প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি হানাদারির বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন দুনিয়া জুড়ে

প্যালেস্টাইনের আক্রান্ত জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্ত ফ্রন্ট ‘আইকর’ (ইন্টারন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন অফ রেভোলিউশনারি পার্টিস অ্যান্ড অরগানাইজেশনস)– যার অফিসিয়াল সদস্য এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট), ১৫ মে বিশ্ব জুড়ে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ দিবসের ডাক দেয়। এ দিন ভারতের বিভিন্ন শহরে ইজরায়েল বিরোধী বিক্ষোভ হয়। ছবিঃ অনন্তপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ

‘ছাত্র হিসাবে ইতিহাসের ক্লাসে ঔপনিবেশিক শাসন সম্পর্কে আমাদের পড়ানো হয়েছে। আজ যদি আমরা চুপ করে থাকি তবে সেটা হবে শিক্ষার উদ্দেশ্যের প্রতি চূড়ান্ত প্রতারণা।’ মন্তব্যটা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের। প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি হানাদারির বিরুদ্ধে আমেরিকা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে এ কথা বলেন তিনি।

গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে চলা প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েলের সাম্প্রতিকতম যুদ্ধের পরিণতিতে সেখানকার ৮০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে বলে রাষ্ট্রসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছে। এই হানাদারিতে এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ছাত্র, ২৬১ জন শিক্ষক এবং ৯৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়-অধ্যাপক নিহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞ দল ১৮ এপ্রিল একটি বিবৃতিতে বলেছে, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে প্যালেস্তাইনের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা বা ‘বুদ্ধিজীবী গণহত্যা’ বা ‘স্কলাশটিসাইড-এর সামিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্যালেস্তিনীয় সমাজের ভিত্তিকে ধ্বংস করার জন্যই ছক বেঁধে এবারের আক্রমণ সংগঠিত করা হয়েছে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র ‘এটা’-র মতে, (সম্পূর্ণ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যে প্যালেস্তাইনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে স্বীকার করছে না, সেটাই ভয়ঙ্কর। ‘দ্য নিউ স্কুল’-এর একজন ছাত্রী ‘রু’ (সম্পূর্ণ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেছে, আমি মনে করি এই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এবং এর অবসানের জন্য সংগ্রামে নিজের যথাসাধ্য করার জন্য প্রত্যেকের নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আমেরিকা এবং ন্যাটো-গোষ্ঠীভুক্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি শুরু থেকেই ইজরায়েলের বন্ধু। এবারেও তারা ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় জো বাইডেনের ‘ডেমোক্রেটিক’ দলের সরকার ইজরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে গণহত্যায় সাহায্য করছে। এই মানবতাবিরোধী নীতিকে সমর্থন করতে পারেনি আমেরিকার ছাত্রসমাজ। তারা এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান শুরু করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। তারা ইজরায়েলের ভয়ঙ্কর হামলার তীব্র বিরোধিতা করে এবং ইজরায়েলের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দাবি জানায়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে হার্ভার্ড, ইয়েল, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি, ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস সহ আরও বহু কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমেরিকার সংবাদসংস্থা ‘অ্যাক্সিয়স’-এর সূত্রে জানা গেছে দেশের ১৩০টি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন চলছে। সভা চলছে, অবস্থান-ধর্না হচ্ছে। এই আন্দোলন দমন করতে মার্কিন প্রশাসন তাদের স্বৈরাচারী নীতি অনুসরণ করে দমন-পীড়ন নামিয়ে এনেছে। প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তার করছে, বর্বর পুলিশি হামলা চালাচ্ছে। একটি ভিডিও ক্লিপিংয়ে দেখা যাচ্ছে এক মহিলা বিক্ষোভকারীকে মাটিতে ফেলে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হচ্ছে। ‘অ্যাক্সিয়স’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৬১টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ২৯০০ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয় কানাডা,মেক্সিকোতেও গণহত্যাবিরোধী এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কানাডার কুইবেক-এর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের হুমকি উপেক্ষা করে তাদের অবস্থান-ধর্না চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়। কিন্তু আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন দেখে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে অস্বীকার করে। ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাপক প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। মেক্সিকোর সব থেকে বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকো’তে (ইউএনএএম) ছাত্রছাত্রীরা ইজরায়েলের সঙ্গে মেক্সিকোর সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে শিবির তৈরি করে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন।

আটলান্টিকের পূর্ব পারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রিটেনের দুটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজেও তীব্র ছাত্র-আন্দোলন চলছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনেও বিক্ষোভ হয়েছে, নিউক্যাসল, ব্রিস্টল, ওয়ারউইক, লিডস, শেফিল্ড এবং শেফিল্ড হ্যালাম সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও বিক্ষোভ হয়েছে। লন্ডনের গোল্ডস্মিথস ইউনিভার্সিটি ছাত্রদের দাবিগুলি সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে ট্রিনিটি কলেজে ছাত্ররা প্যালেস্টাইনের পতাকা এবং ব্যানার দিয়ে সজ্জিত তাঁবু স্থাপন করেছে। সেই ব্যানারে লেখা আছেঃ ‘ইজরায়েল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’। বিশ্ব জুড়ে ওঠা সেই বিখ্যাত স্লোগান লিখেছে তারা– ‘ফ্রম রিভার টু সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’।

ফ্রান্সে ‘প্যারিস ইনস্টিটিউট অফ পলিটিক্যাল স্ট্যাডিজ’ (সায়েন্স পিও)-এ অনশনে বসেছে ছাত্ররা। প্যারিসের সর্বোন ইউনিভার্সিটির প্রতিবাদকারীরাও অতি সম্প্রতি নৃশংস পুলিশি আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। দেশের সর্বত্র এর ব্যাপক নিন্দা হচ্ছে। ফ্রান্সের উচ্চ-বিদ্যালয়গুলির ছাত্ররাও হাজারে হাজারে বিক্ষোভ করেছে। তারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে।

জার্মানির বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লিপজিগ, ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন এবং তার উপর বর্বর পুলিশি হামলা প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের ১০০টিরও বেশি অ্যাকাডেমিতে পুলিশ তল্লাশি অভিযান চালায়। লক্ষ্য একটাই– ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন করা যাবে না।

আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের আরও নানা দেশে। নেদারল্যান্ডস, ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ডে বিক্ষোভ হয়েছে। একই রকম ছাত্র বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড।

জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার দাবিতে মুখরিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুবাক’ নামক প্যালেস্তাইন-সংহতি সংঘ বিক্ষোভ দেখায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বিক্ষোভ দেখিয়েছে। উত্তর আফ্রিকার দেশ মিশরের কায়রোয় আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে এবং বেইরুটের লেবানিজ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-বিক্ষোভ হয়েছে এবং চলছে।

সাম্প্রতিক কালের এই ছাত্র-আন্দোলনকে এই শতাব্দীর বৃহত্তম ছাত্র-আন্দোলন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এই আন্দোলন জোর গলায় ঘোষণা করছে– সাম্রাজ্যবাদীরা নয়, শেষ কথা বলবে যুদ্ধবিরোধী প্রতিরোধের শক্তি-ই।

গাজার গণহত্যায় ইন্ধন জোগাতেই কি ইজরায়েলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে ভারত

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ২২ মে এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত থেকে ইজরায়েলে ২৬.৮ টন অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়ার পথে ডেনমার্কের পতাকাবাহী জাহাজকে নোঙর করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে স্পেনের বিদেশ মন্ত্রক। ১৭ মে সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছে। এই জাহাজে রকেট ইঞ্জিন, বিস্ফোরক সহ রকেট, অন্যান্য বিস্ফোরক ও বিস্ফোরকের চার্জ বিপুল পরিমাণে বহন করা হচ্ছে। পুণের একটি ভারতীয় কোম্পানি থেকে এই অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

এর আগেও গাজায় ইজরায়েলের হানা শুরু হওয়ার পর দু’বার ২০২৩-এর ২০ নভেম্বর এবং ২০২৪-এর ১২ জানুয়ারি ‘প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভস লিমিটেড’ নামে ভারতীয় বেসরকারি একটি কোম্পানিকে ইজরায়েলে বিস্ফোরক ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ পাঠানোর ছাড়পত্র দিয়েছে ভারত সরকার। এ থেকে স্পষ্ট, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে পরিষ্কার বোঝাপড়া করেই ভারত সরকার গাজার গণহত্যায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। এ জন্যই ইজরায়েলে যুদ্ধ উপকরণ ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে তারা। ভারত সরকারের এই ভূমিকা আগেই স্পষ্ট হয়েছিল, যখন গত মাসে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ইজরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা এবং গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভোট দানে তারা বিরত থাকে। ভারত সরকারের এই ভূমিকার আমরা তীব্র নিন্দা করছি। ভারত সরকার যে মানবতা ও সভ্যতার সমস্ত রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে গাজার গণহত্যায় মদত জোগাচ্ছে এই ঘটনায় তা আবার সুনিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হল।

আমরা ভারতের জনগণ গাজার মানুষের পাশে আছি। আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, ইজরায়েলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাঠানো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।