কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের ঘোষণা অনুযায়ী এবারের বাদল অধিবেশনেই পাশ–ফেল ফেরানোর জন্য শিক্ষা আইনের সংশোধনী সংসদে পেশ হওয়ার কথা৷ এই সংশোধনী পেশ হলে তার অর্থ হবে, পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার নীতি যে ভুল ছিল, সরকারের তরফে তা মেনে নেওয়া৷ কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিলম্বিত ‘বোধোদয়’ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেনি, ঘটেছে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে৷
২০০৯ সালে শিক্ষা অধিকার আইনের নামে কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেয়৷ পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার পাল্টালেও প্রত্যেকেই এই জনবিরোধী নীতি বহাল রাখে৷
পাশ–ফেল বিসর্জন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে আমরা এর অনিবার্য পরিণামের দিকগুলি বার বার তুলে ধরেছি৷ আজ এর প্রতিটি সত্যে পরিণত৷ বিগত কয়েক বছর সরকার নিযুক্ত নানা কমিটি বা কমিশনও তাদের রিপোর্টে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে, পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার ফলেই সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুলগুলিতে শিক্ষার মানে চূড়ান্ত ধস নেমেছে৷ স্কুলে স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হতে চলেছে৷ সর্বশিক্ষা মিশন তাদের রিপোর্টে বলছে অভিভাবকরা সরকারি স্কুলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন৷ এই ধরনের অসংখ্য স্কুল যখন ছাত্রের অভাবে হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, না হয় বন্ধ হতে বসেছে তখন দেশের সর্বত্র বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীরা বার বার পাশ–ফেল ফেরানোর আবেদন জানিয়েছেন৷ কিন্তু কোনও কিছুই সরকারগুলি কানে তোলেনি৷ আমাদের রাজ্যে দীর্ঘ৩৮ বছর এবং গোটা দেশে ৯ বছর এই সর্বনাশা নীতির ফলে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস হতে দেখেও জনদরদের স্বঘোষিত চ্যাম্পিয়ানদের বুক কাঁপেনি৷
২০১৫–র শেষভাগে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি প্রকাশ্যে জানান, তাঁরা পাশ–ফেল ফেরাতে চান এবং এর জন্য তাঁরা শিক্ষা আইন সংশোধন করবেন৷ এই ঘোষণার পর প্রায় আড়াই বছর পার হয়ে গিয়েছে৷ স্মৃতি ইরানির পর যিনি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী হয়েছেন, তিনিও মাঝে একাধিকবার একই কথা শুনিয়েছেন৷ কিন্তু এর মধ্যে শিক্ষা আইনের সংশোধনী সংসদে পেশ করার সময় ও সুযোগ তারা করে উঠতে পারেনি৷ এই হল তাদের শিক্ষা দরদের নমুনা৷
রাজ্যের ক্ষেত্রেও তৃণমূল সরকারের একই টালবাহানা৷ গত বছর ১৭ জুলাই প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেলের দাবিতে এসইউসিআই (সি)–র ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন লক্ষ করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এসইউসিআই(সি)–র রাজ্য সম্পাদককে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁরাও পাশ–ফেল চান এবং তা চালু করার উদ্যোগ তাঁরা নেবেন৷ বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের মতামত নেওয়া হয়৷ সিপিএম ছাড়া সকলেই প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর মত দেয়৷ কিন্তু তার পর এক বছর পার হয়ে গেলেও বিধানসভায় এ বিষয়ে একটি ঘোষণা এবং পরে একটি বৈঠক ছাড়া আর কিছুই রাজ্য সরকার করেনি৷ এদিকে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই চলেছে৷ জনস্বার্থের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা থাকলে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে এ আচরণ কোনও সরকার করতে পারে কি?
দেশের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা ও ভবিষ্যৎকে রক্ষার স্বার্থে এই টালবাহানা এবং কালক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার৷ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, তাঁরা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে দু’টি পরীক্ষা চালু করবেন৷ সেখানে ছাত্রছাত্রীরা কাঙিক্ষত মান অর্জনে ব্যর্থ হলে তাদের সেই ক্লাসে রেখে দেওয়া হবে৷ কিন্তু এতে অবস্থার বিশেষ হেরফের হবে কি? পাশ–ফেল বিহীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাটাই যেখানে প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে, মাত্র দু’টি ক্লাসে পাশ–ফেল ফিরিয়ে এনে তার সমাধান সম্ভব কি? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, কোন ক্লাস থেকে পাশ–ফেল চালু হবে, রাজ্য সরকার চাইলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ ইতিপূর্বে খবরে প্রকাশ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নাকি তৃতীয় শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফেরানোর কথা ভাবছেন৷ তাঁর কাছে প্রশ্ন, যদি ফেরাতেই হয় তবে প্রথম শ্রেণি থেকেই নয় কেন? তা ছাড়া শিক্ষা তো যুগ্ম তালিকাভুক্ত৷ তবে কেন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা সাধারণ পরিবারের অগণিত ছাত্রছাত্রীর এতবড় ক্ষতি হতে দিচ্ছেন কেন?
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)