৪ সেপ্টেম্বর এর রাত। জুনিয়র ডাক্তারদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শহর, গ্রাম সামিল হয়েছে ‘বিচার পেতে আলোর পথে’ কর্মসূচিতে। আর জি কর-এর নির্যাতিতার ধর্ষক-খুনিদের শাস্তি চেয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি হাতে রাস্তায় নেমেছেন মানুষ, শহর-মফস্বলের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত, মানববন্ধন। সিঁথির মোড়ের এমনই একটি জমায়েতে উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিতে দিতে নাচের তালে শরীর দোলানোর মতো ভঙ্গি করছিলেন কয়েকজন, কিছুটা অজান্তেই। ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এসে মাইক হাতে নিলেন একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। বললেন, ‘একটা কথা বলি বন্ধু। তিলোত্তমার জন্য আমরা সোচ্চারে বিচার চাইব, শেষ পর্যন্ত লড়ব, রাজপথের দখল নেব। কিন্তু শরীর দুলবে না। মনে রাখবেন, এ আমাদের কঠিন প্রতিজ্ঞার লড়াই।’ একটু থেমে পাল্টে গেল ভঙ্গি, পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধা বললেন, ‘একদম ঠিক কথা বলেছ বাবা।’ হয়তো সামান্য ঘটনা, কিন্তু স্মরণীয় ঘটনা। মনে পড়ে যায়, ১৪ আগস্ট প্রথম রাত দখলের দিন প্রতিবাদী মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই কর্মসূচিতে সেলফি তুলে পোস্ট করবেন না কেউ, পরেও মূলত অব্যাহত থেকেছে সেই ধারা। ন্যায্য দাবিতে সংগঠিত লড়াই-আন্দোলন যেমন শাসককে মাথা নত করতে বাধ্য করে, তেমনই যে মানুষগুলো আন্দোলনের ময়দানে আসে, তাঁদেরও পাল্টেদেয়। মানুষ যখন আরও সহস্র মানুষের সাথে হকের দাবি জানায়, প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবনের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে অপরিচিত মানুষের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চায়, তখন সেই পরিবেশ তাঁকেও অনেকটা পাল্টে দেয়, বহু কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। আর জি কর-এর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা এই আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়।
বহুদিন পর এই শহর, রাজ্য দেখছে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ। দিনের পর দিন, প্রতিদিন পথে নামছেন মানুষ। নিজেরাই বিক্ষোভ-অবস্থান-প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন। খুঁজে নিচ্ছেন প্রতিবাদী মিছিল। পাড়ার মোডে, চায়ের দোকানে, স্কুল-কলেজে-অফিস-আদালতে একটাই প্রশ্ন, একটাই আলোচনা –‘তদন্ত কি এগোচ্ছে ঠিকপথে? বিচার মিলবে তো’? উত্তরও সাধারণ মানুষই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই। ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’। রাস্তা ছাড়লে, আন্দোলনের পথ থেকে সরে এলেই সরকার-পুলিশ-প্রশাসন আরও দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়বে অপরাধীদের আড়াল করতে। নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে হাজার ফন্দি-ফিকির-প্রলোভনে ভুলিয়ে দিতে চাইবে এই ঘটনার ভয়াবহতা। মানুষ তাই কোনওভাবেই ভুলছেন না, রাস্তা ছাড়ছেন না। প্রতিবাদের নানা নতুন মাধ্যম, সৃজনশীল স্লোগান-গান-কবিতা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনই মানুষ শিখছেন এবং স্পষ্ট করে বলছেন, এই বিপুল শোককে দ্রোহে রূপান্তরিত করার সময় কোন আচরণ করা চলে বা চলে না। বুদ্ধিজীবীদের একটি মিছিলে সামিল হওয়ার সময় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অপর্ণা সেনের উদ্দেশ্যে কুরুচিকর মন্তব্য করা হচ্ছিল পাশের একটি রাজনৈতিক দলের মঞ্চ থেকে। সাধারণ মানুষ তার নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। এই দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী গণআন্দোলন তীব্র, একমুখী অথচ প্রধানত সংযত এবং পরিশীলিত থেকেছে এই সচেতনতার কারণেই। ঘোলা জলে মাছ ধরে আখের গোছাবে ভেবেছিল যারা, সেই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোও সুবিধা করতে পারেনি। রাজ্যে রাজ্যে প্রবল অপশাসন, স্বৈরতন্ত্র এবং নারী নির্যাতনের কান্ডারী যারা, সেই বিজেপি’র স্বার্থসন্ধানী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন মানুষ। আর জি করের পাশাপাশি বারবার উঠে এসেছে উন্নাও, হাথরস, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের় নাম। আবার সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদককে তাঁদের সমাবেশে আসা এক মহিলাই প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনারা রাজনীতির দলাদলির কথা বলছেন কেন? বিচারের কথা বলুন।’ তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবি থেকে আন্দোলন যাতে এক চুলও না সরে, এ ভাবেই সজাগ থাকছেন মানুষ। অন্যদিকে একটি নামকরা সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে এসে আর জি করের এক আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তার যখন দুর্নীতি সহ বহু অভিযোগে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের সাসপেনশনের দাবি জানানোর সময়ও তাঁর নামের পরে ‘স্যার’ যুক্ত করেছেন, এই সৌজন্যবোধ শ্রদ্ধা আদায় করেছে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক-দর্শক শ্রোতাদের।
প্রতিবাদ-আন্দোলনের আবহে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠে আসছে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই। মূল্যবোধের প্রশ্ন, সংস্কৃতির প্রশ্ন। কেন চারিদিকে এত ধর্ষণ-হত্যা-বর্বরতা? শাস্তি দিয়ে একজন, পাঁচজন ধর্ষককে সরানো গেল, কিন্তু প্রতিদিন যে নতুন করে আরও ধর্ষক তৈরি হচ্ছে সমাজে, বাড়ছে অপরাধ, মানুষ অমানুষে পরিণত হচ্ছে, তার কী হবে? সচেতন মানুষটের পাচ্ছেন, আমাদের সময়, সমাজ, জীবনধারাকে গ্রাস করেছে এক চরম অন্তঃসারশূন্যতা, মূল্যবোধের সংকট। এক সময় আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আধার ছিল যে উন্নত রুচি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ, স্বাধীন ভারতে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির প্রায় কেউই সেই উন্নত সংস্কৃতির চর্চা করেনি, এমনকি ‘কমিউনিস্ট’ নামধারী বড় বড় দলগুলোও নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বড় চরিত্রগুলির সাথে যোগসূত্র রক্ষা করার চেষ্টা করেনি। এ দেশের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ এই ত্রুটি নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমরা ছিন্নমূল হয়ে পড়েছি।’ আজ তারই ভয়ানক মাশুল দিতে হচ্ছে এই সমাজ, সভ্যতাকে। তাই আর জি করের সুবিচার চাইতে গিয়ে উঠে আসছে প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনী, ক্ষুদিরামের নাম। মিছিলে প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে, ‘পুরুষ চাই তেমন, বিদ্যাসাগর ছিলেন যেমন।’ এইভাবে আন্দোলনের প্রবাহেই মানুষ খুঁজে নিচ্ছেন সেই স্মরণীয় উত্তরাধিকার, ফিরে চাইছেন হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ। এ পথেই সঠিক রাজনীতি, সংগ্রামী রাজনৈতিক দলকেও মানুষ চিনে নেবেন একদিন, গোটা দেশের তিলোত্তমাদের বাঁচাতে সামিল হবেন সমাজ পরিবর্তনের মিছিলে।