২৪ এপ্রিল এবার এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৪ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। দিনটি শুধু এ দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জন্যই নয়, গোটা দেশের শোষিত মেহনতি মানুষের কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এই দিনটিতেই ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবর্ষের একমাত্র সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি। বারবার এই ‘সত্যিকারের’ শব্দটি আমাদের ব্যবহার করতে হয় কারণ, এ দেশে কমিউনিস্ট নাম নিয়ে অনেক পার্টি আছে। বহু দিন ধরে তারা ভারতবর্ষে কার্যকলাপ চালাচ্ছে, আকারও তাদের ছোট নয়। অধুনা তাদের আচার-আচরণে যে ভাবে যে কোনও একটি বুর্জোয়া পার্টির চরিত্রলক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে, এক সময়ে তা ছিল না। সিপিআই এবং তারপর তাকে ভেঙে সিপিআই(এম) সহ যত গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তাদের সকলের মধ্যেই একসময় সততা, নিষ্ঠা ছিল। কমিউনিজমের মহান আদর্শের প্রতি আবেগও ছিল। কেউ মুখে স্বীকার করুন বা না-করুন, একান্তে স্বীকার করতে বাধ্য, এই সিপিএম দলটির মধ্যে সততা, নিষ্ঠা ও সর্বোপরি আদর্শপরায়ণতার লেশমাত্র নেই। এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, কমিউনিজমের আদর্শই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে, সেই কমিউনিজমের আদর্শকে পেতে হলে আজকের দিনে তা যে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) দলের মধ্যেই পাওয়া যাবে, এ সত্যটা দেখাতেই ‘সত্যিকারের’ শব্দটা আমাদের ব্যবহার করতে হয়।
এবারের ২৪ এপ্রিল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পটভূমিতে এসেছে এবং উন্নততর তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অন্যতম অঙ্গ হল লোকসভা, বিধানসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচন এবার পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবেশ সৃষ্টি করল, গদি ধরে রাখার ও গদি দখল করার লক্ষ্যে ধাবিত প্রতিযোগী দলগুলির মধ্যে যে ধরনের কদর্য, কুৎসিত কথার ছড়াছড়ি পাওয়া গেল, তা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে চূড়ান্তভাবে কলুষিত করেছে। ইতিপূর্বেও অনেক নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এত কলুষিত পরিবেশ ইতিপূর্বে সৃষ্টি হয়েছে কি না সন্দেহ। আরও একটি লক্ষণীয় দিক হল, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে স্বাধীনতার পর থেকে বামপন্থী রাজনীতি একটা শক্ত অবস্থান নিয়ে ছিল। এবার সেখানে দেখা গেল, দুই দক্ষিণপন্থী শক্তির দাপাদাপি। শাসক তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে সামনে আসতে পারল না ৩৪ বছর ধরে একটানা নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় থাকা সিপিএম-ফ্রন্ট। এসে গেল চরম দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা তাদের শক্তি প্রদর্শনের, অর্থবল দেখানোর সুযোগ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু শুধু তার জোরে বিজেপি এ জায়গায় আসতে পারত না। এ ভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করতে পারত না। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটি দক্ষিণপন্থী প্রাদেশিক শক্তি যতই অপশাসন চালাক, শুধু তার দ্বারা বিজেপি-র উত্থান সম্ভব হত না এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্য থেকে ১৮টি আসন জিতে নেওয়া সম্ভব হত না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানেন, এ বিষয়ে বিজেপিকে পূর্ণ মদত দিয়েছে সিপিএম। তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে হঠাবার জন্য তারা এতটাই মরিয়া যে, বিজেপির পক্ষে দলে দলে গিয়ে ভোট দিতে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের এতটুকু বিবেকে বাধেনি।
এ হল একটি দিক। অন্যদিকে বিজেপির মতো শক্তি যে পশ্চিমবঙ্গে মাথা তুলতে পারল, দাপিয়ে বেড়াতে পারল, যা খুশি বলতে পারল, তা এ রাজ্যের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের অধঃপতনকেই সূচিত করে। জাত-পাত-ধর্মের বিভাজন সমাজ-মানসিকতায় থাকলেও, তাকে এভাবে প্রকাশ্যে রাজনীতির হাতিয়ার করে ভোটের খোলা ময়দানে টেনে আনার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি, যেটা বিজেপি এবার অনায়াসে করল। এ কাজ তৃণমূল কংগ্রেস করেনি, তা নয়। কিন্তু এত নগ্ন ভাবে সে করতে পারেনি।
প্রশ্ন যেটা ওঠে, বিজেপি চাইলেই এ কাজ করতে পারল কী করে! সামাজিক বাধার সম্মুখীন হল না কেন? এমনকি, যুব সম্প্রদায়ের একাংশকেও দেখা গেল, টাকার কাছে বিকিয়ে গিয়ে বিজেপির হট্টরোলে সামিল হতে। পশ্চিমবাংলার যে যুবশক্তি একদিন বলিষ্ঠতায়, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তেজে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কেন্দে্রর শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, আজ সেই বাংলার যুবশক্তির এই হাল হল কেন? কারা দায়ী? পশ্চিমবাংলার যুবশক্তি যেদিন লড়াইয়ের মেজাজে, অন্যায়ের প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, সেই যুবশক্তি ছিল বামপন্থার আদর্শের প্রতি অনুরক্ত। বামপন্থা ঠিক ঠিক ভাবে বুঝুক না-বুঝুক, নিজেদের বামপন্থী বলতে তারা গর্ববোধ করত। আজ সেই রাজ্যের যুবকরাই অনায়াসে তৃণমূল কংগ্রেসের অর্থহীন ‘মা-মাটি-মানুষে’র স্লেগান বা বিজেপির ‘জয় শ্রীরাম’ ফ্যাসিস্ট আওয়াজ দিয়ে মিছিল করছে কী করে? বোঝাই যায়, এ রাজ্যের ছাত্র-যুব শক্তির নৈতিক মেরুদণ্ডটি ভেঙে দিতে শাসকরা সফল হয়েছে। কেন পারল? যে রাজ্যে সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামপন্থীরা টানা ৩৪ বছর নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিয়ে সরকার চালিয়েছে, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে সর্বত্র একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই রাজ্যে তারা ক্ষমতা থেকে যাওয়ার ১০ বছরের মধ্যে এ জিনিস ঘটতে পারল কী করে? আসলে বামপন্থার নামে তারা যে কাজটি করেছে, আজ সেই কাজটিই দক্ষিণপন্থী তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির পতাকা নিয়ে যুবকরা করছে। পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় থেকে সিপিএম যুক্তিবুদ্ধির কারবার, মতাদর্শগত বিতর্ক, তর্কাতর্কি– সব কিছুকে পিটিয়ে ঠেঙিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল। তাদের বিরোধী মানেই শত্রু ও চক্রান্তকারী। বিরোধী রাজনীতির প্রতি এই ভাষা যে তারা আমদানি করেছিল, লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সেই একই ভাষা এখন দক্ষিণপন্থী দলগুলির মুখে। সরকারি ক্ষমতার জোরে অতি দ্রুত দল বাড়ানোর উদগ্র বাসনায় সিপিএম তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যুক্তিহীনতা, সুবিধাবাদ, গায়ের জোরে বিরোধী যুক্তিকে উড়িয়ে দেওয়ার যে চর্চা দীর্ঘদিন করেছে তা ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়ার জমি প্রস্তুত করেছে। যার উপর পা রেখেই আজ বিজেপি সহ সমস্ত দক্ষিণপন্থী শক্তির বাড়বাড়ন্ত। এই হুঁশিয়ারি বহু দিন আগেই দিয়েছিলেন এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ। এই সত্যকে না বুঝতে চাইলে বামপন্থার কথা সিপিএম কর্মীদের কাছে শেষ পর্যন্ত আত্মপ্রতারণা হয়েই থাকবে।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গঠনের হুঙ্কার দিল, সেটিও ছিল সিপিএমের থেকেই ধার করা। ফলে, কথায়-বার্তায়, আচারে-আচরণে আজ রাজনীতির যে অধঃপতন পশ্চিমবাংলার বুকে দেখা যাচ্ছে, এর সবটাই সিপিএমের অবদান।
আমরা বারবার সিপিএমের দিকে আঙুল তুলছি এই কারণেই, যে এই চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কলুষ থেকে পশ্চিমবাংলাকে মুক্ত করতে গেলে প্রকৃত বামপন্থাকে বিকল্প হিসাবে উপস্থিত করতে হবে এবং সেটা সিপিএমের মতো দলগুলি পারে না। মার্কসবাদ-কমিউনিজমের আদর্শ দূরের কথা, বামপন্থী রাজনীতি নিয়ে চলতে গেলেও যে আদর্শবাদ, যে স্বচ্ছতা রাজনীতিতে থাকা দরকার, সিপিএম আজ তার থেকেও বহু দূরে চলে গেছে। আমাদের এই কথায় সিপিএমের সৎ কর্মী-সমর্থকরা দুঃখ পেতে পারেন। কিন্তু তাঁদের আঘাত দেওয়ার কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। আমাদের লক্ষ্য একটাই– বামপন্থী রাজনীতির মর্যাদাকে জনগণের চোখে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।
এই আহ্বান নিয়েই এ বছর ২৪ এপ্রিল আমাদের সামনে উপস্থিত এবং এই লক্ষ্যেই আমরা তা উদযাপন করবো।