আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১৮৭১ সাল প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ। বুর্জোয়া শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮ মার্চ বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কমিউন প্রতিষ্ঠা করে। কমিউন গুণগত ভাবে ছিল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। প্রথমেই কমিউন প্রশাসন থেকে আমলাতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। ভাড়াটে সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জনতার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। কমিউন সদস্য, কর্মচারী, অফিসারদের বেতনের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়, যা একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতনের মোটামুটি সমান। আট ঘণ্টা শ্রমসময় নির্দিষ্ট করে দেয়। শ্রমিকদের উপর জরিমানা ধার্য করা, রুটির কারখানায় রাতের শিফটে কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে শ্রমকমিশন গঠিত হয়। যে সব মালিক এতদিন শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিল তাদের সম্পত্তিচ্যূত করার আদেশ দেওয়া হয়। বেকার শ্রমিকদের কাজ ও সাহায্যের ঘোষণা করা হয়। অফিসার, সেনা অফিসার, বিচারপতি সকলের নির্বাচিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সব ধরনের নির্বাচিত ব্যক্তি অযোগ্য প্রমাণিত হলে নির্বাচকদের হাতে তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়। চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শিক্ষা হয় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। এই প্রথম কমিউন শাসনে শ্রমিকরা মুক্তির স্বাদ পায়।
কিন্তু নানা কারণে কমিউনকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ৭২ দিন পর ২৮ মে বুর্জোয়া সরকার অপরিসীম বর্বরতায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে কমিউনকে ধ্বংস করে। বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে হাজার হাজার কমিউনার্ডকে হত্যা করে বুর্জোয়ারা বিপ্লব দমন করে। এই লড়াইকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে কার্ল মার্কস তাঁর চিন্তাধারাকে আরও ক্ষুরধার করেন। শ্রমিক বিপ্লবের প্রচলিত ভ্রান্ত তত্ত্বগুলিকে আদর্শগত সংগ্রামে পরাস্ত করে প্যারি কমিউনের লড়াই মার্কসবাদের অভ্রান্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনার্ডদের অসীম বীরত্ব ও জঙ্গি লড়াই সত্ত্বেও কমিউনের পতন দেখায়, শ্রমিকবিপ্লবের জন্য সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব অবশ্য প্রয়োজন। প্যারি কমিউনের ইতিহাস জানা সমস্ত মার্কসবাদীর অবশ্য কর্তব্য। ২০১১ সালে গণদাবীতে সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আরও কিছু সংযোজন করে সেটিকে সম্পাদিত আকারে ধারাবাহিক ভাবে আমরা প্রকাশ করছি। এ বার দ্বিতীয় কিস্তি। – সম্পাদক, গণদাবী
(২)
রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের উগ্র সমর্থক দশম চার্লস ক্ষমতায় বসে আইনসভা ভেঙে দিয়ে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, ভোটাধিকার আরও সঙ্কুচিত করে ফ্রান্সে স্বৈরশাসন কায়েম করেন। ধর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে যাজকদের এবং অভিজাতদের যে ক্ষমতা ও সম্পত্তি বিপ্লব পরবর্তী শাসনে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তিনি তা আবার ফিরিয়ে আনেন। চার্লস ১৭৮৯ এর আগেকার বুরবোঁ রাজতন্ত্রের শাসন পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে চান। ফলে ১৮৩০ এর জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে আবার ফ্রান্সে ক্ষমতার বদল হয়। পরিবর্তন হয় রাজবংশের। টিকে যায় রাজতন্ত্র। বুরবোঁ রাজাদের পরিবর্তে তাঁদেরই আত্মীয় অর্লিয়ানিস্ট পরিবারের রাজা লুই ফিলিপ ক্ষমতায় বসেন। এই সরকার সম্পর্কে মার্কস বলেছেন, ‘‘লুই ফিলিপের রাজত্বে ফরাসি বুর্জোয়ারা শাসন চালায়নি। চালিয়েছিল তাদের একটি অংশ– ব্যাঙ্কের কর্তা, ফাটকাবাজারের রাজারাজড়া, রেলপথের রাঘববোয়াল, কয়লা আর লোহার খনি ও বনজঙ্গলের মালিক, আর তাদের সঙ্গে জড়িত ভূস্বামীদের একটি অংশ, অর্থাৎ তথাকথিত ফিনান্স অভিজাতবর্গ।” এই সরকারে প্রকৃত শিল্প-বুর্জোয়ারা বিরোধী পক্ষ হিসাবেই থেকে যায়। সব স্তরের পেটিবুর্জোয়া এবং কৃষকরাও রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থেকে যায়।
লুই ফিলিপের রাজত্বে অসন্তুষ্ট শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। ১৮৪৫ সালের পর থেকে এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের আবর্তে পড়ে গোটা ফ্রান্স। আলুর মড়ক ও অজন্মা গোটা ফ্রান্স জুড়ে কৃষক ও জনসাধারণের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের জন্ম দেয়। ইউরোপ, বিশেষত ইংল্যান্ডের শিল্পসঙ্কট মারাত্মক প্রভাব ফেলে ফ্রান্স জুড়ে। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে ছোট পুঁজির মালিকেরা। বুর্জোয়াদের একটা বড় অংশও দেউলিয়া হয়ে যায়। কলকারখানা বন্ধ হতে থাকে। ফ্রান্স জুড়ে শুরু হয় শ্রমিক ধর্মঘট। ফরাসি সমাজের বৃহত্তম অংশের অনাস্থা ঘোষিত হয় লুই ফিলিপ সরকারের বিরুদ্ধে। শিল্পমালিক বুর্জোয়ারা লুই ফিলিপের সংসদে ছিল সংখ্যালঘু। এই পরিস্থিতিতে শাসনক্ষমতা বহির্ভূত এই বুর্জোয়া গোষ্ঠী ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবি তোলে। ১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে বুর্জোয়া শ্রেণির সংস্কারকামী আন্দোলন শ্রমিকদের ব্যাপক যোগদানের ফলে সর্বাত্মক বিপ্লবে পরিণত হয়। শ্রমিক শ্রেণির বৈপ্লবিক মেজাজ অনিচ্ছুক বুর্জোয়া শ্রেণিকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে।
আগেকার বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের পক্ষে প্রশাসন সহ সবক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক গাঁটছড়াকে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা ঐতিহাসিক কারণেই সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই শিল্পমালিকরা লড়াই করেছে এই সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে তুলে একশো শতাংশ বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা চালু করা এবং তারই সাথে নিজেদের গোষ্ঠীকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে পরিণত করার জন্য। প্রজাতন্তে্র বিশ্বাসী উদারনৈতিক পেটিবুর্জোয়াদের সমর্থন স্বাভাবিক কারণেই এরা পায়। শোষণে নিষ্পেষিত শ্রমিক মেহনতি মানুষ ও কৃষকরাও রাজতন্ত্রের বিরোধী হয়ে উঠেছিল। শাসক বুর্জোয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে তারা সামিল হওয়ায় ফরাসি দেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সংগ্রামের সৃষ্টি হয়।
শিল্প মালিকরা চাইছিল নির্বাচন ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতার অংশীদার হতে এবং সম্ভব হলে তখনও টিকে থাকা সামন্ততান্ত্রিক যোগসূত্রগুলি খতম করে রাজতন্ত্রকে পুরোপুরি বুর্জোয়া নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্তে্র পরিণত করতে। কিন্তু সংগ্রামে মেহনতি মানুষ অংশগ্রহণ করায় ঐটুকু দাবির ভেতরেই সংগ্রামকে আটকে রাখা যায়নি। ফলে বুর্জোয়াদের র্যাডিক্যাল অংশ যারা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী তাদের হাতে নেতৃত্ব চলে যায়। শ্রেণি চেতনার অভাবের ফলে মেহনতি মানুষ মনে করে, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই শোষণের অবসান সূচিত করবে। জনতা বিপুল বিক্রমে লড়াই করে। সরকারের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনী এমনকী সৈন্যবাহিনীকে পর্যন্ত জনতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করানো যায়নি। সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়। সফল হয় ১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম।
২৫ ফেব্রুয়ারি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পতনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র– সোস্যাল রিপাবলিক। গঠিত হয় এক অস্থায়ী সরকার। প্যারিস জুড়ে দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পেতে থাকে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ঘোষণা। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এতদিনের গুটিকয়েক মাত্র বুর্জোয়া গোষ্ঠীর বদলে শ্রমিক, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া সহ ফরাসি সমাজের সব কটি শ্রেণিই রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যে এসে পড়ে। অন্য দিকে নতুন সরকারের মন্ত্রীদপ্তরগুলি বুর্জোয়ারা নিজেদের নানা অংশের মধ্যে ভাগ করে নেয়। অস্থায়ী সরকারে শ্রমিক শ্রেণির দু’জন মাত্র প্রতিনিধি, লুই ব্লাঁ ও আলবের, কার্যত তাঁদের ক্ষমতাশূন্য করে রাখা হয়।
১৮৩০ এর জুলাইয়ে শ্রমিকেরা লড়ে পেয়েছিল বুর্জোয়া রাজতন্ত্র, ‘৪৮ এর ফেব্রুয়ারিতে তারা লড়ে পেল বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র। মার্ক্স বললেন, ‘‘অস্থায়ী সরকারকে ও অস্থায়ী সরকার মারফত গোটা ফ্রান্সকে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে প্রলেতারিয়েত তৎক্ষণাৎ এক স্বাধীন পার্টি হিসাবে সামনের সারিতে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্ত সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বানও সে জানায় সমস্ত বুর্জোয়া ফ্রান্সকে। সে যা জিতে আনল তা মোটেই তার মুক্তি নয়, তার বৈপ্লবিক মুক্তির জন্য লড়বার জায়গাটা।”
অস্থায়ী সরকারের শাসনে শ্রমিকরা অস্ত্রধারণের অধিকার পেল। ন্যাশনাল গার্ডে যোগদানেরও বাধা থাকল না। জীবিকার অধিকারের প্রতিশ্রুতি আদায় হল। বেকার শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার জন্য গঠিত হল ন্যাশনাল ওয়ার্কশপ। হাজারে হাজারে বেকার শ্রমিক ওয়ার্কশপের রেজিস্টারে নাম লিখিয়ে মাটি কাটা, রাস্তা বানানো, গাছ পোঁতার মতো ক্লান্তিকর একঘেয়ে কাজ করে যেতে থাকল। খোলা আকাশের নিচে শ্রমনিবাস– এই হল জাতীয় ওয়ার্কশপ। রাজনৈতিক চেতনায় অপরিণত প্রলেতারিয়েত এই সরকারকে তার নিজের মনে করল। ধরে নিল এই সরকার সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শে গঠিত এবং শ্রেণিনিরপেক্ষতার প্রতীক। প্রজাতন্ত্রকে আপন সৃষ্টি মনে করে প্যারিসের প্রলেতারিয়েত অস্থায়ী সরকারের এমন প্রত্যেকটি কাজকেই অভিনন্দিত করল যা বুর্জোয়া সমাজে সরকারের পাকা আসন প্রতিষ্ঠাতেই সহায়তা করল। বুর্জোয়াদের সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাজে নিজেদের নিযুক্ত করতে রাজি হল। লুই ব্লাঁ (লুই ব্লাঁ ফ্রান্সের কল্পবাদী সমাজতন্ত্রী নেতা। শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবসমাজ মজুরির গোলামি থেকে মুক্তিতে বিশ্বাস করতেন না, মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীর ষড়যন্ত্রেই তা ঘটবে বলে মনে করতেন।) শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত বিরোধের মধ্যস্থতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
তখনও ইউরোপ জোড়া বাণিজ্য সঙ্কট অব্যাহত। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব চালিত হয়েছে ফিনান্স আভিজাত্যের বিরুদ্ধে। এর ফলে ঘা খেল সরকারি ও ব্যক্তিগত ক্রেডিট। অস্থায়ী সরকারের আর্থিক অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে উঠল। এই অবস্থায় সরকার চাইল প্রজাতন্ত্রের বুর্জোয়া বিরোধী চেহারা ঘোচাতে। পুরনো বুর্জোয়া সমাজ রাষ্ট্রের কাছে যে হুন্ডি পেশ করেছিল তাকে মেনে নিয়ে অস্থায়ী সরকার নতি স্বীকার করল সেই সমাজেরই কাছে। রাষ্ট্রের পাওনাদারদের সব পাওনা সুদ সহ মিটিয়ে দিল। আর্থিক সঙ্কট মেটাতে সরকার ঘোষণা করল নতুন কর। না, ব্যাঙ্ক মালিক, সরকারের মহাজন বা শিল্পপতিদের উপর নয়, তা চাপল সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকদের উপর। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যয় বহন করতে হল কৃষকদেরই। মার্ক্স লিখলেন, ‘‘সেই মুহূর্ত থেকে ফরাসি কৃষকের কাছে প্রজাতন্ত্রের অর্থ হল ৪৫ সাঁতিমের ট্যাক্স, প্যারিস প্রলেতারিয়েত তার চোখে প্রতিভাত হল এমন এক উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী বলে যে তার ঘাড় ভেঙে নিজেরটা গুছিয়ে নিচ্ছে।”
‘‘১৭৮৯ এর বিপ্লব যেখানে শুরু হয়েছিল কৃষকদের ঘাড় থেকে সামন্তী বোঝা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, সেখানে ১৮৪৮ এর বিপ্লব গ্রামীণ জনতার কাছে আত্মঘোষণা জানাল নতুন কর বসিয়ে এবং তা এই জন্য যাতে পুঁজি বিপন্ন না হয় এবং তার পাহারাদার হিসাবে রাষ্ট্রযন্ত্র চালু থাকতে পারে।”
পেটিবুর্জোয়ারাও তাদের সমস্ত দুরবস্থার জন্য ন্যাশনাল ওয়ার্কশপগুলিকেই দায়ী করল। প্রবল ক্রোধ নিয়ে হিসেব কষতে বসল, যখন তারা নিজেরা অসহ্য দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে তখন ‘নিষ্কর্মা’ শ্রমিকরা সরকারি অর্থ কী পরিমাণে গ্রাস করছে।
এ দিকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতকে যে সব সুবিধা দিতে হয়েছিল, যে সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, বুর্জোয়াদের কাছে সেগুলি এখন পরিণত হল শৃঙ্খলে, যা না খসালেই নয়। এমনকি একটা কথার কথা হিসাবেও শ্রমিকদের মুক্তি নতুন প্রজাতন্ত্রের পক্ষে হয়ে উঠল অসহ্যরকমের মারাত্মক। কারণ চালু আর্থিক শ্রেণি-সম্পর্কের অবিচল ও নির্বিঘ্ন স্বীকৃতির উপরে যার নির্ভর সেই ক্রেডিট ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এ দাবি এক স্থায়ী প্রতিবাদ। অতএব প্রয়োজন হয়ে পড়ল শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার।
এই রকম পরিস্থিতিতে, ৪ মে সংবিধান পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। নির্বাচনে বুর্জোয়াদের জয়জয়কার। নির্বাচকরা শ্রমিক প্রতিনিধিদের প্রত্যাখ্যান করল। নবনির্বাচিত জাতীয় সংবিধান কক্ষ পরিণত হল প্যারির প্রলেতারিয়েতের বিচারসভায়। শ্রমিকদের যে সব সুবিধাগুলি দেওয়া হয়েছিল সবই কেড়ে নেওয়া হল। এক্সিকিউটিভ কমিশন থেকে প্রলেতারিয়েত প্রতিনিধি লুই ব্লাঁ ও আলবেরকে সরাসরি বাদ দেওয়া হল। সেই অর্থে প্রজাতন্ত্রের সূচনা ৪ মে থেকে, ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নয়। মার্ক্স লিখেছেন, ‘‘প্যারিস প্রলেতারিয়েত অস্থায়ী সরকারের উপর যে প্রজাতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছিল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সহ প্রজাতন্ত্র, ব্যারিকেড-সংগ্রামীদের দৃষ্টিতে ছিল যে ধ্যানমূর্তি– এ সেই প্রজাতন্ত্র নয়। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত একমাত্র বৈধ প্রজাতন্ত্রটি এমন এক প্রজাতন্ত্র যা বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরোধী কোনও বিপ্লবী হাতিয়ার নয়, বরং এই ব্যবস্থারই রাজনৈতিক পুনর্গঠন, বুর্জোয়া সমাজের রাজনৈতিক পুনর্সংহতি, এক কথায় একটি বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র।”
নতুন সরকারের মন্ত্রী ত্রেলা ঘোষণা করলেন– এখন কাজ শ্রমিককে আবার তার পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। তাই দরকার পড়ল তাদের রাস্তার লড়াইয়ে পরাস্ত করার। কারণ শ্রমিকরা ফেব্রুয়ারিতে রাস্তায় লড়েই বুর্জোয়াদের জিতিয়েছিল।
বুর্জোয়াদের পক্ষে এই কাজটারই সুবিধা করে দিল যখন শ্রমিক শ্রেণির একটা বেপরোয়া অংশ ১৫ মে তাদের বিপ্লবী প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় জাতীয় সভায় চড়াও হল। এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তারা তাদের সব থেকে সাহসী এবং শক্তিশালী নেতাদের পাঠিয়ে দিল বুর্জোয়াদের কারাগারে। বুর্জোয়ারা এবার প্রলেতারিয়েতকে এক চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে বাধ্য করল। জনসাধারণের যে কোনও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। ন্যাশনাল ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দেওয়া হল। বেকার শ্রমিকদের সামনে তুলে ধরা হল দুটি বিকল্প। হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দাও, না হয় গ্রামাঞ্চলে গিয়ে মাটি কাটার কাজ নাও। দলে দলে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে ঘোষণা করল, না, আমরা যাব না।
শ্রমিকদের সামনেও দুটি বিকল্প অবশিষ্ট থাকল। হয় অনশন, নয় লড়াই। দ্বিতীয়টাই বেছে নিল তারা। ২২ জুন প্রচণ্ড এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানে তারা এর জবাব দিল। বর্তমান সমাজ যে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত তাদের মধ্যেকার প্রথম আপসহীন লড়াই সংগঠিত হল। এরই সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের শ্রেণিনিরপেক্ষতার মুখোশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
বিনা নেতৃত্বে, কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই, রসদ ছাড়া, অধিকাংশ সময়ে উপযুক্ত হাতিয়ার ছাড়াই শ্রমিকরা অতুলনীয় নির্ভীকতা ও উদ্ভাবনীশক্তির জোরে পাঁচ দিন সেনাবাহিনী, রক্ষিবাহিনী, প্যারিসের ভেতরের ও বাইরে থেকে স্রোতের মতো আসা রক্ষিবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখল। বিস্মৃতপ্রায় জমিদারবংশের ধনী চাষি, প্যারি আর প্যারির বাইরের সব ধরনের বুর্জোয়ারা নিজেদের সব দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে একজোট। তারা চিরদিনের জন্য শ্রমিক শ্রেণির সমাজ বদলাবার শখ মিটিয়ে দিতে চায়।
লড়াইয়ে দশ হাজার শ্রমিক প্রাণ দিল রাস্তায়। নজিরবিহীন নৃশংসতা চালিয়ে আরও ছ’হাজার বন্দি শ্রমিককে হত্যা করল বুর্জোয়ারা। শ্রমিক অভুত্থান পরাস্ত হল। শ্রমিক বিদ্রোহের আগুনে ‘সৌভ্রাতৃত্ব’ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ভ্রাতৃত্ব টিকে ছিল ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ বুর্জোয়াদের স্বার্থের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থের সংঘাত বাধেনি। ২৫ জুন বুর্জোয়ার প্যারি যখন আলোকমালায় সজ্জিত আর উল্লাসে মাতোয়ারা, সর্বহারার প্যারি তখন দগ্ধ, রক্তাক্ত। ফেব্রুয়ারির বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের পরাজয়ে নয়, জুনে সর্বহারার পরাভবেই ঘটল বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত উদ্ভব। কিন্তু জুনের পরাজয় ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণিকে ইউরোপের শ্রমিকবিপ্লবের নেতৃত্বে উন্নীত করল, আর শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা পরিণত হল বিপ্লবের লাল পতাকায়। মহান মার্ক্সের অমোঘ উচ্চারণ ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির মাঝে, ‘বিপ্লবের মৃত্যু ঘটেছে– বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!’ (ক্রমশ)