ভারতীয় অর্থনীতিতে বেকারত্ব নিয়ে কিছু কথা হলেও, মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সমীক্ষার যে দুশো পৃষ্ঠার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মজুরি সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। এমনকি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেট বত্তৃতাতেও তার কোনও উল্লেখ নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত মজুরি বৃদ্ধি ১ শতাংশেরও কম, যেখানে আদানির সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ১৪৪০ শতাংশ। সমস্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিগত আট বছরে কৃষিতে ০.৯ শতাংশ, নির্মাণ শিল্পে ০.২ শতাংশ, অকৃষি ক্ষেত্রে ০.৩ শতাংশ প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য বলছে মাত্র দুটি রাজ্য কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে দুই শতাংশের সামান্য বেশি মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে (যথাক্রমে ২.৪ ও ২.৭ শতাংশ)। অন্য দিকে হরিয়ানা, কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, তামিলনাড়ূ প্রভৃতি রাজ্যে প্রকৃত মজুরি কমেছে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ ‘ওয়েজেস আর ওয়রি, নট জাস্ট আনএমপ্লয়মেন্ট’ (মজুরি যতটা দুশ্চিন্তার, বেকারত্ব ততটা নয়) প্রবন্ধে বলতে চেয়েছেন, আমাদের অর্থনীতির আলোচনার অভিমুখ পাল্টানো প্রয়োজন। কারণ, ভারতে গরিব মানুষের কিছু না করে বাঁচার উপায় নেই। বেঁচে থাকার জন্য তাদের কিছু না কিছু করতেই হয়। ভাল কাজের জন্য অপেক্ষা করার উপায় তাদের নেই। কেউ ডিম বিক্রি করে, কেউ রিক্সা টেনে দিন গুজরান করে। বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা করার সময় এদের বেকার বলে চিহ্নিত করা হয় না। ফলে সমস্যাটা বেকারত্বের নয়, ছদ্ম বেকারত্বের। আর এই ছদ্ম বেকারত্ব পরিমাপ করা কঠিন।
যদি প্রকৃত মজুরি বাড়ে, তবে শ্রমিকরা অধিক বেতন পায়, উন্নত জীবনযাত্রা পরিচালনা করতে পারে। মজুরিবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নতির মাপকাঠি। কারণ, তা শ্রমদিবস সৃষ্টি করে। অন্য দিকে প্রকৃত মজুরির ক্ষেত্রে যদি বন্ধ্যাত্ব আসে, তবে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। বিশেষত দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে।
প্রকৃত মজুরি অত্যন্ত সহজেই নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা বেকারত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে হয় না, বিশেষ করে বেশ কয়েকটি পেশার ক্ষেত্রে। যেমন কৃষি শ্রমিকের ক্ষেত্রে। ভারতের যে কোনও গ্রামে কোনও একজন কৃষিশ্রমিক কত পারিশ্রমিক পান, তা জানা অত্যন্ত সহজ। এক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি সার্ভে করার প্রয়োজনই হয় না। সহজ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর নিলেই তা জানা যায়।
ভারতের লেবার বুরো বেশ কয়েক বছর এই কাজটি করে আসছে। লেবার বুরোর এই তথ্য সবসময় যে বিশ্বাসযোগ্য হয়, তা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি মোটামুটি ধারণা এ থেকে পাওয়া যেতেই পারে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া লেবার বুরোর এই তথ্য নিয়ে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানে চার ধরনের শ্রমিকের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এরা হল কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, অকৃষি শ্রমিক এবং উদ্যানে নিয়োজিত শ্রমিক। লেবার বুরোর এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিগত আট বছরে মজুরির উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। অন্য কথায়, আট বছর কোনও মজুরি বাড়েনি। অথচ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে কয়েক গুণ।
এখান থেকে কতকগুলি বিষয়ে আমরা স্পষ্ট ধারণা পাই। এক, প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির দিকে কেন্দ্র কিংবা রাজ্য কোনও সরকারেরই কোনও দৃষ্টি নেই। অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করছে, তা নিয়ে সরকারগুলির কোনও মাথাব্যথা নেই। দুই, মজুরি সংক্রান্ত তথ্য নিখুঁত ভাবে পাওয়ার কোনও ব্যবস্থাই সরকারগুলি করেনি। তিন, ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির যে জয়ঢাক পেটানো হচ্ছে, তার সাথে শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। সেই উন্নতি আসলে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদেরই। তাই পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা আকাশ ছুঁয়ে গেলেও শ্রমজীবী মানুষের মজুরি কিছুমাত্র বাড়েনি।
সর্বশেষে বলা চলে, এই আসমান-জমিন ফারাক এই পুঁজিবাদী সমাজের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। এই সমাজটিকে টিকিয়ে রেখে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে কোনও কল্যাণ আসতে পারে না। একে ভাঙাই শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।