২১ ডিসেম্বর ডিএসও–র পার্লামেন্ট অভিযান
প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালুর দাবিতে এআই ডিএসও–র সর্বভারতীয় কমিটি ২১ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দিয়েছে৷ দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার পাশ–ফেল চালুর ঘোষণা করেছে৷ এটা গণআন্দোলনের এক বিরাট জয়৷ কিন্তু কোন শ্রেণি থেকে? পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশের জনসাধারণের দাবি– প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালু করতে হবে৷ লাগাতার গণআন্দোলন সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন এই দাবির প্রতি কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকারই গুরুত্ব দেয়নি৷ সারা দেশে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ছাড়া আর কোনও দল এই দাবি তোলেনি শুধু নয়, অন্য প্রায় সব দলই এই দাবির বিরোধিতা করেছে৷ রাজ্যে রাজ্যে যে দল যেখানে ক্ষমতায় আছে তারা সবাই কেন্দ্রীয় আইনের দোহাই দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দিয়েছে৷
পাশ–ফেল চালুর দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত৷ তাঁরা বুঝেছিলেন তাঁদের ঘরের সন্তান–সন্ততিদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সর্বনাশা নীতির বিরোধিতা করা দরকার৷ লাগাতার আন্দোলনে বারবার পুলিশি আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন এস ইউ সি আই (সি) কর্মীরা, দু’জন কর্মীর চোখ নষ্ট হয়েছে, আহত হয়েছেন বহু কর্মী৷ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে৷ গণআন্দোলন এবং জনমতের প্রবল চাপেই সরকার বাধ্য হয়েছে পাশ–ফেল চালুর পক্ষে মত দিতে৷ কেন্দ্রীয় সরকার আইন পরিবর্তন করছে, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় ঘোষণা করেছেন, পাশ–ফেল চালু হবে৷ এর দ্বারা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার সত্যতা আবারও প্রমাণিত হল– নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু সরকারের পরিবর্তন হয়, নীতির পরিবর্তন হয় না৷ নীতির পরিবর্তন হয় গণআন্দোলনের চাপে৷ পাশ–ফেল চালুর দাবিতে আন্দোলনের জয় দেখিয়ে দিল, সঠিক নেতৃত্বে না্যয়সঙ্গত দাবিতে লাগাতার গণআন্দোলনই পারে জনসাধারণের দাবি আদায় করতে৷
জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ৷ রাজ্যের সমস্ত স্তরের মানুষ অধীর আগ্রহে দিন গুনছেন, সরকার কবে পাশ–ফেল চালুর বিজ্ঞপ্তি জারি করবে৷ কিন্তু কবে হবে? কোন শ্রেণি থেকে হবে? শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তা ঠিক করার মালিক মুখ্যমন্ত্রী৷ এদিকে ডিসেম্বর শেষ হতে চলল৷ প্রচলিত জনশ্রুতি, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন অতি দ্রুত, এমনকী কোনও ঘটনায় প্রশাসনিক তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তাঁর ব্যক্তিগত অন্তর্তদন্তে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন মুহূর্তের মধ্যে৷ বাংলার জনগণ ভেবেই পাচ্ছেন না, পাশ–ফেল চালুর ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী এত সময় নিচ্ছেন কেন?
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে পূর্বতন সিপিএম সরকার প্রাইমারিতে ইংরেজি ও পাশ–ফেল প্রথা তুলে দিয়েছিল৷ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা সহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ভিত ধসিয়ে দেওয়ার পক্ষে এই একটা সিদ্ধান্তই ছিল যথেষ্ট৷ সেদিনের সরকারি নেতাদের ‘বাণী’ আজও মানুষ ভোলেনি৷ তাঁরা বলেছিলেন, চাষির ঘরের ছেলে, গরিব ঘরের ছেলে আবার ইংরেজি শিখবে কি এই বক্তব্যকে ধিক্কার জানিয়েছিল বাংলার মানুষ৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর নেতৃত্বে জনসাধারণের দীর্ঘ ১৯ বছরের লাগাতার আন্দোলনে সিপিএম সরকার ইংরেজি চালু করতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু পাশ–ফেল তারা চালু করেনি৷
সিপিএম বিরোধিতাকে পাখির চোখ করে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখল, মানুষ আশা করেছিল ক্ষমতার পরিবর্তন হলে সিপিএমের সর্বনাশা শিক্ষানীতির পরিবর্তন হবে, পাশ–ফেল চালু হবে৷ কিন্তু গরিব মানুষ ভোটার হিসাবে এক–একটা সংখ্যা মাত্র, সরকারি দলগুলোর কাছে তাদের ইচ্ছে–নিচ্ছে, আশা–আকাঙ্ক্ষার কোনও দাম নেই৷ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল চালু তো হলই না, উল্টে কেন্দ্রীয় আইনের দোহাই দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিল তৃণমূল সরকার৷ ভাবখানা এমন যেন, পশ্চিমবাংলার সরকার কেন্দ্রের একান্ত অনুগত ও বশংবদ৷
আমরা দেখেছি, তিস্তা চুক্তি মানি না, নোট বাতিল মানি না, জিএসটি মানি না, যে সরকার বলতে পারল, তারাই বলছে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার আইন কেন্দ্রীয়– মানতে তো হবেই ভাই৷ শিক্ষা কেন্দ্র–রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত৷ রাজ্য সরকার চাইলে পাশ–ফেল তুলে না দিয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে চালু করতেই পারত৷ এই আচরণ জনসাধারণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কী
মানুষ আবার পাশ–ফেল চালুর দাবিতে ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকল এস ইউ সি আই (সি)–এর আহ্বানে৷ বহু মিছিল–মিটিং–ধরনা– অবরোধ পার করে গত ১৭ জুলাই সারা বাংলা সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বানে মানুষ সাড়া দিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে৷ সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সরকারের কোনও স্তরের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না৷ পাশ–ফেল চালুর ব্যাপারে সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের দীর্ঘ মৌনতায় মানুষ অবাক হল, ক্ষুব্ধ হল, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল ‘১৭ জুলাই ধর্মঘট হবে’৷ বিরাট চাপে পড়ে গেল সরকার৷ অবশেষে দীর্ঘ মৌনব্রত ভঙ্গ করে শিক্ষামন্ত্রী লিখিতভাবে জানালেন, পাশ–ফেল চালু হবে৷ গণআন্দোলনের জয়ে উচ্ছ্বসিত সাধারণ মানুষ নতুন শিক্ষাবর্ষের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে রইলেন৷ আগামী জানুয়ারিতেই সেই প্রতীক্ষিত নতুন শিক্ষাবর্ষ, যে শিক্ষাবর্ষে পাশ–ফেল চালু করতে হবে এবং তা প্রথম শ্রেণি থেকেই করতে হবে৷ জনমতের মূল্য দিয়ে সরকার ২২ ডিসেম্বরের মিটিং–এ প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ঘোষণা করুক – রাজ্যবাসীর এটাই দাবি৷