প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চাই

আগামী শিক্ষাবর্ষেই

প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চাই

২১ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীকে ডেপুটেশন

এস ইউ সি আই (সি)–র দীর্ঘ আন্দোলনের জেরে গত বছর রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, পাশ–ফেল চালু করবেন৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও অনেক টালবাহানার পর পাশ–ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার অধিকার আইনে কিছু সংশোধনী আনে এবং লোকসভায় তা পাশও হয়৷ কিন্তু রাজ্যসভায় সেই সংশোধনী পাশ করানোর কোনও উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি৷ ফলে দুই সরকার পাশ–ফেল চালু করতে নীতিগতভাবে সম্মত হলেও চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলি ফেলে রেখেছে৷ এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (সি) আবারও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ ২১ ডিসেম্বর দলের পক্ষ থেকে সারা রাজ্যে দাবি দিবস পালন এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবিপত্র পেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে৷ একই দিনে ছাত্রসংগঠন এআইডিএসও এবং শিক্ষক–অধ্যাপক–বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির পক্ষ থেকে দিল্লিতে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ দেখানোর এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীকে ডেপুটেশন দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে৷

চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার পথপ্রদর্শক এ রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকার৷ পরে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের নামে নানা চটকদারি কথার আড়ালে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার ফরমান জারি করে৷ সেই নির্দেশিকা এ রাজ্যে কার্যকর করে তৃণমূল সরকার৷ অন্যান্য রাজ্যে কোথাও বিজেপি, কোথাও আঞ্চলিক দলগুলি তা কার্যকর করে৷ ন্যূনতম প্রতিবাদটুকুও তারা কেউ করেনি৷ একমাত্র এসইউসিআই(সি) এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে, গড়ে তুলেছে লাগাতার আন্দোলন৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে পাশ–ফেল ফেরানোর কথা নীতিগতভাবে ঘোষণা করাতে এস ইউ সি আই (সি)–কে বহু রক্ত ঝরাতে হয়েছে৷ আইন অমান্য, বিধানসভায় বিক্ষোভ, বাংলা বনধ ডাকা থেকে শুরু করে দিল্লিতে সংসদ অভিযান, রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলন– সবই করতে হয়েছে৷ পুলিশি অত্যাচারে দুই কর্মীর চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলছে৷ পাশ–ফেল চালুর দাবিতে এস ইউ সি আই (সি)–র যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য, ধারাবাহিক আন্দোলন জনগণের মধ্যে প্রবল সমর্থন তৈরি করে৷ অন্য দিকে বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্টের মধ্য দিয়ে শিক্ষার অবনমনের ভয়াবহ চিত্র সামনে আসতে থাকে৷ পাশাপাশি সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়া, বহু স্কুল উঠে যাওয়া এবং বেসরকারি সুক্লের সংখ্যাবৃদ্ধি ও তাতে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সরকারি শিক্ষানীতির কুফল পরিষ্কার হয়ে যায়৷ এই অবস্থায় জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে সরকার পাশ–ফেল ফেরানোর কথা ভাবতে শুরু করে৷

এস ইউ সি আই (সি)–র দাবি, প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল ফেরাতে হবে৷ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা পাশ–ফেল ফিরবে কেবল পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে৷ রাজ্য সরকারের বক্তব্যও তাই৷ কিন্তু শুধু পঞ্চম ও অষ্টমে কেন? পাশ–ফেল না থাকার ক্ষতি কি শুধু এই দুটি ক্লাসেই হচ্ছে? প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল না থাকায় পঠন–পাঠনের ক্ষেত্রে যে অনীহা তৈরি হয়েছে তা কি পূরণ হতে পারে মাত্র দুটো ক্লাসে ফেরানোর দ্বারা? পাশ–ফেলের প্রয়োজনীয়তা দেশের মানুষ বুঝলেও বোঝেন না শুধু মন্ত্রীরা৷ তবুও দুটো ক্লাসে ফেরানোর যে বোধোদয় হয়েছে সরকারের এবং তা ঘোষিতও হয়েছে, এটা গণআন্দোলনের বিরাট জয়৷ একই সাথে সরকারের নীতিগত পরাজয়৷ পরাজয় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই৷

পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার যে অজুহাতই সরকার দিক, সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার বেসরকারিকরণের জমি তৈরি করে দেওয়া এবং দুই শ্রেণির নাগরিক তৈরি করা– একদল ধনী যারা বেসরকারি সুক্লে প্রচুর টাকা দিয়ে সন্তানদের পড়াতে পারবে, উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পাবে এবং শেষ পর্যন্ত সঙ্কুচিত চাকরির সবটাই পাবে৷ অন্য দিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আর্থিক সঙ্গতির অভাবে সরকারি সুক্লেই যাবে এবং নিম্নমানের শিক্ষা নিয়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে৷ ধনীদের সুবিধা করে দেওয়া এবং গরিবদের সাধারণ মানের শিক্ষায় আটকে রাখাই ছিল এর প্রকৃত উদ্দেশ্য৷ পাশ–ফেল অবলুপ্তির ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা এ কথাই বলছে৷ আজও নানা অছিলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পাশফেল চালুকে আটকে রাখছে৷

সরকারগুলি পাশ–ফেলের বিপক্ষে থাকলেও সাধারণ মানুষ চায় তা এখনই চালু হোক এবং হোক প্রথম শ্রেণি থেকেই৷ দল মত নির্বিশেষে শিক্ষার স্বার্থে সাধারণ মানুষ পাশ–ফেলের প্রশ্নে এককাট্টা বলেই এস ইউ সি আই (সি)–র পক্ষে সম্ভব হয়েছে এতবড় একটা রাষ্ট্রশক্তির ভুল নীতি পরাস্ত করার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সরকারকে নীতিগত ভাবে তা মানতে বাধ্য করতে৷

আজ প্রয়োজন আন্দোলনকে আবার শাণিত করা৷ পাশ–ফেল চালুর প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির এই যে পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তা, প্রয়োজন তাকে ভাঙা৷ সেই লক্ষ্যেই এস ইউ সি আই (সি) আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ আহ্বান জানিয়েছে সকলকে সামিল হওয়ার৷ সন্তানদের ভবিষ্যৎ আর নষ্ট হতে দেওয়া চলে না৷

 

তথ্যের আলোকে পাশ–ফেল

  • ২৩ মে ২০১৭, কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের স্কুল শিক্ষা সচিব অনিল স্বরূপ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘‘অধিকাংশ রাজ্যই (২৫টি) শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই পাশ–ফেল চালুর পক্ষে সওয়াল করেছে৷ তবে কোন ক্লাস থেকে চালু করা হবে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে’’ (এই সময় ২৪.০৫.২০১৭)
  • সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড অব এডুকেশন (সিএবিএ) তার ৬৪ তম মিটিং–এ পাশ–ফেল পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কেন্দ্রের পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্টও বলছে, সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ৫৩.২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়তে পারে না বা ওই ক্লাসের ৪৬.৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী দুই অঙ্কের যোগ–বিয়োগ করতে পারে না বা ৭৫ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী করতে পারে না গুণ অঙ্ক৷ এর কারণ ঢালাও পাশের নীতি৷
  • কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৬–র খসড়া তৈরি করেছে তাতে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের বক্তব্যেও স্বীকার করা হয়েছে অবাধ প্রমোশন নীতি (পাশ–ফেল প্রথা না থাকা) ছাত্রছাত্রীদের ‘অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স’কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ এর পরেও সরকার সব ক্লাসে পাশ–ফেল চালু করবে না কেন?

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ১৯ সংখ্যা)