প্রতিবাদের এই উৎসব যেন না থামে

‘একমাস তো হল, একমাস একদিন … এবার পুজোয় ফিরুন, উৎসবে ফিরুন।’

৯ সেপ্টেম্বর রাজ্যবাসীর কাছে এই ভাষায় ‘অনুরোধ’ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় বা স্বরপ্রক্ষেপণে আন্দোলনরত জনগণের প্রতি অনুরোধের সুর যে বিন্দুমাত্রও ছিল না তা বলাই বাহুল্য। প্রশ্ন উঠেছে, মানুষের অন্তরের যন্ত্রণা ক্ষোভ রাগ প্রকাশের, প্রতিবাদের কি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যায়! মর্মস্পর্শী ঘটনায় উৎসবের আলো যখন ম্লান হয়ে পড়েছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর মানুষকে উৎসবে ফিরে আসার বার্তা দেওয়া কী ইঙ্গিত করে? তা যে কোনও প্রকারে প্রতিবাদ আন্দোলনের অভিমুখকে বিপথে চালিত করার অপচেষ্টা নয় কি? আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় কাণ্ডের বিচারের দাবি যাদের বুকে ধিকিধিকি আগুন হয়ে জ্বলছিল, মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘অনুরোধ’ সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে আর একবার। তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে গোটা বাংলা ও দেশের বিবেকবান মানুষ।

মানুষের মন ভাল নেই। শারদোৎসব এই বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব। মানুষ এই উৎসবের দিন গোনেন, উৎসবের জন্য নানা আয়োজন করেন। না, মানুষের মধ্যে সে আমেজ বা মেজাজ এখন নেই। মানুষ এখন বিচার চেয়ে মিছিলের আয়োজন করছেন অথবা মিছিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোনও আয়োজনে কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হচ্ছেন। তাঁরাই স্লোগান তুলছেন– ‘আমার বোনের শব মাড়িয়ে উৎসবে ফিরছি না।’ মানুষের অন্তরকে ঠিক কোন জায়গায় বিদ্ধ করেছে এ ঘটনা, তা অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দলের বহু কর্মীও তাঁর এই অসংবেদনশীলতায় বিস্মিত।

কিন্তু এমনটা হল কেন? কেন মানুষের বিচারের দাবিকে প্রশমিত করতে উৎসবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে? বরং বিপরীতটাই তো হওয়ার কথা ছিল। একটা সুষ্ঠু সামাজিক ব্যবস্থায় যদি কোনও অপরাধ ঘটে যায় তবে সেই ঘটনার সমস্ত দায়ভার সরকার, প্রশাসন গ্রহণ করবে এবং দ্রুত তার বিচারের জন্য তৎপর হয়ে উঠবে– এটাই তো স্বাভাবিক। কেন সাধারণ মানুষকে, চিকিৎসকদের মাসাধিক কাল ধরে রোদ-বৃষ্টিতে রাস্তায় থাকতে হবে? গলদটা এইখানে। ব্যবস্থাটা তো সুষ্ঠু পথে চলছে না। ঘুণপোকায় ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া এই ব্যবস্থাটাকে আসলে আড়াল করতে চাইছে সরকার। একটা ঘটনার কিনারা করতে গিয়ে আরও বহু অপরাধচক্র, দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা সামনে চলে আসবে– এ আশঙ্কা সরকারকেও আতঙ্কিত করে তুলেছে।

জনসাধারণও তা আঁচ করতে পারছেন। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি কারও কোনও কথা বা পদক্ষেপই আর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে না জনতার কাছে। সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলবে। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের কাছে যে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা, তাও বিচার পাওয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এই দাবিগুলি পূরিত না হওয়া পর্যন্ত আগুন নিভবে না, ক্ষোভ প্রশমিত হবে না। মানুষকে কোনও মতে উৎসবের ডামাডোলে ভিড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন– ‘মানুষের উৎসব কবে? … প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী– কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ সত্যিই আজ সেই উৎসবের দিন। মানুষ তার প্রতিদিনের ক্ষুদ্র দীন একাকী জীবন থেকে বেরিয়ে এসে দল-মত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্যত্বের শক্তির পরিচয় দিচ্ছেন পথে-ঘাটে। ব্যক্তিগত পরিসরের দুঃখ ব্যথার সীমানা পেরিয়ে সামাজিক দুঃখ-যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে আপন গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসছেন। পরিচিত অপরিচিত আরও বহু মানুষের হাত ধরে গড়ে নিচ্ছেন মহত্তর এক মানবশৃঙ্খল। সমস্ত অন্ধকারের মাঝে, মন খারাপের মাঝেও জনতার এই প্রতিবাদের উৎসব বড় সুন্দর। এটাই জনগণের অন্তরের উৎসব।

হয়তো প্রতিবাদী মানুষের প্রতিরোধের ধারায় সত্য একদিন উদঘাটিত হবে। তিলোত্তমা বিচার পাবে। তবে কল্লোলিত জনতার এই প্রতিস্পর্ধার আগুন যেন নিভে না যায়। এরই মধ্যে নিহিত আছে শতচ্ছিন্ন এই সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙে আগামীর নতুন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপ্ত সম্ভাবনা। তাই প্রতিবাদের এই উৎসব যেন কখনও না থামে।