‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’র মুখবন্ধ
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস
১৮৮৩ সালে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান শিক্ষক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস রচনা করেন ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’৷ এতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত সমস্যাগুলির সর্বাঙ্গীণ ব্যাখ্যা দেন তিনি৷ রচনার মুখবন্ধে সমগ্র বিষয়টি চুম্বকে তুলে ধরেছিলেন এঙ্গেলস৷ তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে মুখবন্ধটি প্রকাশ করা হল৷ এবার দ্বিতীয় কিস্তি৷
(২)
জ্ঞানের দিক থেকে, এমনকি তথ্য ঝাড়াই–বাছাইয়ের দিক থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের প্রকৃতি বিজ্ঞান প্রাচীন গ্রিসের তুলনায় যেমন এগিয়ে ছিল, তেমনই সেইসব তথ্যের ভিত্তিতে তত্ত্বগত ধারণা গড়ে তোলা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পিছিয়ে ছিল৷ প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা মনে করতেন, প্রাথমিক বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে, যে বিশ্ব বিকশিত হয়েছে, যা বাস্তব রূপ নিয়েছে৷ কিন্তু যে সময়ের কথা আমরা বলছি সে যুগের প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের মতে বিশ্ব হচ্ছে প্রস্তরীভূত, অপরিবর্তনীয় একটা কিছু৷ তাঁদের অনেকের মতে, এক লহমায় তা সৃষ্টি হয়েছিল৷ বিজ্ঞান তখনও ধর্মশাস্ত্রের নাগপাশে বাঁধা৷ তখন বিজ্ঞান সবকিছুরই পরম কারণ খুঁজত আর খুঁজে পেত এমন এক প্রকৃতি–বহির্ভূত আকস্মিক বলের ধারণায়, প্রকৃতির কোনও কিছু দিয়ে যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না৷ এমনকি যে আকর্ষণ শক্তি, নিডটন সাড়ম্বরে যাকে ‘সর্বব্যাপক মহাকর্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন, তাকে যদি বা মনে করা হল বস্তুরই অন্তর্নিহিত ধর্ম, তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে, অব্যাখ্যাত যে স্পর্শক বল (ট্যানজেনশিয়াল ফোর্স) প্রথম গ্রহ–উপগ্রহের কক্ষপথ তৈরি করেছে, সেটা এসেছে কোথা থেকে? উদ্ভিদ ও প্রাণীর অসংখ্য প্রজাতিই বা কোথা থেকে এসেছে? সর্বোপরি, মানুষ কোথা থেকে এসেছে– কারণ, এটা নিশ্চিত যে, অনাদিকাল থেকে মানুষ ছিল না৷ এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রকৃতি বিজ্ঞান প্রায়শই সর্ববস্তুর সৃষ্টিকর্তাকে দায়ী করে দিত৷ ইতিহাসের এই পর্যায়ের সূচনায় কোপার্নিকাস ধর্মতত্ত্বকে বাতিল করছেন৷ নিডটন এই পর্যাযের সমাপ্তি টানেন এক স্বর্গীয় প্রথম তাড়না (ফার্স্ট ইমপাল্স) প্রকল্প দিয়ে৷ এই পর্যায়ে প্রকৃতিবিজ্ঞান সর্বোন্নত যে সাধারণ ধারণায় পৌঁছয় তা হল, প্রকৃতি–ব্যবস্থায় একটি উদ্দেশ্যময়তার বোধ, উলফের সেই অগভীর পরমলক্ষ্যবাদ, যাতে বেড়ালের সৃষ্টি হয়েছে ইঁদুর খাওয়ার জন্য, আর ইঁদুর সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল বেড়ালের খাদ্য জোগানো৷ এবং সমগ্র প্রকৃতির সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টিকর্তার বিচক্ষণতা প্রমাণের জন্য৷ তৎকালীন দর্শনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল, প্রকৃতি সম্পর্কে সমসাময়িক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তা নিজেকে বিপথগামী হতে দেয়নি৷ স্পিনোজা থেকে মহান ফরাসি বস্তুবাদীরা, সকলেই বস্তু দিয়েই বস্তুবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার কথা বলেছেন এবং বিস্তারিতভাবে যৌক্তিকতা প্রমাণের ভার ভবিষ্যতের প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন৷
আমি অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদীদেরও এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত করি, কারণ প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্বোক্ত তথ্যগুলি ছাড়া আর কিছু তাঁদের হাতে ছিল না৷ কান্টের যুগান্তকারী কাজের কথা তাঁদের কাছে গোপন থেকে গিয়েছিল, এবং লাপ্লাস এসেছিলেন অনেক পরে৷ আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে প্রকৃতি সম্পর্কে এই অচল দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও, উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল প্রধান৷ এমনক আজও পর্যন্ত সমস্ত সুক্লে এরই মূল কথাগুলি শেখানো হয়৷
প্রকৃতি সম্পর্কে এই প্রস্তরীভূত ধারণা যিনি প্রথম ভাঙেন তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, প্রকৃতিবিজ্ঞানী নন৷ ১৭৫৫ সালে প্রকাশিত হয় কান্টের ‘সাধারণ প্রাকৃতিক ইতিহাস ও নভোতত্ত্ব’৷ ‘প্রথম তাড়না’র প্রশ্নটি বাতিল করা হল, পৃথিবী ও সমগ্র সৌরজগতটিকে দেখানো হল এমন একটি বস্তুরূপে যা কালের গতিতে পরম্পরাক্রমে গড়ে উঠেছে৷ নিউটন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘পদার্থবিদ্যা (ফিজিক্স) অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্স) থেকে দূরে থাকো’– এই হুঁশিয়ারি সম্পর্কে বেশিরভাগ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর বিতৃষ্ণা যদি একটু কম থাকত, তবে কান্টের এই একটিমাত্র যুগান্তকারী আবিষ্কারকে তাঁরা ঠিকমতো বুঝতেন ও তা তাঁদের সীমাহীন বিচ্যুতি ও ভ্রান্ত পথে বিপুল শ্রম ও সময় নষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে পারত৷ কারণ পরবর্তী যাবতীয় অগ্রগতির সূচনাবিন্দুটি ছিল কান্টের আবিষ্কারের মধ্যে৷ পৃথিবী যদি কালের গতিতে পরম্পরাক্রমে গড়ে ওঠে, তবে সবই তো সেইভাবে ক্রমশ গড়ে ডঠেছে৷ পৃথিবীর ভূবিজ্ঞানগত ও ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ু, গাছপালা, প্রাণী সবই একইরকম ভাবে কালের গতিতে গড়ে–ওঠা ব্যাপার৷ এর স্থানগত সহাবস্থানের ইতিহাসই শুধু নয়, কালগত পরম্পরারও একটা ইতিহাস আছে৷ যদি কালবিলম্ব না করে এই ধারায় অনুসন্ধান করা হত, তবে প্রকৃতিবিজ্ঞান এখন যে অবস্থায় আছে তা থেকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত৷ কিন্তু দর্শনের তাতে কী লাভ হত? কান্টের আবিষ্কারের আশু ফল কিছু হয়নি, যতদিন না বহু বছর পর লাপ্লাস ও হার্শেল কান্টের চিন্তার মর্মবস্তুকে আরও সম্প্রসারিত করেন ও গভীরতর বনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন এবং এইভাবে ক্রমে ‘নীহারিকা সম্পর্কে আনুমানিক ধারণা’টির (ঘূর্ণ্যমান গ্যাসীয় নীহারিকা থেকে ক্রমশ পৃথিবীর উদ্ভবের কান্ট অনুমিত তত্ত্ব) স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেন৷ পরবর্তীকালের আবিষ্কারগুলি কান্টের অনুমানের বিজয় সূচিত করে৷ এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলি হল– স্থির তারাগুলির প্রকৃত গতি আবিষ্কার, মহাশূন্যে প্রতিবন্ধক মাধ্যমের উপস্থিতির প্রমাণ, বর্ণালী বিশ্লেষণের দ্বারা প্রমাণিত মহাজাগতিক বস্তুর রাসায়নিক অভিন্নতা এবং কান্ট অনুমিত জ্বলন্ত নীহারিকার মতো পদার্থের অস্তিত্ব প্রমাণ৷
প্রকৃতি শুধু বিদ্যমান তাই নয় তার উদ্ভব ও রূপান্তর ঘটে, এই উদীয়মান উপলব্ধির সমর্থন যদি অন্য একটা মহল থেকে না পাওয়া যেত, তাহলে পৃথিবীতে অপরিবর্তনীয় জীবসত্তার বাস, এই অনুমানের সঙ্গে পৃথিবী পরিবর্তনশীল– এই ধারণার স্ববিরোধ সম্পর্কে অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী এত শীঘ্র সচেতন হয়ে উঠতেন কি না, তাতে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে৷ ভূবিজ্ঞান উদ্ভবের পরই দেখায়– একটার পর একটা স্তর জমে জমে ভূস্তর তৈরি হয়েছে শুধু নয়, স্তরে স্তরে রয়েছে এমন সব প্রাণীর খোলস, কঙ্কাল যেসব প্রাণী লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, এমন সব গাছের গুঁড়ি, পাতা ও ফল যেসব গাছপালা বর্তমানে নেই৷ এ থেকে যে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয় তা হল, সামগ্রিকভাবে পৃথিবী শুধু নয়, পৃথিবীর বর্তমান উপরিতল, গাছপালা এবং প্রাণী সবকিছুরই একটা কালগত ইতিহাস আছে৷ এই স্বীকৃতি এল প্রথমে নিতান্ত অনিচ্ছা সহকারে৷ পৃথিবীর বুকে সংঘটিত বিপ্লব সম্পর্কে ক্যুভিয়েরের তত্ত্ব ছিল কথায় বৈপ্লবিক, কিন্তু মর্মবস্তুতে প্রতিক্রিয়াশীল৷ ঈশ্বরের হাতে এক লহমায় সবকিছু সৃষ্টির বদলে ক্যুভিয়ের বারংবার ধারাবাহিক সৃষ্টিকার্যের কথা বলেন এবং অলৌকিককে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেন৷ সৃষ্টিকর্তার মর্জিমাফিক হঠাৎ হঠাৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বদলে পৃথিবীর ধীর রূপান্তরের ক্রমিক প্রক্রিয়ার তত্ত্ব উপস্থিত করে লায়েলই প্রথম ভূবিজ্ঞানকে একটা অর্থবহ রূপ দেন৷
জীব প্রজাতিকে স্থির বলে মনে করার যে ধারণা, সেই ধারণার সঙ্গে তাঁর যেকোনও পূর্বসূরির চাইতে লায়েলের তত্ত্বের অমিল বেশি৷ পৃথিবীর উপরিভাগ ও তার সর্বপ্রকার জীবন পরিস্থিতির ক্রমিক রূপান্তরের ধারণা থেকে সরাসরি এল জীবসত্তাগুলির ক্রমিক রূপান্তর ও পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং এক প্রজাতির ভিন্ন প্রজাতিতে পরিবর্তিত হওয়ার ধারণা৷ কিন্তু কেবল ক্যাথলিক গির্জা নয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্য হল একটি বড় শক্তি৷ অনেক বছর ধরে লায়েল নিজেই এই বিরোধকে বুঝতে পারেননি, তাঁর ছাত্ররা বুঝেছেন আরও কম৷এর একমাত্র কারণ হল সেই শ্রমবিভাগ যা তখনকার প্রকৃতি বিজ্ঞানে ইতিমধ্যেই প্রাধান্য পেয়েছে, যার ফলে প্রত্যেকে তার নিজের বিশেষ ক্ষেত্রে কমবেশি আবদ্ধ হয়ে পড়ে, দু–চারজনই থাকেন ব্যতিক্রম, যাঁদের সামগ্রিকভাবে দেখার দৃষ্টি নষ্ট হয় না৷
ইতিমধ্যে পদার্থ বিজ্ঞানের বিরাট অগ্রগতি হয়েছে৷ তিনজন ভিন্ন ব্যক্তি প্রায় একইসঙ্গে তার ফলাফলের সারসংকলন করেন ১৮৪২ সালে, প্রকৃতিবিজ্ঞানের এই শাখাটির পক্ষে তা ছিল যুগান্তকারী৷ হিলব্রনে মায়ের ও ম্যাঞ্চেস্টারে জুল তাপশক্তিকে যন্ত্রশক্তিতে ও যন্ত্রশক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেখান৷ তাপশক্তি ও যন্ত্রশক্তির সমমানতা নির্ধারণের ফলে এটা তর্কাতীত হয়ে ওঠে৷ ওই সময়ে প্রাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফলকে সংযোজিত করে পেশায় পদার্থবিজ্ঞানী না হয়েও ইংরেজ আইনজীবী গ্রেভ দেখান তথাকথিত ভৌতশক্তিগুলি যেমন, যান্ত্রিক শক্তি, তাপ, আলোক, বিদ্যুৎ ও চৌম্বকশক্তি এমনকি যাকে রাসায়নিক শক্তি বলি তাও বিশেষ অবস্থায় একে অপরে রূপান্তরিত হতে পারে, তাতে বিন্দুমাত্র শক্তিক্ষয় হয় না৷ এইভাবে পদার্থ অনুশীলন দ্বারা আরেকবার দেকার্তের এই প্রতিপাদ্যও প্রমাণিত হল যে, জগতে যে গতি রয়েছে তার পরিমাণ নির্দিষ্ট৷ এর ফলে বিশেষ বিশেষ ভৌত শক্তিগুলি, অর্থাৎ বলতে গেলে পদার্থবিদ্যার অপরিবর্তনীয় সব ‘প্রজাতি’, বস্তুর গতির নানা রূপ হিসাবে চিহ্ণিত হয়, যা সুনির্দিষ্ট নিয়মে ভিন্ন রূপে রূপান্তরিত হতে পারে৷ ভৌতশক্তিগুলির নানা রূপের আন্তর্সম্পর্ক ও রূপান্তরের নিয়ম জানার সাথে সাথে ভৌতশক্তির বিভিন্ন রূপের পরিমাণ পৃথক পৃথকভাবে সুনির্দিষ্ট – এই ধারণাও পদার্থবিজ্ঞান থেকে বিদায় নেয়৷ জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর এবার পদার্থবিজ্ঞানও অবধারিতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, চূড়ান্ত বিচারে জগৎ হল গতিশীল বস্তুর চিরন্তন চক্র৷
ল্যাভয়েশিয়রের পর, বিশেষত ডাল্টনের পর থেকে রসায়নের আশ্চর্য রকমের দ্রুত বিকাশ প্রকৃতি সম্বন্ধীয় পুরনো ধারণার বিরুদ্ধে আরেকটি দিক থেকে আক্রমণ করল৷ যেসব জৈববস্তু এতদিন কেবল জীবের মধ্যেই সৃষ্ট হয়েছে, সেইসব জৈবযৌগ অজৈব উপায়ে তৈরি করায় সাফল্য প্রমাণ করে যে, রসায়নের নিয়ম জৈব ও অজৈব উভয় পদার্থের ক্ষেত্রেই সমানভাবে কার্যকর৷ ফলে অজৈব ও জৈব জগতের মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য এমনকি কান্টও অনতিক্রম্য মনে করেছিলেন, সেই পার্থক্য অনেকটা কমে যায়৷
পরিশেষে, গত শতকের মধ্যভাগ থেকে নিয়মিতভাবে যেসব বৈজ্ঞানিক পরিভ্রমণ ও অভিযান সংগঠিত হয়েছিল, সেই সবের ফলে, পৃথিবীর সর্বাংশে যেসব ইউরোপীয় উপনিবেশ আছে সেখানে বসবাসকারী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান, নিয়মিতভাবে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে প্রত্নজীববিদ্যা, শারীরসংস্থান ও শারীরবিজ্ঞানের যে বিকাশ এবং জীবকোষের আবিষ্কারের ফলে জীবনবিজ্ঞানের গবেষণায় এত বিপুল তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল যে তুলনামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হল ও একই সাথে তা অপরিহার্য হয়ে পড়ল৷ একদিকে তুলনামূলক প্রাকৃতিক–ভূগোলবিদ্যার সহায়তায় নানা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনধারণের অনুকূল পরিবেশগুলি চিহ্ণিত করা সম্ভব হয়, অন্যদিকে অনুরূপ অঙ্গ ধরে ধরে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে, কেবল তাদের পরিণত বয়সেই নয়, বিকাশের সর্বস্তরেই তুলনা করা সম্ভব হয়৷ এই গবেষণা যত বেশি গভীর ও সুনির্দিষ্ট ভাবে চলল ততই তার ধাক্কায় জীবজগতের অপরিবর্তনীয়তায় অনড় ধারণার অচলায়তন ভেঙে পড়তে লাগল৷ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিগুলি যে ক্রমেই বেশি করে ভেদাভেদ মিলিয়ে মিশে যেতে লাগল শুধু তাই নয়, এমন সব প্রাণী পাওয়া গেল, যেমন অ্যাম্ফিক্সাস ও লেপিডোসিরেন, যারা পূর্বেকার সমস্ত শ্রেণিবিভাগকে যেন বিদ্রূপ করল৷ পরিশেষে দেখা গেল, এমন সব জীব আছে, যারা উদ্ভিদ না প্রাণী, কোন জগতের তা নিশ্চিত করে বলা যায় না৷ প্রত্নজীববিজ্ঞানে যেসব ফাঁকগুলি ছিল ক্রমশ তা পূরণ হয়ে আসতে থাকে৷ ফলে নিতান্ত অনিচ্ছুকদেরও স্বীকার করতে হয় যে, সমগ্র জীবজগতের যেমন বিবর্তনের ইতিহাস আছে তেমনি তার সমান্তরালভাবে বিশেষ জীবেরও বিবর্তনের ইতিহাস আছে৷ ফলে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান যে জটিল গোলকধাঁধায় পথ হারিয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার এরিয়াডনের সূত্র পাওয়া গেল৷ লক্ষণীয় যে প্রজাতিসমূহের নির্দিষ্টতার ধারণার বিরুদ্ধে উলফও প্রথম আক্রমণ করলেন এবং বংশগতির তত্ত্ব (থিওরি অফ ডিসেন্ট) ঘোষণা করলেন৷ কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে যেটা শুধু একটা চমৎকার অনুমান মাত্র ছিল, একেন, লামার্ক ও বেয়ারের হাতে তা সুনির্দিষ্ট রূপ নিল এবং সেটাকেই ঠিক একশো বছর পরে ১৮৫৯ সালে ডারউইন বিজয়গর্বে বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করলেন৷ এতদিন যে প্রোটোপ্লাজম ও কোষকে সকল জীবদেহের গঠনগত উপাদান বলে মনে করা হয়েছিল, দেখা যায় যে, সেগুলি হল ক্ষুদ্রতম জৈবরূপ, যা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে৷ এই আবিষ্কারের ফলে শুধু যে জৈব ও অজৈব প্রকৃতির মধ্যেকার ব্যবধানই ন্যূনতম হয়ে গেল তাই নয়, জীবসত্তার ক্রমোদ্ভবের তত্ত্বে পূর্বে যে প্রধান মূল বাধাটি ছিল, সেটাও এর ফলে দূর হয়ে গেল৷ প্রকৃতি সম্বন্ধে এই নব বোধ তার সমস্ত প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির দিক থেকে সুসম্পূর্ণ হয়ে উঠল৷ সমস্ত রকমের অনড়তা ভেঙে গেল, সব স্থিরতা খসে গেল, যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে চিরন্তন মনে করা হত, সেগুলি হয়ে উঠল অস্থায়ী, প্রমাণিত হল যে, প্রকৃতির সবটাই চিরন্তন প্রবাহ ও চক্রাকার গতিতে চলমান৷
এইভাবে আবার আমরা আবার ফিরে আসি গ্রিক দর্শনের মহান প্রতিষ্ঠাতাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে৷ তাঁরা ভেবেছিলেন– ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম, বালুকণা থেকে সূর্যসম নক্ষত্রগুলি, এককোষী প্রোটিস্টা থেকে মানুষ– সবই চিরকাল জন্মমৃত্যুর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে নিরন্তর গতি ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে৷ একটা মূল পার্থক্য কেবল এইখানে যে, গ্রিকদের কাছে যা ছিল একটি চমৎকার অন্তর্জ্ঞান (ইনটুইশন), সেটা আমাদের কাছে হল অভিজ্ঞতাভিত্তিক একান্তই বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলস্বরূপ, এবং তাই এটা ঢের বেশি নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেছে৷ অবশ্য অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া এই চক্রাকার গতিধারার ক্ষেত্রে প্রমাণে কোথাও ফাঁক নেই, তা নয়৷ তবে যেসব প্রমাণের ভিত্তিতে তা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার তুলনায় ফাঁকগুলি অকিঞ্চিৎকর এবং বছরে বছরে ফাঁকগুলি ক্রমেই ভরে যাচ্ছে৷ তাছাড়া, খুঁটিনাটি প্রমাণের ব্যাপারে অসম্পূর্ণতা না থেকে পারে না, কেননা, মনে রাখতে হবে যে, গ্রহান্তর জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, ভূবিদ্যা– বিজ্ঞানের এই মূল শাখাগুলির বৈজ্ঞানিক অস্তিত্ব মাত্র একশো বছরের এবং শারীরবিজ্ঞানে তুলনামূলক পদ্ধতির উদ্ভব কেবল পঞ্চাশ বছর আগে, আর প্রায় সমস্ত প্রাণ বিকাশের মূল রূপ যে কোষ, তার আবিষ্কার চল্লিশ বছরও নয়! (চলবে)