সারা দুনিয়া জুড়ে শান্তিকামী মানুষ প্রতিদিন রাস্তায় নামছেন প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েলের পৈশাচিক হানা বন্ধ করার দাবিতে। ব্রিটেন, আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, এশিয়া আফ্রিকায়, এমনকি যে দেশের সরকারগুলি মার্কিন তাঁবেদার বলে পরিচিত সেখানেও সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধের দাবিতে সোচ্চার।
মনে পড়ে যাচ্ছে দু’দশক আগের কথা। যখন, ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী জোটের নিরন্তর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। পুঁজিবাদের তীব্র সংকট থেকে সাময়িক মুক্তির খোঁজেই ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সেই সামরিক অভিযান। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র বকলমে বিশ্বের পয়লা নম্বর সন্ত্রাসবাদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজের অস্ত্র-ব্যবসার পালে কিঞ্চিৎ হাওয়ার জোগান পেতে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছিল। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ সেদিন বুঝেছিলেন এই সত্য। তাই তাঁরা লাখে লাখে পথে নেমেছিলেন যুদ্ধের নামে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে। খোদ আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ পুঁজিবাদী দুনিয়ার রাজপথ ভেসে গিয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের জোয়ারে। দু’দশক পর আবারও সেই একই ছবি ফিরে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে পথে নেমেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
হামাস বিরোধিতার নামে আদতে প্যালেস্টাইনে নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছে ইজরায়েল। কার্যত নরককুণ্ডে পরিণত করা হয়েছে গাজাকে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে হাতে নিজেদের নাম লিখে রাখছে শিশুরা, যাতে বোমাবর্ষণে মারা গেলে বেওয়ারিশ লাশ হতে না হয়। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। তার ৪০ শতাংশই শিশু। কারও বয়স ১ মাস, কারও ১ বছর বা ৩ বছর। গাজায় বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, জল নেই। হাসপাতালে চিকিৎসার উপায় নেই। নূ্যনতম চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে সদ্যোজাত শিশুরা। স্কুল, বসতি, উদ্বাস্তু শিবির এমনকি হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্সের উপর বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করছে ইজরায়েল। এই বীভৎস গণহত্যা দেখে স্বাভাবিক কারণেই চুপ করে থাকতে পারছেন না গোটা বিশ্বের হৃদয়বান মানুষ। তাঁরা দাবি তুলেছেন অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ হোক, অবিলম্বে বোমাবর্ষণ থামাক ইজরায়েল।
লন্ডনে প্রতি শনিবার যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল করছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। সংঘর্ষ শুরুর পর প্রথম মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন দেড় লক্ষ মানুষ। দ্বিতীয় মিছিলে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তিন লক্ষ মানুষ পথে নামেন ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে। তৃতীয় মিছিলে অংশ নেন আরও বেশি– ৫ লক্ষ মানুষ। কেবল লন্ডন নয়, গ্রেট ব্রিটেনের সর্বত্র ছোট বড় যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ হচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলি সক্রিয় ভাবে এগিয়ে এসেছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজে। প্রতিটি মিছিলেই সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে উপস্থিত থাকছেন ব্রিটেনের বামপন্থী এবং কমিউনিস্টরা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আসছেন দল বেঁধে। বিরাট সংখ্যায় উপস্থিত হচ্ছেন জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিরা। তাঁরা ব্যানার নিয়ে আসছেন প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে। বলছেন, ‘নট ইন মাই নেম’– সাধারণ শান্তিকামী ইহুদিদের নামে এই গণহত্যা চালানো যাবে না।
ইংল্যান্ডের শাসকদল দক্ষিণপন্থী কনজারভেটিভ পার্টি সরাসরি ইজরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিরোধী লেবার পার্টির নেতা, যাঁকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বলা হচ্ছে, সেই কের স্টামারও ইজরায়েলের পক্ষে।
সরকার যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। বলা হয়েছে, প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে মিছিল করলে বা প্যালেস্টাইনের পক্ষে স্লোগান দিলে গ্রেফতার করা হবে। সেই হুমকি উড়িয়ে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে পথে নামছেন মানুষ। আন্দোলনের চাপ পড়ছে বুর্জোয়া দলগুলির ভিতরেও। ইতিমধ্যেই লেবার পার্টির প্রচুর কাউন্সিলর পদত্যাগ করেছেন। শতাধিক লেবার সাংসদ যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। খোদ স্টামারের শ্যাডো কাউন্সিলের একাধিক সদস্য লেবার পার্টির অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন।
প্রতিবাদে উত্তাল ইউরোপের অন্যান্য দেশও। জার্মানি এবং ফ্রান্সে ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছেন। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে তাঁদের। প্যালেস্টাইনের পক্ষে জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে পথে নামছেন মানুষ। একই ছবি নেদারল্যান্ডস, স্পেন, গ্রিস, বেলজিয়াম, ইটালি সহ সর্বত্র। প্রতিটি দেশে গড়ে উঠছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেন। বিক্ষোভে উত্তাল খোদ পুঁজিবাদের দুর্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, বস্টন সহ সর্বত্র রাষ্ট্রীয় ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পথে নেমেছেন যুদ্ধবিরোধী মানুষ। কিউবা, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল সহ লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশ সংহতি জানিয়েছে প্যালেস্টাইনের সংগ্রামের প্রতি। আফ্রিকার দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে পথে নামছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, গ্যাবন, জিম্বাবোয়ে, মালি, তিউনিশিয়া, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া সহ সর্বত্র অবিলম্বে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধের দাবিতে মিছিল হচ্ছে।
বিক্ষোভে প্রতিবাদে উত্তাল গোটা মধ্যপ্রাচ্য। তুরস্কে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ পথে নামছেন প্যালেস্টাইনের সমর্থনে। তুরস্ক সরকারের প্রতি তাঁদের স্পষ্ট বার্তা, কেবল মৌখিক সমর্থন নয়, সরাসরি পাশে দাঁড়াতে হবে প্যালেস্টাইনের। একই ছবি মিশর এবং জর্ডনের। মিশরের বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন, যুদ্ধে ঘরছাড়া, আহত প্যালেস্টিনীয়দের সব রকমের সাহায্য করুক মিশরের সরকার। জর্ডন পরিচিত মার্কিন-বন্ধু হিসাবে। সে-দেশের বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে গণহত্যাকারী ইজরায়েলের বিরোধিতা করুক জর্ডন সরকার। নয়তো আন্দোলন আরও তীব্র হবে। একই ছবি ইয়েমেন, লেবানন সহ সর্বত্র।
বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা এই প্রতিবাদের চরিত্র বহুমাত্রিক। কেবল রাজপথেই যে প্রতিবাদ হচ্ছে এমন নয়। প্রতিবাদ হচ্ছে খেলার মাঠেও। ইংল্যান্ডের দুই বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব লিভারপুল এবং এভার্টনের সমর্থকরা গ্যালারিতে প্যালেস্টাইনের পতাকা উড়িয়েছেন। বিরাট ব্যানারে অবিলম্বে বোমাবর্ষণ বন্ধের দাবি তুলেছেন। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব সেল্টিকের সমর্থকরা প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারি সাজিয়ে তুলছেন প্যালেস্টাইনের পতাকায়। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ফুটবল মাঠেও একই ছবি। তিউনিশিয়ার টেনিস তারকা ওনস জাবেউর টেনিস কোর্টেই সরব হয়েছেন হাজার হাজার শিশুহত্যার বিরুদ্ধে।
দু’দশক পর আবারও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন গোটা পৃথিবীর শান্তিকামী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানুষ। এই সংগ্রামের কেন্দ্রে পুঁজিবাদবিরোধী চেতনাকে নিয়ে আসার কাজ সংগ্রামী বামপন্থী শক্তির, বিপ্লবী কমিউনিস্টদের। কারণ যে সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ এবং গণহত্যার জনক, তার জন্ম পুঁজিবাদের গর্ভে। যুদ্ধ, অনাহার, গণহত্যার অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র সমাজতন্ত্র। বিশ্বের দেশে দেশে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম যত তীব্রতর হবে, ততই বেগবান হবে শান্তির জন্য লড়াই।