
আমেরিকা কি তা হলে ভয় পেল ইরানকে? ইরানের পাল্টা আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা ইজরায়েল কি হারিয়ে ফেলছিল? শেষ হয়ে আসছিল তার অস্ত্রের ভাণ্ডার? না হলে হঠাৎ আমেরিকাকে আসরে নামতে হল কেন?
সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব-জনমতকে দু’পায়ে মাড়িয়ে শেষপর্যন্ত ইরানের উপর সরাসরি হামলা চালাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২২ জুন ভোরে ইরানের ফোর্দো, নাতান্জ ও ইস্পাহানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে শক্তিশালী বাঙ্কার বাস্টার বোমা বর্ষণ করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের শিরোমণি, গোটা পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে চরম ধিক্কৃত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন– ‘এইবার শান্তির সময় এসেছে’। পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখ ইজরায়েলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরাসরি ইরানে হামলা চালিয়ে রক্তস্নাত ওই এলাকায় নতুন করে বিপর্যয় সৃষ্টিই শুধু নয়, গোটা বিশ্বকেই এবার যুদ্ধের হুমকির সামনে ঠেলে দিয়ে শান্তির বাণী– চমৎকার বৈ কী!

প্যালেস্টাইনের গাজায় নারী-শিশু সহ নিরপরাধ আরব বাসিন্দাদের নিকেশ করার পৈশাচিক কর্মসূচি চালাতে চালাতেই বিনা প্ররোচনায় গত ১৩ জুন থেকে আচমকা ইরানে হামলা শুরু করে ইজরায়েল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অভিযোগ– ইরানের পরমাণু অস্ত্রের সামনে ইজরায়েলের অস্তিত্ব বিপন্ন। ইজরায়েল বলেছে, আণবিক অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তি এনপিটি-তে স্বাক্ষরকারী ইরান সেই চুক্তি লংঘন করেছে। অথচ খোদ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের ১২ জুনের রিপোর্টে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়ার কথা নেই। আমেরিকার গোয়েন্দা অধিকর্তা তুলসী গ্যাবার্ড স্বয়ং মার্কিন কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে গত মার্চে জানিয়েছিলেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। যদিও সর্বসমক্ষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ধমকের মুখে এখন সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছেন তিনি। তা ছাড়া ইজরায়েল নিজেই পরমাণু শক্তিধর দেশ। তার ভাণ্ডারে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সার্বিক সমর্থনপুষ্ট গণহত্যাকারী এই রাষ্ট্রটি এনপিটি-তে সই করেনি এবং আইএইএ-র পরিদর্শকদের দেশের ভিতরে সে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় না। এর আগে ২০১৫ সালে আমেরিকা, কয়েকটি পশ্চিমী দেশ, চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত চুক্তি হয়। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরই প্রথম সরকার সেই চুক্তি থেকে সরে যায়। সম্প্রতি আবার পরমাণু শক্তি নিয়ে আমেরিকা-ইরান আলোচনা শুরু হয়েছিল। বৈঠকের পরবর্তী তারিখের ঠিক দু”দিন আগে ইজরায়েল ইরানে হামলা শুরু করে দেয়।
পিছনে অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার সহ সর্বশক্তি নিয়ে আমেরিকা দাঁড়িয়ে আছে, এই ভরসায় কার্যত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসাবেই ইজরায়েল এবার ইরান আক্রমণ করে। ১৩ জুন ইরানের আণবিক কেন্দ্রগুলিতে ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে। বেছে বেছে হত্যা করা হয় ইরানের বেশ কয়েকজন সামরিক আধিকারিক ও পরমাণু-বিজ্ঞানীকে। যদিও গুপ্তচর লাগিয়ে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের যেভাবে একের পর এক খুন করছে মার্কিন-ইজরায়েল জোট, তাকে যুদ্ধ না বলে জঘন্য ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি বলাই ভাল। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আক্রমণ শুরু করে ইরান। ইজরায়েলের বহু-প্রচারিত ও প্রশংসিত ‘আয়রন ডোম’ এবং ‘থাড’-এর প্রতিরোধ ব্যর্থ করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হানায় রাজধানী তেল আভিভ, হাইফা সহ বেশ কয়েকটি শহরের বিপুল ক্ষতি হয়। বেশ কিছু প্রাণহানি ঘটে। বাসিন্দাদের বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়। ইজরায়েলের কাছে ইরানের এই প্রত্যাঘাত অপ্রত্যাশিত ছিল। যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সামনে পড়ে ইজরায়েল আমেরিকার কাছে ইরান আক্রমণ করার আবেদন জানাতে থাকে। রাশিয়া ও চিন আমেরিকাকে এই যুদ্ধে না জড়ানোর হুঁশিয়ারি আগেই দিয়ে রেখেছে। পাশাপাশি দেশের বাইরে কোনও সংঘর্ষে আমেরিকা জড়াবে না– প্রেসিডেন্ট পদে বসার আগে দেশের মানুষের কাছে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প। মার্কিন কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সদস্য যাঁরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও আমেরিকার ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষে সরাসরি যোগ দেওয়ার বিরোধিতা করেন। সব মিলিয়ে ইজরায়েলের ইরান আক্রমণকে শুরুতেই ‘চমৎকার হয়েছে’ বলে অভিনন্দন জানালেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি ইরান আক্রমণের ব্যাপারে খানিকটা দোদুল্যমান ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে ইরানে প্রত্যক্ষ হামলা চালাল আমেরিকা।
কেন হঠাৎ ইরানকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিল আমেরিকা ও ইজরায়েল? আসলে দীর্ঘ দিন ধরেই এর প্রস্তুতি চলছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে জায়নবাদী ইজরায়েল দীর্ঘ দিন ধরেই প্যালেস্টাইনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার লক্ষ্য, পশ্চিম এশিয়ায় একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েম করা। এই কাজে এই অঞ্চলের আর এক সাম্রাজ্যবাদী দেশ ইজরায়েল তার প্রধান স্যাঙাৎ। প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে শরিক যে ‘হামাস’, ‘হেজবুল্লাহ’-র মতো বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগ্রামী গোষ্ঠী, তাদের পিছনে লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরানের মতো দেশগুলির সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে। দীর্ঘ সংঘাতের পর ইতিমধ্যে লেবাননের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর নেতা নাসারাল্লাকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা, ফ্রান্স, তুরস্কের সহযোগিতায় নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের সিরিয়ায় প্রবেশ করিয়ে, তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে সেখানকার বাসার আল আসাদ সরকারকে হঠানোর ষড়যন্ত্রও সফল করেছে মার্কিন-ইজরায়েল চক্র। এখন সেখানকার নতুন রাষ্ট্রপতি প্রাক্তন আল কায়েদা নেতা আহমেদ হুসেন আল শারা ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সিরিয়া ঢুকে পড়েছে আমেরিকা-ইজরায়েল সাম্রাজ্যবাদী চক্রে। এই অবস্থায় একমাত্র ইরানকে কব্জা করতে পারলেই পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকা ও ইজরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অনেকটাই নিষ্কণ্টক হয়।
আয়তনে পশ্চিম এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ইরান এই অঞ্চলের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র। এর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমানা লাগোয়া কাস্পিয়ান সাগর, পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীর কারণে জলপথে বাণিজ্যে সুবিধার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। পশ্চিম এশিয়ায় একাধিপত্য কায়েমের ক্ষেত্রে এ হেন ইরান স্বাভাবিক ভাবেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইজরায়েলের পথের কাঁটা। সেই কারণেই ইরানকে আক্রমণের লক্ষ্য বানিয়েছে ইজরায়েল তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
ইরানে ইজরায়েলের হামলার পিছনে আরও একটি কারণও গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অবস্থান বিশেষ সুবিধাজনক নয়। ২০২৩ সাল থেকে গাজায় লাগাতার গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত হামাসের হাতে পণবন্দিদের সকলকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়নি নেতানিয়াহু সরকার। ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ গাজায় হত্যালীলার বিরুদ্ধে বার বার পথে নামছেন। সে দেশের সংসদের বেশ কয়েকজন সদস্য নেতানিয়াহু সরকারের পদত্যাগ ও অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। এতে ঘোরতর আপত্তি নেতানিয়াহুর। আগে থেকেই নানা দুর্নীতি সহ বেশ কিছু অভিযোগে অভিযুক্ত থাকায় তিনি জানেন, ভোটে হেরে গেলে তাঁর জায়গা হতে পারে জেলখানায়। তাই যে ভাবেই হোক দেশে যুদ্ধজনিত জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন স্থগিত রাখতে মরিয়া নেতানিয়াহু। বছরের পর বছর হামলা চালিয়েও প্যালেস্টাইন মুঠোয় না আসায় এ বার় দেশের সামনে ইরানকে তাই নতুন বিপদ হিসাবে খাড়া করেছেন তিনি। তাঁর আরও লক্ষ্য, আমেরিকাকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়া যাতে পশ্চিম এশিয়ার পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। অন্য দিকে অর্থনীতির বেহাল দশা সামাল দিতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার অন্যতম প্রয়োজনীয় হাতিয়ার যুদ্ধ। তা ছাড়া মার্কিন যুদ্ধজোট নেটোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ, চিন-রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদীদের কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে ক্রমাগত পৌঁছে যাওয়া রুখতে মার্কিন শাসকদের পশ্চিম এশিয়ায় কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখা প্রয়োজন। এ জন্য ইরানকে বাগে আনা তার জরুরি দরকার। তাই ইজরায়েলের সঙ্গে প্রথম থেকেই ইরান আক্রমণে শামিল না হলেও যুদ্ধের দশম দিনে হামলা শুরু করল আমেরিকা।
সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে ইরানের ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই বর্বর আক্রমণ পশ্চিম এশিয়ায় সংঘর্ষের মাত্রা আরও অনেকটা বাড়িয়ে তুলল। এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, পরিণাম হবে অত্যন্ত মারাত্মক। যুদ্ধরত দেশগুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব, সম্পত্তি ধ্বংস ও গৃহহীনতার সমস্যাই শুধু নয়, জলপথে বিশ্বের বহু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি দুনিয়া জুড়ে জ্বালানি তেলের সঙ্কট সৃষ্টি হয়ে সমস্ত পণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যা জনজীবনকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করবে।
এই অবস্থায় আমেরিকা, ইজরায়েল ও ইরান সহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের যুদ্ধবিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষকে ইরানের ওপর মার্কিন-ইজরায়েল সাম্রাজ্যবাদী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে। বিশ্ব জুড়ে সংগ্রামী শান্তি আন্দোলন গড়ে তুলে রক্তলোলুপ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করতে হবে। আশার কথা, আরব দেশগুলি ইরানে মার্কিন আক্রমণের বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা করেছে রাশিয়া, চিনও। এই অবস্থায় ভারতের জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা মনে রেখে ভারত সরকারের যেখানে উচিত ছিল ইরানে মার্কিন আক্রণের কড়া নিন্দা করা, তা না করে এই সরকারকে দেখ গেল ইরানকে উত্তেজনা প্রশমনের পরামর্শ দিতে! এ ঘটনা প্রত্যেক ভারতবাসীর পক্ষে লজ্জার। এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে ভারতীয় জনগণকে। আওয়াজ তুলতে হবে–‘মার্কিন-ইজরায়েল সাম্রাজ্যবাদী চক্র ইরান থেকে হাত ওঠাও।’
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত