন, বিবেকানন্দ ঠিকঠাক হিন্দু ছিলেন না!

আবার, স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করা এক জিনিস, আর সক্রিয় ভাবে তার বিরোধিতা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আরএসএস-হিন্দু মহাসভা সক্রিয় ভাবেই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন বুঝে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসাবে যখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের ঘোষিত লাইনের বাইরে গিয়েও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ডাক দিচ্ছেন এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা বলছেন, কংগ্রেস থেকে গান্ধীবাদীদের দ্বারা বহিষ্কৃত হয়েও বিদেশে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ব্রিটিশের বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে সামিল হচ্ছেন, তখন যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি দেশবাসীর় দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সেই প্রসঙ্গে আরএসএসের শীর্ষনেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৪১ সালে ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে বলছেন, ‘‘ভারতের প্রতিরক্ষার কথা বলতে গেলে, ভারত সরকারের সমস্ত যুদ্ধ প্রস্তুতিকে হিন্দুদের অবশ্যই দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করতে হবে। … হিন্দুদের বৃহৎ সংখ্যায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে হবে” (সাভারকর সমগ্র, খণ্ড-৬, মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দুসভা, পুণা, ১৯৬৩, পৃঃ ৪৬০)। শাসক ব্রিটিশের নির্লজ্জ তাঁবেদারির কী প্রকৃষ্ট উদাহরণ!

যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তার সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য পূরণের জন্য যখন নতুন সশস্ত্র ব্যাটেলিয়ান তৈরির সিদ্ধান্ত নিল তখন সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা সিদ্ধান্ত নেয়, এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে একটা বড় সংখ্যক হিন্দু যুবকের নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। সেদিন হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সাহায্য করার জন্য দেশের নানা প্রান্তে সহায়ক কেন্দ্র খুলেছিল যাতে হিন্দু যুবকেরা সহজেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে। এই বাহিনীকেই ব্রিটিশ পাঠিয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দে্রর আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের হত্যা করতে। সাভারকর সেই কাজে ব্রিটিশদের পাশে ছিলেন। শাসক ব্রিটিশের কি নির্লজ্জ গোলামি! ব্রিটিশ-গোলামির এরকম আরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ভারতবাসীর লজ্জা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে এই আরএসএসের অনুগত সেবক বলতে গর্ববোধ করেন!

প্রধানমন্ত্রীর দল বিজেপি কিংবা আরএসএসের লক্ষ্য যে হিন্দু রাষ্ট্র তা আজ আর তারা গোপন করে না। সেই রাষ্টে্র মুসলমানরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকারগুলি হারিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে থাকবে। এই হীন সাম্প্রদায়িক চিন্তা সেদিনও একই রকম ভাবে লালন করত হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস। তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নেতাজি সেদিন বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা।” প্রধানমন্ত্রী কি নেতাজির এই বক্তব্য পড়ে দেখেছেন কখনও? সেদিন এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির শক্তিবৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন হয়ে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের থেকে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে।” এদের সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোক ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করিয়া বেড়াইতেছে– স্বাধীনতা সংগ্রামে এই শ্রেণির লোককেও শত্রু মধ্যে গণ্য করা প্রয়োজন।” এই আরএসএসকে নেতাজি ব্রিটিশের মতোই দেশের শত্রু বলে গণ্য করতেন। আজ কেউ যদি এদের দেশের মানুষের বন্ধু মনে করে, আর অন্য দিকে নেতাজির প্রশস্তি গায়, তা হলে তাদের ডাহা মতলববাজ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!

সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল দেশকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত করে একটি শোষণহীন, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা। সুভাষচন্দ্র রাজনীতিকে সব সময় ধর্মীয় চিন্তা থেকে দূরে রাখার কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যাগুলি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনগণকে একই রকম ভাবে জর্জরিত করছে। এর মোকাবিলাও করতে হবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে। সুভাষচন্দে্রর আজাদহিন্দ বাহিনী হিন্দু-মুসলমান মিলনের এক অপূর্ব নিদর্শন। বাহিনীর অন্যতম প্রধান ছিলেন একজন মুসলমান। বিপরীতে ধর্মীয় বিভেদকে উস্কানি দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরিই বিজেপির রাজনীতির মূল কথা। সাম্প্রদায়িকতাই তাদের মূলধন। নেতাজির চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার একদিকে শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের দেশের মানুষের উপর তীব্র শোষণ চালিয়ে যেতে দিচ্ছে, অন্য দিকে দেশের সমস্ত সম্পদ লুঠতরাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যাতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য মানুষকে মাতিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে। অর্থাৎ, কোনও দিক থেকেই বিজেপির সঙ্গে নেতাজির চিন্তার কোনও মিল নেই। বরং উভয়ের চিন্তা পরস্পরের বিপরীত। তবে প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বললেন কেন? প্রধানমন্ত্রী কি তাঁর দলের এবং নিজের এই অতীত কার্যলাপকে ভুল বলে স্বীকার করেছেন? স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশকে সহযোগিতার জন্য কি তিনি এবং তাঁর দল দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন? না, চাননি। অর্থাৎ তিনি নেতাজির পথেই চলছেন, এ কথা বলার দ্বারা প্রধানমন্ত্রী বাস্তবে চরম মিথ্যাচার করলেন এবং একই সাথে গোটা দেশবাসীর সাথে আবার একবার প্রতারণা করলেন। কিন্তু কেন বারবার তাঁদের এমন প্রতারণার আশ্রয় নিতে হচ্ছে?

আসলে বিজেপি নেতারা ভালভাবেই জানেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের দেশদ্রোহী ভূমিকার জন্য জনমনে তাঁরা নিন্দিত। তাছাড়া তাঁদের দলের এমন কেউ নেতা নেই যাঁকে তাঁরা আদর্শ নেতা হিসাবে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে কংগ্রেসের এক দক্ষিণপন্থী নেতা, যিনি ছিলেন সুভাষচন্দ্রের চরম বিরোধী এবং যিনি গান্ধীহত্যার পর আরএসএসকে দেশজোড়া গণরোষের হাতে থেকে নানা কৌশলে রক্ষা করেছিলেন, তাঁর বিশাল মূর্তি স্থাপন করে তাঁকেই তো পুজো করছেন নরেন্দ্র মোদিরা। তেমনই তাঁরা জানেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন নেতা হিসাবে জনমানসে আজও শ্রদ্ধার সবচেয়ে বড় আসনটি রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্রেরই। তাই তাঁদের লক্ষ্য, প্রকৃত ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে এক বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই কর্মসূচিরই অঙ্গ নিজেকে ও নিজেদের নেতাজি অনুসারী হিসাবে দেশের মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। তারই অঙ্গ সাড়ম্বর সরকারি অনুষ্ঠান, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ভণ্ডামি।

শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নামে এ যেমন গোটা দেশবাসীর সাথে প্রতারণা, তেমনই নেতাজির প্রতিও চরম অবমাননা। আজ যদি নেতাজির প্রতি সরাসরি কেউ অসম্মান প্রদর্শন করত, দেশের মানুষ কি মেনে নিত? তা হলে এই যে, শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থে, ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে, মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য নেতাজিকে ব্যবহার করা, নেতাজির আদর্শ, জীবন-সংগ্রাম, তাঁর লক্ষ্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধু তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা, এটাও কি নেতাজির প্রতি চরম অসম্মান নয়? এটা কি দেশের মানুষ নীরবে মেনে নেবে? এটা মেনে নিয়ে আমরা কি কেউ নেতাজিকে সম্মান জানাতে পারব? জানালে তা কি যথার্থ সম্মান জানানো হবে?

নেতাজির প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো যেতে পারে একমাত্র তাঁর অপূরিত স্বপ্নকে সফল করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়ে। সেই স্বপ্ন ছিল এমন একটি স্বাধীন ভারত গড়ে তোলা যেখানে শোষণ থাকবে না, নিপীড়ন থাকবে না, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ থাকবে না, বেকারি-অনাহার থাকবে না। সমস্ত মানুষের স্বাধীন বিকাশ ঘটবে। বিজেপির তথা নরেন্দ্র মোদি পরিচালিত কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের প্রতিটি কাজই নেতাজির এই আদর্শ ও লক্ষে্যর পুরোপুরি বিরোধী। তাই আজ নেতাজিকে শ্রদ্ধা জানানোর একটি অন্যতম শর্ত বিজেপির এই প্রতারণার রাজনীতিকে জনসমক্ষে উদঘাটিত করা এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।