এ দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩১ জন চাষি ঋণের দায়ে বা ফসলের ন্যূনতম দাম না পেয়ে আত্মঘাতী হন৷ এ বছর ৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ ২০১৬ সালের কৃষক আত্মহত্যার রিপোর্টটি প্রকাশ করে৷ কেন এই বিলম্ব? ক্রমাগত বাড়তে থাকা কৃষক আত্মহত্যার এই পরিসংখ্যানের সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া লোকসভা নির্বাচনে ছাপ ফেলতে পারে, সেই আশাঙ্কাতেই রিপোর্টটি দু–বছর পর প্রকাশ হল৷ এই দু’বছরে তারা আত্মহত্যার তথ্য পরিবেশনের সারণীতে একটা পরিবর্তন ঘটাল৷ দেখা গেল ‘অন্যান্য’ শিরোনামে আত্মহত্যার সংখ্যা বিগত বছরগুলির তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে৷ আবার ভাগ চাষিদের যেহেতু নিজের জমি নেই, তাই তাদের কৃষক তালিকাতে না রেখে কৃষি মজুরের তালিকাভুক্ত করা হল৷ ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষক আত্মহত্যাকে কম করে দেখানো গেল৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অর্থনীতির বেহাল দশার মাশুলটা যে দিতে হচ্ছে কৃষকদের, এই ভয়াবহ সত্যটা ঢাকতে সরকার মরিয়া৷
তা সত্ত্বেও যে সত্যটা বেরিয়ে এল রিপোর্টে, ভয়াবহতায় তা কম কোথায়? ২০১৬ সালে মোট ১১, ৩৭৯ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন৷ অর্থাৎ প্রতি মাসে ৯৪৮ জন, দৈনিক হিসাবে ৩১ জন৷ আর ১৯৯৫ সালে যখন থেকে এন সি আর বি–এর এই রিপোর্ট প্রকাশ শুরু হয়েছিল, সেই সময় থেকে দু–দশকে কৃষক আত্মহত্যা ঘটেছে ৩ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি৷ রাজ্যগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্র কৃষক আত্মহত্যায় শীর্ষে৷ এরপরেই রয়েছে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তিশগড়৷ এগুলির বেশিরভাগই তখন বিজেপি শাসিত ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকার এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য কেন্দ্রকে দেয়নি৷ অথচ সেখানেও যে কৃষক আত্মঘাতী হয়েছে সে সংবাদ নানা সময়ে খবরে উঠে এসেছে৷ এমনই একটি খবরে প্রকাশ গত সাত বছরে এ রাজ্যে ২০০টি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে৷
কেন এই আত্মহত্যা? নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের উদার আর্থিক নীতিতে গ্রামাঞ্চলও বিশ্বের খোলাবাজারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ ফলে চাষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী–সার–বীজ–কীটনাশক নিয়ে মুনাফা লুটতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিরা৷ চাষের সামগ্রী নিয়ে অসাধু ব্যবসা ও কালোবাজারি চলছে৷ সরকারও বিশ্বায়নের নীতি মেনে ভর্তুকি তুলে নিল৷ এর ফলে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম৷ ফলে চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বিপুল হারে৷ এই বিপুল খরচ বহন করতে চাষিকে ঋণ করতে হচ্ছে৷ সরকারি ঋণ পেতে কঠোর নিয়ম–কানুন মেনে বারবার সরকারি দপ্তরে ছোটার হয়রানি এড়াতে চাষি যাচ্ছে মহাজনের কাছে৷ সেখানে চড়া সুদে হলেও নগদ টাকা হাতে পেয়ে সময় মতো চাষটা শুরু করতে পারে চাষি৷ এরপর প্রকৃতি সদয় হলে চাষ করে ফসল ঘরে তোলে৷ শুরু হয় মহাজনের তাগাদা৷ নইলে চড় চড় করে বাড়বে সুদ৷ চাষি ছোটে সরকারি দপ্তরে ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রি করতে৷ কিন্তু দপ্তর তখন ঘুমিয়ে৷ কারণ ফসল কেনার সরকারি নির্দেশ আসেনি৷ নিরুপায় চাষিকে ছুটতে হয় কাছেই ওত পেতে বসে থাকা ফড়েদের কাছে৷ তারাই বিশ্ববাজারের এজেন্ট৷ তারা চাষিকে বোঝায় বাজারের মন্দার কথা৷ ফলে চাষি জলের দরে ফড়েদের হাতেই তার পরিশ্রমলব্ধ ফসল তুলে দিতে বাধ্য হয়৷ কিংবা রাগে দুঃখে ফসলে আগুন লাগিয়ে নিজে আত্মঘাতী হয়৷ এর সাথে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ৷ কোথাও খরায় চাষি সেচের জন্য ন্যূনতম জলটুকুও পায় না, কোথাও বন্যায় নষ্ট হয় ফসল৷ এভাবেই দেশের মানুষের মুখে যারা অন্ন যোগায়, তারা বছরের পর বছর ধরে আত্মঘাতী হয়ে চলেছে৷
এ দেশের সত্তর শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে যুক্ত৷ এদের ৮৬.২ শতাংশ হল প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র চাষি৷ এদের মোট জমির পরিমাণ মোট চাষযোগ্য জমির ৪৭.৩ শতাংশ৷ এর সাথে যাঁরা ২ থেকে ১০ হেক্টর জমির মালিক অর্থাৎ নিম্ন–মধ্য ও মধ্য চাষিরা হল ১৩.২ শতাংশ৷ অথচ এদের হাতে কৃষি জমি রয়েছে ৯.১ শতাংশ (দশম এগ্রিকালচারাল সেনসাস রিপোর্ট, ২০১৫–’১৬)৷ অর্থাৎ মুষ্টিমেয়র হাতে বেশি লাভজনক জমি৷ আবার সেনসাস সমীক্ষায় ধরা পড়েছে পাঁচ বছরে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা বেড়েছে ৯০ লক্ষ৷ প্রসঙ্গত রাশিয়ার বিপ্লবের আগেই লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী শোষণের চরিত্র দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, মুষ্টিমেয়র হাতে জমি কেন্দ্রীভূত হওয়া, খেতমজদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়া এবং ফসল জাতীয় বাজারের পণ্যে পরিণত হওয়া– এই বৈশিষ্ট্যগুলিই সুনির্দিষ্টভাবে তা দেখিয়ে দেয়৷ এ দেশের কৃষকরাও এই পুঁজিবাদী শোষণেরই শিকার৷ বিশ্বায়নের ফলে কৃষকের ফসল আজ শুধু জাতীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’, কিন্তু গ্রামের অলাভজনক জোতের চাষিদের বিকাশ, আর সার–বীজ–কীটনাশকে কালোবাজারি এবং বিশ্ববাজারের এজেন্ট ফড়েদের বিকাশ তো একই পথে হতে পারে না৷ সরকার কীভাবে উভয়ের স্বার্থ একসাথে রক্ষা করবে? আসলে সরকার তার করপোরেটের স্বার্থরক্ষাকারী চরিত্রকে আড়াল করতেই এই স্লোগান তুলছে৷ তাই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের মন্দা থেকে বাঁচাতে সরকার ১ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ইনসেনটিভ দিতে পারে, আবাসন শিল্পের ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ২৭ হাজার কোটি টাকা অনুদান দিতে পারে, কিন্তু ঋণগ্রস্ত কৃষকদের ঋণমকুবের ব্যবস্থা করতে পারে না৷ দেশের সত্তর ভাগ মানুষকে অর্ধমৃত করে রেখে দেশের প্রকৃত ‘বিকাশ’ বা যথার্থ ‘উন্নয়ন’ হতে পারে কি? তা যে পারে না, তার অন্যতম কারণ হল বর্তমান মারাত্মক মন্দা, যার অন্যতম কারণ চাহিদার অভাব৷ দেশের বেশিরভাগ কৃষকের দুরবস্থা এর এর অন্যতম কারণ৷ বর্তমান মন্দা পরিস্থিতির কারণ হিসাবে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না–থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ কোটি কোটি গ্রামীণ মানুষকে নিঃস্ব–রিক্ত করে রেখে সেই বাজার তৈরি হবে কি? আজ রাজ্যে রাজ্যে কৃষকরা বাঁচার দাবিতে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন৷ হাজারে হাজারে সামিল হচ্ছেন প্রতিবাদে, মিছিলে৷ প্রয়োজন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি, যা তাঁদের সমস্যাকে সঠিকভাবে বুঝতে শেখাবে এবং আন্দোলনকে চালিত করবে তার কাঙিক্ষত লক্ষ্যে৷