প্রচারের ফানুসে বাজার গরম করা কঠিন হয়ে পড়ছে বিজেপির

মাস দুয়েক আগে উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় স্যামসাং–এর এক মোবাইল কারখানার উদ্বোধন হল৷ টুইটার দক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় এটি তাঁর সাধের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মূর্ত প্রতীক এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল তৈরির কারখানা৷ এ হেন কারখানায় চাকরি হবে কতজনের? দেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখলেন, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ওই রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির দাবিতে কী আসমান–জমিন ফারাক মুখ্যমন্ত্রী যোগী যেখানে বুক বাজিয়ে ওই কারখানায় ৩৫ হাজার কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে নরেন্দ্র মোদি ঢোঁক গিলে বলেছেন, কাজ হবে মাত্র এক হাজার জনের৷ উপস্থিত স্যামসাং কর্তা অবশ্য কর্মসংস্থান প্রশ্নে একটি কথাও বলতে রাজি হননি৷

৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে যে প্রধানমন্ত্রী হামেশাই বিশাল আকারের প্রতিশ্রুতি বিলোতে অভ্যস্ত, কর্মসংস্থানের মতো জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে তাঁর এ হেন আচরণ কেন? প্রচারের ফানুস দিয়ে বাজার গরম করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে তবে কি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি? বছরে দু’কোটিকর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি বোধহয় এখন কাঁটার মতো বিঁধছে বিজেপি সরকারের গলায়৷ কারণ তথ্য বলছে, দু’কোটি দূরের কথা, বছরে দু’লক্ষ কর্মসংস্থান করতেই হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি সরকার৷ প্রতি বছর দ্বিগুণ হচ্ছে বেকারত্বের হার৷ সরকারি হিসাবে জুলাই ’১৭–তে বেকারের  হার যেখানে ছিল ৩.৩৯ শতাংশ সেটাই বেড়ে মার্চ–’১৮–তে হয়েছে ৬.২৩ শতাংশ (সূত্র : সি এম আই ই)৷ প্রকৃত অবস্থা যে আরও সঙ্গিন তা হলফ করেই বলা যায়৷

তথ্য বলছে, দু’কোটি দূরের কথা, বছরে দু’লক্ষ কর্মসংস্থান করতেই হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি সরকার৷ প্রতি বছর দ্বিগুণ হচ্ছে বেকারত্বের হার৷ সরকারি হিসাবে জুলাই ’১৭–তে বেকারের  হার যেখানে ছিল ৩.৩৯ শতাংশ সেটাই বেড়ে মার্চ–’১৮–তে হয়েছে ৬.২৩ শতাংশ৷ প্রকৃত অবস্থা যে আরও সঙ্গিন তা হলফ করেই বলা যায়৷

 

ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০১৪–র সেপ্টেম্বরে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বহু ঢাক–ঢোল পিটিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন৷ লোভনীয় শর্তে, শ্রমিক বিরোধী শ্রম আইন কাজে লাগিয়ে, সস্তা কাঁচামাল ও শ্রমিক জোগানের বিনিময়ে বিদেশি লগ্নি দেশে ডেকে আনা এবং তাদের দিয়ে ভারতে পণ্য উৎপাদন–এই ছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মূল কথা৷ কিন্তু প্রচার ও মার্কেটিংয়ে সুদক্ষ মোদিজির ভূ–ভারতে আলোড়ন তোলা সাধের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র সিংহটি বাস্তবে কাগুজে সিংহ ছাড়া যে কিছু নয়, ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ তথ্য থেকে জানা গেছে ২০১৪–এর পর থেকে উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য উন্নতিই হয়নি৷ মোট জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে যেখানে ১৯৯৫–তে উৎপাদন ক্ষেত্রের অংশ ছিল ১৮.৬ শতাংশ, বর্তমানে তা ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে (সূত্র : এই সময় ২০ জুলাই)৷ ফলে কর্মসংস্থানের হালও বেহাল৷

বাস্তবে উৎপাদন ক্ষেত্রে সংকট আজ বিশ্বজনীন৷ অতি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বিপুল পরিমাণে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে৷ শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ছে কম৷ সব দেশ বেকারে ছেয়ে যাচ্ছে৷ কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছে কাজ না পাওয়া শ্রমিক৷ ফলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না৷ সৃষ্টি হচ্ছে অতি–উৎপাদনের সংকট বা বাজার সংকট৷ পরিণতিতে নতুন কল–কারখানা খোলা দূরের কথা, চালু কারখানাগুলোই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ তাতেও নতুন করে কাজ হারাচ্ছেন মজুর–কর্মচারীরা৷ ক্রয়ক্ষমতার অভাবে আরও তীব্র হচ্ছে বাজার সংকট৷ ক্রমাগত কমছে কর্মসংস্থানের হার৷

এই সংকট আজ গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়া জুড়ে৷ এ থেকে বাঁচতে যে  মুহূর্তে মোদি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্লোগান দিচ্ছেন, সেই সময়ে চীনের প্রধানমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হচ্ছে ‘মেড ইন চায়না’ প্রকল্প যার মাধ্যমে ২০২৫–এর মধ্যে চীনকে উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার গল্প নির্মাণ করা হচ্ছে৷ আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকেও তুলতে  হচ্ছে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’–এর মতো বুলিসর্বস্ব স্লোগান৷ কিন্তু সংকট কিছুতেই কাটছে না৷ অঢেল সুযোগ–সুবিধা দিয়ে বিদেশি পুঁজিকে হাজারো লোভ দেখানো সত্ত্বেও ভারতে যথেষ্ট পরিমাণে লগ্নি হচ্ছে না৷ নয়ডার স্যামসাং কারখানার মতো এখানে–ওখানে দু–একটা কারখানা তৈরি হলেও কর্মসংস্থান হচ্ছে না বললেই চলে৷ বেকার সমস্যা ও তাকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে ক্ষোভ ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে৷ গত চার বছরের বিজেপি শাসনে ফাঁস হয়ে গেছে, নেতা–মন্ত্রীদের দেওয়া এ সংক্রান্ত সমস্ত প্রতিশ্রুতিই ছিল মিথ্যা৷ পরিস্থিতি এমনই যে এ নিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াতেও আর ভরসা পাচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদিদের মতো ভোটবাজ দলের নেতারা৷ তাই বোধহয় নয়ডায় প্রধানমন্ত্রীর এমন ভোলবদল৷

(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)