বিশ্বে প্রতিরক্ষা খাতে খরচে সর্বকালের রেকর্ড গড়ল ভারত। সম্প্রতি স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউশন (এসআইপিআরআই)-এর রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ে ভারতের স্থান বিশ্বে তৃতীয়। প্রথম স্থানে আমেরিকা ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চিন। ব্যয়ের নিরিখে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রিটেন ও রাশিয়া। বিশ্বে প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ৬২ শতাংশ বহন করছে এই পাঁচটি দেশ।
২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা গবেষণা ও পরিকাঠামো খাতে আমেরিকার বাজেট বেড়েছে ২৪ শতাংশ। ২০২১ সালে মোট ব্যয় হয়েছে ৮০ হাজার ১০০ কোটি ডলার। চিন ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ৪.৭ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি করেছে। ২০২১ সালে চিনের ব্যয় ২৯ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। আবার চতুর্থ স্থানে থাকা ব্রিটেন ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে ৬ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার যা ২০২০ সালের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি। পঞ্চম স্থানে থাকা রাশিয়া ২০২০ সালের তুলনায় ২.৯ শতাংশ বেশি বরাদ্দ করেছে এবং ২০২১ সালে তাদের খরচ হয়েছে ৬ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার। ঠিক এই সময়ে রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ করতে শুরু করেছিল।
প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের নিরিখে তৃতীয় স্থানে থাকা ভারতের বরাদ্দ যথার্থই অবাক করার মতো। ২০২১ সালে ভারত ব্যয় করেছে ৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার যা ২০২০ সালের তুলনায় ০.৯ শতাংশ বেশি এবং ২০১২ সালের তুলনায় যা ৩৩ শতাংশ বেশি। প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ৬৪ শতাংশ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে অস্ত্র ও উপকরণ কিনতে ব্যয় করেছে ভারত সরকার। এসআইপিআরআই-এর রিপোর্ট দেখিয়েছে, চিন ও পাকিস্তান সীমান্তে মাঝে মাঝে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তাকে ভিত্তি করে ভারত নিজস্ব সৈন্যবাহিনীকে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছে এবং অস্ত্র উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে।
প্রতিটি দেশই কেন প্রতিরক্ষা খাতে এমন করে বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে? এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তো দেশের বেশির ভাগ জনগণকে তাদের ন্যনতম প্রয়োজনগুলি থেকেও বঞ্চিত করেই উসুল হয়। বিশ্বের ধনীতম দেশ আমেরিকারও বিরাট অংশের মানুষ কী ভাবে সভ্য সমাজের ন্যনতম প্রয়োজনগুলি থেকেও বঞ্চিত হয়ে চলেছে, করোনা অতিমারির আক্রমণ তা বিশ্বের সামনে বেআব্রু করে দেখিয়ে দিয়েছে। ভারতের সাধারণ মানুষের অবস্থাও কারও অজানা নয়। তা হলে কেন এ ভাবে ব্যয় করা হচ্ছে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ? বিশ্বজুড়ে দেশগুলির স্বাধীনতা কি বিপন্ন হয়ে পড়েছে? প্রতিটি দেশই কি অন্য দেশের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে? তাই যদি সত্যি হয় তবে এই আশঙ্কার শেষ কোথায়? এক দেশ অস্ত্রসজ্জা বাড়ালে তো সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশও তা বাড়াবে। তা হলে অস্ত্রসজ্জা বাড়িয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কী ভাবে কমতে পারে? আর সব দেশই যদি সত্যি সত্যি যুদ্ধের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে তবে তো সবাই মিলে যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগটাই যথার্থ হত। বিশ্বশান্তির যত বেশি গ্যারান্টি তৈরি করা যাবে ততই তো যুদ্ধের আশঙ্কা কমানো যাবে এবং প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনটাও আর থাকবে না।
আরও একটি বিষয় ভেবে দেখার মতো। তা হল ‘দেশের প্রতিরক্ষা’ কথাটির অর্থ কী? দেশ মানে কি দেশের মাটি পাহাড় পবর্ত নদী জঙ্গল? দেশের মানুষ নয়? দেশরক্ষা মানে তো সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে রক্ষা করা। কিন্তু এই সব দেশগুলির রাষ্ট্রনেতারা কি দেশরক্ষার মানে আদৌ তা মনে করেন? তা যদি করতেন তবে কি করোনা অতিমারিতে দেশের কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়ে যখন বিনা চিকিৎসায় ছটফট করছে, সামান্য অি’জেনটুকুর অভাবে হাঁসফাঁস করে মারা যাচ্ছে, ঠিক তখনই তাদের বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর থেকেও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোটা তাদের কাছে বেশি জরুরি মনে হত? গত আড়াই বছরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও লক্ষ লক্ষ মানুষ স্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছে। লক্ষ লক্ষ কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। বুভুক্ষু, কাজ হারানো অসংখ্য মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ যখন দেশের আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছে, যখন বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১-এ নেমে গেছে, তখনই বিপন্নতার ধুয়ো তুলে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে মরিয়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। মানুষ রক্ষা বাদ দিয়ে দেশরক্ষার কথাটা যথার্থ হতে পারে না।
আমেরিকা, চিন, ভারত, ব্রিটেন বা রাশিয়া প্রতিটিই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। আজ গোটা বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চরম সঙ্কটের সম্মুখীন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই অমোঘ সঙ্কটের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই দেশগুলির প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের আসল উদ্দেশ্য। সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সামনে আজ মূল সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে চূড়ান্ত বাজার সংকট, যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে মানুষের কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত তলানিতে নেমে যাওয়ার কারণে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মালিকরা উৎপাদন করে সর্বোচ্চ মুনাফার উদ্দেশ্যে। এই মুনাফা আসে শ্রমিককে তার ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে, অর্থাৎ শ্রমিকের শ্রমশক্তিকে শোষণ করে। যত বেশি শোষণ তত বেশি মুনাফা। ফলে অচিরেই মানুষ তার ক্রয়ক্ষমতা হারায়। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হয় না, তা গুদামজাত হয়ে পড়ে। এই ঘটনা আজ বিশ্বের প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশেই। ফলে সর্বত্রই সংকটের ছায়া। পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ মুনাফার লালসায় সমগ্র বিশ্বের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করতে করতে একেবারে শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। সঞ্চিত পুঁজি উৎপাদনে খরচ হতে না পেরে অলস হয়ে থাকছে। বাজারে মোট টাকার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় টাকার দাম পড়ে যাচ্ছে। আবার একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা জিনিসের দাম বাড়িয়ে তাদের মুনাফা অটুট রাখতে চাইছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা। মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আর্থিক বৃদ্ধির হার মন্থর–এই মন্তব্য করেছেন এসআইপিআরআই-এর এক গবেষক। আর এই সমস্যা থেকে বেরোনোর় জন্যই অর্থনীতির সামরিকীকরণ। কারণ, এ ক্ষেত্রে বাজারের তথা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয় না। সরকার নিজেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে অস্ত্র সহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরির বরাত দেয় এবং সরকার নিজেই তা কিনে নেয়। এর ফলে কৃত্রিম ভাবে হলেও অর্থনীতিতে সাময়িক একটা তেজিভাব আসে।
প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই প্রতিরক্ষা খাতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ২০০টি প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে কেনা যাবে না বলে সরকার ঘোষণা করেছে। দেখা যাচ্ছে বিগত কংগ্রেস সরকারের সময়ে ২০০১-২০১৪ আর্থিক বর্ষে যেখানে ২০০টি বেসরকারি সংস্থাকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল, গত সাত বছরে সেখানে ৩৫০টি সংস্থাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। গত দু বছরে দেশে তৈরি প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনার কাজে ৫৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘোষণার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল রানা প্রতাপ কলিতা কলকাতায় মার্চেন্ট চেম্বারের এক সভায় প্রতিরক্ষা বিভাগের ১২,৩০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম দেশীয় সংস্থাগুলির থেকে কেনার কথা জানিয়েছেন। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স এর জেনারেল ম্যানেজার এ লাহিড়ি জানিয়েছেন, তাঁরাও ৫০০০ কোটি টাকার সামরিক সরঞ্জাম কিনবেন বেসরকারি সংস্থার থেকে।
এই যে দেশের সরকার জনগণের দেওয়া করের টাকা থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরির বরাত দিয়ে চলেছে, এটিই অর্থনীতির সামরিকীকরণ। এর জন্যই প্রতি বছর বাড়ানো হচ্ছে সামরিক খাতে ব্যয়। আর এই ব্যয় বাড়ানোটাকে দেশের মানুষের কাছে যুক্তিসঙ্গত হিসাবে দেখানোর জন্যই থেকে থেকে পাকিস্তান এবং চিন সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। এর জন্যই বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধের হুমকি, যুদ্ধ জোট। এরই জন্য বিশ্বের জনমতকে অগ্রাহ্য করে রাশিয়া ইউক্রেন এর সাথে যুদ্ধ এবং আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের অস্ত্র ও অর্থের জোগান দিয়ে সেই যুদ্ধে মদত।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে কমরেড স্ট্যালিন বলেছিলেন, বিশ্বপুঁজিবাদের বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সমস্ত উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটাচ্ছে এবং এই পথে সে সঙ্কট এড়ানোর চেষ্টা করছে। এ দেশের বিশিষ্ট মা’র্বাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখালেন, পুঁজিবাদের এই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং ক্ষয়িষ্ণু যুগে শুধু উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিই নয়, তুলনামূলক অনগ্রসর দেশগুলির অর্থনীতিতেও সামরিকীকরণের ঝোঁক দেখা দিতে বাধ্য। পুঁজিবাদ যত দিন থাকবে, পুঁজির বিপদ, পর রাজ্য আগ্রাসনের বিপদ থাকবে। বাস্তবে শান্তি আন্দোলন অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে।